পৃথিবীর নিয়মে পৃথিবীতে মানুষ আসে। আপনমনে কর্ম করে চলে। এই কর্মে কেউ কেউ বেঁচে থাকতেই হয়ে ওঠেন অনন্য। মৃত্যুর পর তাঁরা যেন সবার হৃদয়ে আরও বেশি গেঁথে যান। দেশের চলচ্চিত্রে তেমনই একজন তারকার নাম মান্না। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে জন্ম নেওয়া এই নায়কের আসল নাম এস এম আসলাম তালুকদার।
ছোটবেলা থেকে চলচ্চিত্রের প্রতি মান্নার ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। কলেজে পড়ার সময় ছিলেন সিনেমার পোকা। সিনেমার নায়ক রাজ্জাক হলে তো কথাই নেই। স্বপ্ন দেখতেন তিনিও একদিন অভিনয় করবেন। অনেকের ইচ্ছা থাকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী হওয়ার কিন্তু তাঁর ইচ্ছা ছিল নায়ক হওয়ার। একদিন বলাকায় সিনেমা দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ বিজ্ঞাপন। তারপর টিভি আর পত্রিকায় দেখে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি ইন্টারভিউ দেন। সুযোগও পেয়ে যান।
১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার ওরফে মান্না। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে মান্না ঢাকা কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন। ১৯৮৪ সালে তিনি এফডিসির নতুন মুখের সন্ধান কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে আসেন। নায়করাজ রাজ্জাক মান্নাকে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। ‘তওবা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে তাঁর।
‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমে সুযোগ পেয়েই কিন্তু আসলাম থেকে নায়ক মান্না হতে পারেননি তিনি। এর জন্য অনেক ত্যাগ, অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। এফডিসি ও চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিসপাড়ায় ঘোরাঘুরি আর নিয়মিত পরিচালকদের কাছে ধরনা দিতে হতো। যে রাজ্জাককে দেখে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বপ্ন দেখার শুরু, সেই রাজ্জাকই একসময় তাঁকে সুযোগ করে দেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের।
১৯৮৬ সালে ‘নায়করাজ’ রাজ্জাকের এক বন্ধুর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত ‘তওবা’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ ঘটে মান্নার। আর এভাবেই শুরু হয় নায়ক মান্নার চলচ্চিত্র জীবনের যাত্রা। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে এস এম আসলাম তালুকদার নাম বদলে হয়ে ওঠেন মান্না। শুরুতে একের পর এক অ্যান্টিহিরো হিসেবে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সে সময় তেমন কোনো সাফল্য আনতে পারেননি।
আশির দশকে মান্না যখন ছবিতে অভিনয় শুরু করেন, সে সময় রাজ্জাক, আলমগীর, জসীম, ফারুক, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনের নায়ক হিসেবে বেশ দাপট। সেই দাপুটে অভিনেতাদের মাঝেও ‘তওবা’, ‘পাগলী’, ‘ছেলে কার’, ‘নিষ্পাপ’, ‘পালকি’, ‘দুঃখিনী মা’, ‘বাদশা ভাই’-এর মতো ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়েছেন মান্না। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব ছবির কোনোটিতেই মান্না প্রধান নায়ক ছিলেন না। তাই সাফল্যের ভাগীদার খুব একটা হতে পারতেন না।
মান্না অভিনীত প্রথম ছবি ‘তওবা’ হলেও মুক্তির দিক দিয়ে ‘পাগলী’ ছিল তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র। ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘কাশেম মালার প্রেম’ ছবিতে প্রথম একক নায়ক হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন মান্না। এ ছবি সুপারডুপার হিট হওয়ার কারণে একের পর এক ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান মান্না। এরপর কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ও ‘ত্রাস’ ছবির কারণে তাঁর একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। এরপর আরও কয়েকটি ব্যবসাসফল ছবি উপহার দেন মান্না। দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘গরীবের বন্ধু’ ছবির পর একটু ধীরে এগোতে থাকেন মান্না। সে সময় মান্নাকে নিয়ে সবার আগ্রহ তৈরি হয়। সবাই তাঁকে নিয়ে ছবি বানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রের প্রযোজক-পরিচালকেরাও তাঁর কাছে নির্ভরতা খুঁজে পান।
মমতাজুর রহমান আকবর, কাজী হায়াত, নুর হোসেন বলাই, নাদিম মাহমুদ, এম এ মালেক, এফ আই মানিক, মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, এ জে রানা, বেলাল আহমেদের মতো পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করে মান্না প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করেন। পরিচালকেরা তাঁর প্রতি আস্থা অর্জন করতে শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে সালমান শাহর হঠাৎ মৃত্যুতে প্রযোজক-পরিচালকেরা দিশাহারা হয়ে যান। কারণ, সে সময় সালমান শাহর ওপর বিনিয়োগ ছিল অনেক বেশি। এ সময় পরিচালকদের চোখে একমাত্র আস্থার নায়ক হিসেবে ধরা দেন মান্না। অভিনেতাও পুরো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার কঠিন দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেন।
১৯৯৭ সালে নায়ক থেকে প্রযোজনায়ও আসেন মান্না। মান্নার প্রথম ছবি ‘লুটতরাজ’ সুপারহিট ব্যবসা করে। এরপর বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে শুরু হয় মান্না-অধ্যায়। একের পর এক মুক্তি পেতে থাকে মান্না অভিনীত বেশ কয়েকটি ছবি। বেশির ভাগ ছবিই দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়িক সফলতাও পায়। সবাই মান্নাকে নিয়ে একের পর এক ছবি বানাতে থাকেন। প্রযোজক-পরিচালকেরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পান নতুন আশার আলো।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্রবিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডেও মান্নার ছিল অগ্রণী ভূমিকা। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে হঠাৎ অশ্লীলতা জেঁকে বসলে হাল ধরেন মান্না। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্ধকার কাটতে থাকে তাঁর দৃঢ় ভূমিকার কারণে। সে সময় একমাত্র নায়ক মান্নার ছবিগুলোই ছিল প্রযোজক ও পরিচালকদের আশার আলো, ব্যবসায় টিকে থাকার সাহস। মৃত্যুর আগপর্যন্ত মান্না একাই লড়ে গেছেন।
আশির দশকে সুনেত্রা, নিপা, মোনালিসা থেকে শুরু করে চম্পা, দিতি, রোজিনা, নূতন, অরুণা বিশ্বাস, কবিতার মতো সিনিয়র নায়িকাদের সঙ্গে অভিনয় করে যেমন সফল হয়েছিলেন, তেমনি মৌসুমি, শাবনূর, পূর্ণিমা, মুনমুন, সাথী, স্বাগতা, শিল্পী, লিমাদের সঙ্গে তাঁর ছবি ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অভিনয়, সংলাপ বলার ধরন দিয়ে নিজস্ব একটা স্টাইল দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। তাঁর অভিনীত এমন কিছু ছবি আছে, যার জন্য তিনি চিরদিনের জন্য দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। একটা সময় ছিল, যখন ছবিতে শুধু মান্না আছেন—এ কারণেই দর্শক হলে ছুটে গেছেন, তাঁর কারণেই ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে। মান্না যে ছবিতে দুর্দান্ত, সেই ছবির কাহিনি যত গতানুগতিকই হোক না কেন, সেই ছবি ব্যবসা করবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটনির্ভর ছবিতেও মান্না ছিলেন অনবদ্য।
অভিনয়জীবনে তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মান্না। তাঁর চলচ্চিত্রে বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের কথা উঠে এসেছে বারবার। বঞ্চিত মানুষের কথা সিনেমার পর্দায় সুনিপুণভাবে তুলে ধরে তিনি সবার মন জয় করেন। তাই তিনি ছিলেন আপামর জনসাধারণের প্রিয় নায়ক। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মারা যান মান্না। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত মান্না ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। বেঁচে থাকলে এত দিন তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ কোথায় গিয়ে ঠেকত, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তাঁকে নিয়ে নানা উপলক্ষে থাকত নানা আয়োজন। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। কারণ, তিনি আজ অনেক দূরের মানুষ, যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না। অনন্তের পথযাত্রী হয়ে গেছেন মান্না।