বিগত সরকারেও ‘চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি’ ছিল। তবে সেই পরামর্শক কমিটি দৃশ্যমান কোনো কাজ করতে পারেনি।
চলচ্চিত্র নিয়ে সরকারকে বুদ্ধি–পরামর্শ দিতে ‘চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি’ পুনর্গঠন করেছে সরকার। ২ অক্টোবর ২৩ সদস্যের কমিটির নাম প্রকাশ্যে আসার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কমিটিতে আমলাদের আধিক্য থাকায় চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা নীতিনির্ধারণে কতটা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। পাশাপাশি দশকের পর দশক ধরে পুঞ্জীভূত সংকট নিরসনে এই পরামর্শক কমিটি কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, সেটিও আলোচনায় আসছে।
পরামর্শক কমিটি
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সার্টিফিকেশন বোর্ড করেছে সরকার, পুনর্গঠন করেছে চলচ্চিত্র অনুদান কমিটিসহ বেশ কয়েকটি কমিটি। গুরুত্ব বিবেচনায় বাকি কমিটিগুলোর চেয়ে পরামর্শক কমিটিকে তুলনামূলক এগিয়ে রাখছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
তবে পরামর্শক কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৩ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশই আমলা। চলচ্চিত্র অঙ্গনের প্রতিনিধি হাতে গোনা কয়েকজনমাত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ আমলার মধ্যে চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা নীতিনির্ধারণে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন চলচ্চিত্র বিশ্লেষকেরা।
চলচ্চিত্রভিত্তিক তিন সমিতির বাইরে কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন অধ্যাপক আ আল মামুন; চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক আরিফুর রহমান, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক তানিম নূর; চলচ্চিত্র সমালোচক সাদিয়া খালিদ; চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী, সমালোচক ও নির্মাতা আহমেদ সালেকীন ও বঙ্গর চিফ কনটেন্ট অফিসার মুশফিকুর রহমান।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, কমিটিতে চলচ্চিত্রের অংশীজনদের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই যোগ্য। তবে অংশীজনের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার ছিল।
গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, কমিটিতে থাকা চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা যোগ্য ব্যক্তি। তবে আমলানির্ভর কমিটিতে তাঁরা কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
পুঞ্জীভূত জঞ্জাল কতটা
চলচ্চিত্রের কাঠামোগত সংস্কারে পরামর্শক কমিটির জন্য করণীয় কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এর মধ্যে রয়েছে ফিল্ম সার্টিফিকেশন ও ওটিটি নীতিমালা সংশোধন, ই-টিকেটিং, বক্স অফিস কার্যকর ও চলচ্চিত্রের বণ্টনে নায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে সিনেমা ব্যবসার সবচেয়ে বড় সংকট, কত টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে, সেই হিসাব পাওয়া যায় না। এ জন্য ই-টিকেটিং ও বক্স অফিসের হিসাব সংরক্ষণের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা দরকার। সঙ্গে সিনেমার টিকিটের টাকার ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা দরকার।’
উদাহরণ টেনে নির্মাতা ফারুকী বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রথম সপ্তাহে একটা টিকিটের মোট মূল্যের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের মতো পান প্রযোজক। নতুন ছবির ক্ষেত্রে প্রথম সপ্তাহে এটা কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ করতে হবে। দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রযোজকেরা ১৮ শতাংশের মতো পান। রেভিনিউ শেয়ারের বিষয়ে ন্যায্য মীমাংসায় যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে হলমালিকদের সঙ্গে বসে তাঁদের কথাও শোনা দরকার। কোনো কোনো দেশে প্রথম সপ্তাহে ৬০ শতাংশও পান প্রযোজকেরা। আমাদের এখানে ডাকাতি হচ্ছে বলে ন্যূনতম শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে।’
এ ছাড়া দেশজুড়ে মাল্টিপ্লেক্স করা; বুসান, সানড্যান্স, বার্লিন, রটারডাম, ফিল্মবাজার স্ক্রিন রাইটার্স ল্যাবের মতো ফিল্ম ফান্ড ও সাপোর্ট সিস্টেম করা এবং অনুদানপ্রথার আমূল পরিবর্তনের তাগিদ দিয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
পরিবর্তিত অনুদানপ্রথা কেমন হবে, তা নিয়ে ‘টেলিভিশন’ নির্মাতা ফারুকী বলেন, ৫০ শতাংশ অনুদান প্রথম ও দ্বিতীয় সিনেমার নির্মাতাদের জন্য বরাদ্দ থাকা দরকার। এর মধ্য অর্ধেক নারী নির্মাতা থাকবেন। অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতাদের স্ক্রিন ল্যাবের মতো ইনকিউবিটরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মেন্টর দিয়ে সাহায্য করতে হবে।
আমাদের দেশে প্রথম সপ্তাহে একটা টিকিটের মোট মূল্যের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের মতো পান প্রযোজক। নতুন ছবির ক্ষেত্রে প্রথম সপ্তাহে এটা কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ করতে হবে। দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রযোজকেরা ১৮ শতাংশের মতো পান। রেভিনিউ শেয়ারের বিষয়ে ন্যায্য মীমাংসায় যেতে হবে।মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নির্মাতা
আমলানির্ভর কমিটি কতটা কার্যকর হবে
এফডিসি, সার্টিফিকেশন বোর্ড, আপিল বোর্ড ও ফিল্ম আর্কাইভের মতো চলচ্চিত্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ দায়িত্বে থাকেন আমলারাই। ফলে চলচ্চিত্রের নীতিনির্ধারণে চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন না।
নির্মাতা ও প্রযোজক কামার আহমাদ সাইমন বলেন, ‘শুধু সার্টিফিকেশন বোর্ড নয়, পরামর্শক কমিটি, আপিল কমিটি, অনুদান কমিটিসহ সবখানেই দেখবেন আমলারাই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান বা সভাপতি। এফডিসি বা বিসিটিআইয়ের মতো জায়গাগুলায়, যেখানে চলচ্চিত্র উন্নয়ন বা শিক্ষা নিয়ে কাজ-কারবার হওয়ার কথা, সেখানেও পদাধিকারবলে আমলারাই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। একটা স্বাধীন দেশের নির্মাতা হিসেবে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?’
গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, ‘আমলাতন্ত্র দেখবে চলচ্চিত্রে জাতীয় স্বার্থ, চিন্তা-চেতনা ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না। চলচ্চিত্রের উন্নতি নিয়ে আমলারা খুব একটা ভাবেন না। ফলে চলচ্চিত্রের ভালো-মন্দ ভাবনার জায়গায় আমলারা নেই। কমিটির কাঠামোই এমন যে নতুন চিন্তা উৎসাহিত হবে না। চলচ্চিত্রের অংশীজনের সংখ্যা কম থাকায় তাঁরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন না। ফলে এ ধরনের কমিটি খুব বেশি কার্যকর হয় না।’
কমিটিতে চলচ্চিত্রের অংশীজনের সংখ্যা কম থাকায় তাঁরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন না। ফলে এ ধরনের কমিটি খুব বেশি কার্যকর হয় না।সুমন রহমান, গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও অধ্যাপক
নির্মাতা সাইমনের ভাষ্যে, ‘অন্তর্বর্তী সরকার থাকা অবস্থায় আমাদের হয়তো আমলারা সহযোগিতাই করবেন, কিন্তু রাজনৈতিক সরকার আসার পর যদি এই সব ভয়াবহ আইন আর আমলাতন্ত্রই থেকে যায়, তাহলে আর সেইটাকে সংস্কার বলা যাবে না। তার জন্য পরামর্শক কমিটিকে এখনই ভাবতে হবে। বনিয়াদি সংস্কারের জন্য প্রথমেই হাত দিতে হবে আইনগুলা আর ক্ষমতাকাঠামোয়। সব প্রতিষ্ঠান বা কমিটি থেকে আমলাদের সরিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে সিনেমার অংশীজনদের।’
ফারুকী বলেন, ‘একটা ফিল্ম বডি করা উচিত, যার অধীনে ফিল্ম গ্রান্ট অ্যান্ড সাপোর্ট, ফিল্ম কমিশন, সার্টিফিকেশন বোর্ড, ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড সব চলে আসবে। এই সব বোর্ডের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং তাঁদের কাজের নিয়মিত মূল্যায়নের দায়িত্ব থাকা উচিত পরামর্শক কমিটির।’
পরামর্শক কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তাদের আধিক্যের প্রশ্নে পরামর্শক কমিটির সদস্য তানিম নূর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। কোনো কিছু হুট করে পরিবর্তন করা যায় না। আমরাও পরিবর্তন চাইছি। চলচ্চিত্র নীতিমালা অনুযায়ী পরামর্শক কমিটি হয়েছে। ফলে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নীতিমালাও পরিমার্জন, সংশোধন করা দরকার। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে তো সেটা হবে না, তবে রাষ্ট্র কীভাবে তার ভূমিকা রাখবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’
বনিয়াদি সংস্কারের জন্য প্রথমেই হাত দিতে হবে আইনগুলা আর ক্ষমতাকাঠামোয়। সব প্রতিষ্ঠান বা কমিটি থেকে আমলাদের সরিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে সিনেমার অংশীজনদের।কামার আহমাদ সাইমন, নির্মাতা ও প্রযোজক
কমিটি কী করবে
জাতীয় পরামর্শক কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে–চলচ্চিত্র নীতিমালার আলোকে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে পরামর্শ দেওয়া; নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া; চলচ্চিত্র নীতিমালা ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইন, বিধি পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিবর্তনের প্রযোজন হলে তা সুপারিশ করা।
পরামর্শক কমিটির সদস্য নির্মাতা তানিম নূর বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো বৈঠক করিনি। ফলে এখনো কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়নি। এতটুকু বলতে পারি, চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বিশেষ করে ই-টিকেটিং ও বক্স অফিসে জোর দিতে চাই। এগুলো হলে চলচ্চিত্রে স্বচ্ছতা আসবে, চলচ্চিত্র নীতিমালায়ও বিষয়গুলো আছে। চলচ্চিত্রের নীতিমালায় মত ও বাক্স্বাধীনতার পরিপন্থী ধারাগুলো সংশোধন করা উচিত।’
চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বিশেষ করে ই-টিকেটিং ও বক্স অফিসে জোর দিতে চাই।তানিম নূর, নির্মাতা ও সদস্য, চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি
‘চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি’ বিগত সরকারেও ছিল। প্রথম কবে জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়েছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। তবে ২০১৯ সালে কমিটি পুনর্গঠনের খবর এসেছিল। ২৪ সদস্যের সেই কমিটিতে অভিনয়শিল্পী ইনামুল হক, কবরী, সুবর্ণা মুস্তাফা, চলচ্চিত্র প্রদর্শক ইফতেখার উদ্দীন, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজারসহ আরও অনেকে ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিগত সরকারের পরামর্শক কমিটি দৃশ্যমান কোনো কাজ করতে পারেনি। চলচ্চিত্র প্রদর্শক ইফতেখার উদ্দীনও বলেন, পরামর্শক কমিটি সেভাবে কাজ করতে পারেনি। কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া হলেও বিগত সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি।
নতুন এই কমিটি কতটা কার্যকর হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তানিম নূর বলেন, ‘আমি আশাবাদী। দেশে পরিবর্তন এসেছে; চলচ্চিত্রেও সবাই পরিবর্তন চাচ্ছেন। এবার হয়তো পরিবর্তনটা হয়ে যাবে। এটাই সংস্কারের সুযোগ, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করতে হবে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও অংশীজনেরা আমাদের সহযোগিতা করবেন।’