অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর অনেক প্রতিষ্ঠানেই নতুনভাবে শুরুর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন বা বিএফডিসির খবর কী? গতকাল ঘুরে এসে লিখেছেন মনজুর কাদের
আগেই থেকেই এফডিসিতে কমেছে শুটিং। গতকাল সোমবার দুপুরে এফডিসি ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, আজ কোনো শুটিং নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসখানেক ধরে এফডিসিতে কোনো শুটিং হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষে শেখ হাসিনা সরকারের পতন, এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের দুই সপ্তাহ হতে চলছে, তারপরও যেন নিষ্প্রাণ এফডিসি।
ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা আড়াইটা। এফডিসির প্রধান ফটকের দায়িত্বে দুই নিরাপত্তারক্ষী। কথা বলে ঢোকার মুখে কড়ইতলা। অসংখ্য ছবির শুটিং এই কড়ইতলায় হয়েছে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। নিরাপত্তারক্ষী জানালেন, ‘অনেক দিন শুটিং হয় না। আমরা আমাদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছি।’
হাঁটতে হাঁটতে ক্যানটিনের দিকে যেতেই পথে দেখা হয় পরিচালক ও চিত্রসম্পাদক আবু মুসা দেবুর সঙ্গে। পরে ৬ নম্বর ফ্লোরের রূপসজ্জার কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানালেন, দেশে একটা পরিবর্তন এসেছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এফডিসির পরিবেশটাও একটু অন্য রকম। সবাই যেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রযোজক আসতে হবে, শুটিং শুরু করতে হবে।
ক্যানটিনের সামনে কয়েকজন টেকনিশিয়ান দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। নতুন ছবির নিয়ে কথা বলছেন। আলাপে প্রাধান্য ছিল রাজনীতির নানা বিষয়ও। ক্যানটিনের পাশে কক্ষে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ক্যারম খেলায় ব্যস্ত। ক্যারম খেলার পাশাপাশি সেখানেও রাজনীতি নিয়ে আলাপ।
১০ দিনে ছয় ছবি
শেখ হাসিনা সরকার পতনের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। দেশের মানুষ একের পর এক নানা আলোচিত ঘটনার সাক্ষী হচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম ইস্যু ‘আয়নাঘর’, যা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। এই ইস্যু কাজে লাগানোর চেষ্টায় আছেন কয়েকজন পরিচালক ও প্রযোজকও।
একজন জানালেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এ ধরনের ছবির নাম নিবন্ধনের একটা হিড়িক পড়ে। এখন দেখার বিষয়, ছবিগুলো নির্মাণ কবে হচ্ছে, ঠিকঠাকভাবে হচ্ছে কি না। তবে ঘটনাগুলো দেশে ও দেশের বাইরে বেশ আলোচিত, ঠিকঠাকভাবে বানাতে পারলে দারুণ কিছু হতেও পারে। তিনি সবাইকে অনুরোধ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, সবাইকে অনুরোধ করব, হুড়োহুড়ি নয়, প্রপার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যেন ছবিগুলো তৈরি হয়। দর্শকেরা যেন বিনোদনের মাধ্যমে সঠিক খবর জানতে পারেন।
প্রযোজক সমিতিতে সমাগম কম
কড়ইতলা হয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে দিয়ে যেতে যেতে প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সামনে পৌঁছে যাই। দরজা ঠেলে ঢুকতেই ডান পাশের সোফায় কয়েকজন বসে আড্ডা দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগে তাঁদের দেখা গেছে ক্যানটিনেও। সাধারণত প্রযোজকদের পদচারণে মুখর থাকে এফডিসির প্রযোজক সমিতি। দুপুরের পর থেকে আসতে থাকেন অনেক প্রযোজক। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রযোজক আনাগোনা অপেক্ষাকৃত কম। যাঁরা একসময় নিয়মিত আসতেন, তাঁরা এখন অনেকটাই অনিয়মিত। অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে জানা গেল, সবার তো আলাদা ব্যবসা আছে। কেউ ঠিকাদারি করেন। ওদিকে হয়তো ব্যস্ত আছেন।
নবীন-প্রবীণে জমজমাট
পরিচালক সমিতির সামনের চিত্রটা ঠিক যেন উল্টো। প্রযোজক সমিতি কার্যালয় যতটাই সুনসান, পরিচালক সমিতি ততটাই সরগরম। সব বয়সী পরিচালক বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। ঢোকার মুখে দেখা গেল শাহ আলম কিরণকে, সঙ্গে আছেন আবু মুসা দেবু। ভেতরে বসে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত প্রবীণ পরিচালক সাইদুর রহমান। পরিচালক সমিতির সামনে ভালোই ভিড় লক্ষ করা গেছে। জ্যেষ্ঠ পরিচালকেরা যেমন আছেন, আড্ডা দিচ্ছেন, তেমনি অপেক্ষাকৃত নবীন পরিচালকেরা আসছেন। গ্রুপে গ্রুপে আড্ডা দিচ্ছেন। কেউ ভেতরে, কেউ বাইরে বসে। সবার মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা। অনেকে আবার পর্যবেক্ষণ করছেন। কী হচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে দেশের পরিস্থিতি, তা-ই যেন আলোচনায় বিষয়।
পরিচালক সমিতির বাইরে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন গাজী মাহবুব, শাহীন সুমন, কবিরুল ইসলাম, শাহীন কবিরসহ একদল পরিচালক। আড্ডার একপর্যায়ে সেখানে এসে যোগ দেন অভিনয়শিল্পী শিবা সানু। এরপর আড্ডা যেন আরও জমে ওঠে। একেকটা গল্প বলছিলেন, আর সবাই উচ্চ শব্দে হাসছিলেন। এই সময় শিবা শানুর একটা কথা কানে আসে, ‘এটা প্রতিভাবানদের জায়গা, এখানে পেশিশক্তি দেখানোর কিছু নেই। সবাই ছবি বানাবে। সবাই মিলেমিশে কাজ করব।’
আমেরিকার নির্বাচনের খবর দেখি
মাসখানেক ধরে এফডিসিতে কোনো ছবির শুটিং নেই। শুটিং থাকলেই শিল্পীরা প্রায়ই এসে ঢুঁ মারেন শিল্পী সমিতিতে। আড্ডা দেন। সোমবার দুপুর থেকে বিকেলের চিত্র একেবারে ভিন্ন। সমিতির কার্যালয়ে ঢুকতেই দেখা যায়, একজন নারী কর্মচারী বসে খবর দেখছেন। কী দেখছেন, জানতে চাইলে বললেন, ‘আমেরিকার নির্বাচনের খবর দেখি।’ ভেতরে কেউ আছেন কি না, জিজ্ঞেস করতেই বললেন, শিল্পীরা কেউ নেই। তবে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন কর্মচারীদের দুজন। খেতে খেতে জানালেন, আজ কেউ আসেননি। তবে এর মধ্যে জয় চৌধুরী, সুব্রতসহ কয়েকজন এসেছিলেন। সভাপতি মিশা সওদাগর আছেন দেশের বাইরে। আর সাধারণ সম্পাদক ডিপজল সরকার পতনের পর আসেননি।’ বের হতে দেখা অভিনয়শিল্পী জাদু আজাদের সঙ্গে। খুব উচ্ছ্বসিত দেখাল তাঁকে। হাসিখুশি জাদু আজাদ জানালেন, পরিচালক সমিতিতে নতুন ছবির নাম নিবন্ধন করে এলেন। নাম জিজ্ঞেস করতেই হাসতে হাসতে বললেন, ‘হারুনের ভাতের হোটেল। সেই হবে ছবিটা।’
বাইরে একা রেকর্ডিস্ট
এফডিসির ডাবিং স্টুডিওর দিকে যেতে চোখে পড়ল বাইরে চেয়ারে বসে আছেন প্রবীণ একজন। কাছে যেতে দেখা গেল, তিনি সহকারী সাউন্ড রেকর্ডিস্ট বেল্লাল হোসেন খান। প্রবীণ রেকর্ডিস্ট।
কথা প্রসঙ্গে জানালেন, আর মাত্র মাসখানেক আছেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এরপর তিনি অবসরে চলে যাচ্ছেন। কাজের খবর জানতে চাইলে বললেন, ‘২৫ দিন ধরে কোনো ছবির ডাবিং হচ্ছে না। তাই আমার আসলে সেভাবে কোনো কাজ নেই, কিন্তু নিয়ম মেনে আসি। এরপর আবার চলে যাই।’
ঝরনা স্পট ও জটলা
বহু জনপ্রিয় ছবির নাচের ও গানের দৃশ্যধারণ হয়েছে এফডিসির ঝরনা স্পটে। চলচ্চিত্রের পর্দায় আকর্ষণীয় এই ঝরনা স্পটের যেন কোনো জৌলুশ নেই। অনেক দিন ধরে কোনো পরিচর্যা নেই। জমে থাকা বৃষ্টির পানি আর শেওলার কারণে চলার পথটা পিচ্ছিল হয়ে আছে। হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রমও হয়। বের হয়ে এসে সামনেই দেখা গেল একটি জটলা। ১০-১৫ জনের সেই দল শুটিংয়ের নয়। জানা গেল, বিএনপি ঘরানার এফডিসির কর্মচারীদের একটা অংশ সেখানে জটলা পাকিয়ে আছেন। নিজেদের বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ করছেন।
যা বললেন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব দিলীপ কুমার বণিক। দুই সপ্তাহ ধরে তিনি নিয়মিত অফিস করছেন। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি এফডিসির এমডির অপসারণসহ তিন দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সংগঠন। ওই সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন নুজহাত ইয়াসমিন। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করে আসছিলেন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ঘুরতে ঘুরতে প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা হয় নতুন দায়িত্ব নেওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে।
দিলীপ কুমার বণিক বলেন, ‘এটা সত্য, সার্বিকভাবে এখানে সিনেমা কম নির্মাণ হওয়াতে এফডিসির কাজকর্ম অনেকটা কমে গেছে। আমাদের আয় বাড়ানোর জন্য, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সম্পদের সঠিক ব্যবহারে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। বিএফডিসি কমপ্লেক্স হচ্ছে, দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিদর্শন করেছি। এফডিসিকে কর্মসূচি করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। যুগোপযোগী কিছু উদ্যোগ নিচ্ছি। সংশ্লিষ্ট পরিচালক, চিত্রগ্রাহকসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। মিটিং করেছি। আমরাও বলেছি, প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করার আশ্বাস দিচ্ছি।’ কথার শেষ দিকে জানালেন, খুব শিগগির এফডিসির প্রধান ফটক সবার জন্য খুলে দেওয়া হবে।