বেশ কিছুদিন দাম্পত্য টানাপোড়েনে ছিল। দুজন আলাদা ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সত্যি হচ্ছে শঙ্কাটাই; ভেঙে যাচ্ছে চিত্রনায়িকা পরীমনি ও নায়ক শরীফুল রাজের সংসার। ১৮ সেপ্টেম্বর পরীমনি রাজের উদ্দেশে বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠান। নিয়ম অনুযায়ী দুই পক্ষের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া না মিললে তিন মাসের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যাবে। তাঁরা এখন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা।
পরীমনির ফেসবুক প্রোফাইলে এখন আর লেখা নেই ‘ম্যারিড উইথ শরীফুল রাজ’। একই অবস্থা শরীফুল রাজের বেলাতেও। হঠাৎ কী এমন হলো, তাঁদের আলোঝলমলে সংসার তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেল? সবশেষে পরীমনি বলেছেন, ‘আমি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভোর্স দিয়েছি। খুবই স্বাভাবিক নিয়মে। এটাও তাকে আমার একপ্রকার ক্ষমা করে দেওয়া। না হয় আমার সঙ্গে যে অন্যায়গুলো করেছে, তাতে তার জেল হওয়ার কথা।’
নতুন অতিথির আগমন
২০২২ সালের আগস্ট মাসের ১০ তারিখে পুত্রসন্তানের মা-বাবা হন চিত্রনায়িকা পরীমনি ও চিত্রনায়ক শরীফুল রাজ। রাজধানীর একটি হাসপাতালে পুত্রসন্তানের জন্ম দেন পরীমনি। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই নাম ঠিক করে রেখেছিলেন পরীমনি।
চলতি বছরের শুরুতেই পরী জানিয়েছিলেন, কন্যাসন্তান হলে তার নাম রাখবেন রানী আর পুত্রসন্তান হলে রাজ্য। পুত্রসন্তান হলে তার নাম রাজ্য রাখেন।
সম্পর্কে ফাটল
রাজ্যকে নিয়ে বেশ চলছিল রাজ-পরীর সংসার। তবে একসময় শুরু হয় টানাপোড়েন। গত বছরের শেষ দিন অর্থাৎ ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে ফেসবুক পোস্টে পরীমনি লিখেছেন, ‘হ্যাপি থার্টি ফার্স্ট এভরিওয়ান! আমি আজ রাজকে আমার জীবন থেকে ছুটি দিয়ে দিলাম এবং নিজেকেও মুক্ত করলাম একটা অসুস্থ সম্পর্ক থেকে।’
খবর নিয়ে জানা যায়, তার আগে রাত সাড়ে আটটার দিকে সন্তান রাজ্যকে সঙ্গে নিয়ে রাজের বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন পরীমনি। পরীমনির ফেসবুকে দেওয়া এমন পোস্টে ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষী ও বিনোদন অঙ্গনের সবাই নড়েচড়ে বসেন। সবার মনে প্রশ্ন, তাহলে কি ভেঙে যাচ্ছে পরীমনি ও রাজের সংসার? পোস্টের পর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে পরীমনি বলেছিলেন, ‘এখনো বিচ্ছেদ হয়নি। তবে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করে রাজের বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছি। আজ থেকে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। শিগগির বিচ্ছেদের চিঠি পাঠিয়ে দেব। বেশ কিছুদিন ধরেই সমস্যা হচ্ছিল। সমস্যা কাটিয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি, পারলাম না। তাঁর আচার-আচরণ একসঙ্গে থাকার পরিস্থিতি নাই। তাই বাধ্য হয়ে বাসা ছেড়ে আলাদা হয়ে গেলাম।’
শুরুটা সুন্দর
হাতে ফুল। মুখে মাস্ক। হুইলচেয়ারে বসা পরীমনি। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। পেছন থেকে হুইলচেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন চিত্রনায়ক শরীফুল রাজ। তাঁর মুখেও মাস্ক। এমন একটি স্থিরচিত্র নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছিলেন শরীফুল রাজ। ক্যাপশনে লেখা, ‘কনগ্র্যাচুলেশন রাজ, থ্যাংক ইউ পরী।’
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখে এভাবেই নিজেদের সম্পর্কের জানান দিয়েছিলেন রাজ-পরী। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পরীমনি জানান, ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর তাঁরা বিয়ে করেছেন। প্রেম হওয়ার ঠিক সাত দিনের মাথায় এমন সিদ্ধান্ত নেন। পরীমনি বলেন, ‘প্রথমে দুই পরিবারকেই আমরা দুজন জানিয়েছিলাম। এরপর পারিবারিকভাবে রাজের আফতাবনগরের বাসায় বিয়ে হয় আমাদের।’ পরীমনি আরও বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে মিশতে গিয়ে দেখলাম, আমরা দুজনই পাগল। দুজনই ভাবলাম, আমাদের সারা জীবন একসঙ্গে থাকা উচিত। তাই কোনো কিছু না ভেবেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিই আমরা।’
অবস্থা এমন হয় যে পরীমনি ও শরীফুল রাজ দুজনের ফেসবুক পোস্টের পড়লে মনে হতো দুজন এখন দুজনের নামটিও শুনতে পারছেন না। প্রথমে অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিমের সঙ্গে রাজকে জড়িয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন পরীমনি। তাঁদের দুজনের দীর্ঘ ফোনালাপ নিয়ে অনেক কথা বলেন।
তখন পরীমনি ও শরীফুল রাজ দুজনের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরেছে কয়েক মাস আগে। সন্তান পৃথিবীতে আসার পরও কয়েক মাস ভালো ছিলেন। এরপর টুকটাক কথা-কাটাকাটি হতো। তারপর সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ার কারণে দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। দুজনের প্রতি অবিশ্বাসও তৈরি হয়। সন্দেহ করা শুরু করেন একে অপরকে। তারপরও বারবার চেষ্টা চলে সম্পর্ক চালিয়ে নেওয়ার। কিন্তু একেবারেই যখন সম্ভব হচ্ছিল না, তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, এই ধরনের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার চেয়ে আলাদা থাকা ভালো।
প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পরীমনি বলেছিলেন, ‘“দামাল” ছবির মুক্তির সময় থেকেই আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক যাচ্ছিল না। রাজ আগের মতো নিয়মিত বাসায় থাকত না। সন্তানের প্রতিও তার সে ধরনের দায়িত্ব চোখে পড়েনি।’
ভিডিও ও ছবি ঘিরে সংকট তীব্র
চিত্রনায়ক শরীফুল রাজের ফেসবুক থেকে অভিনেত্রী তানজিন তিশা, নাজিফা তুষি ও সুনেরাহ বিনতে কামালের কিছু ছবি ও ভিডিও ক্লিপস ফাঁস হয়। চলতি বছরের ২৯ মে দিবাগত রাতে এসব ছবি ও ভিডিও ফাঁস হয়। সেখানে অভিনেত্রী সুনেরাহ বিনতে কামালের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাজের সঙ্গে সুনেরাহর বন্ধুত্বপূর্ণ ও ‘অসংলগ্ন’ কিছু আলাপচারিতা চলছে। সেগুলো রাজের ফেসবুক থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে শুরু হয়েছে সমালোচনা। এই ঘটনার পর রাজ-পরীর সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও তীব্র হয়। সে সময় যোগাযোগ করা হলে পরীমনি দাবি করেন, দিন পনেরো আগে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন রাজ। বিচ্ছেদের ‘গুজব’ প্রসঙ্গে পরীমনি বলেন, ‘আমি চাই, সে আমাকে তালাক দিয়ে দিক। আমি ওর প্রাক্তন, এটাই শুনতে আমার আরাম লাগবে। আমি রাজের বউ, এটি আর শুনতে চাই না।’ অন্যদিকে রাজের ভাষ্য ছিল এমন, তাঁরা আপাতত সেপারেশনে আছেন। বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার ভাববেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে রাজ জানান, সেটার আর কোনো সুযোগ নেই। এখন নিজেকে সময় দেবেন বলে জানান রাজ।
এবং ডিভোর্স নোটিশ
গত ১০ আগস্ট ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে কাছের মানুষদের নিয়ে একমাত্র সন্তানের প্রথম জন্মদিন উদ্যাপন করেন চিত্রনায়িকা মা পরীমনি। রাজ্যর প্রথম জন্মদিনের আয়োজনেও দেখা যায়নি চিত্রনায়ক বাবা শরীফুল রাজকে। পরে গান বাংলা চ্যানেলের দুই কর্ণধার কৌশিক হোসেন তাপস ও ফারজানা মুন্নী দম্পতি তাঁদের কার্যালয়ে পরীমনি ও রাজের সন্তান রাজ্যর জন্মদিন উদ্যাপন করতে কেক কাটেন। তার আগেই বসুন্ধরার বাসা থেকে পরীমনি সন্তানসহ সেখানে যান। অন্যদিকে শরীফুল রাজও যান সেখানে। দুজনের সেখানেই দেখা হয়। এরপর রাজ্যকে নিয়ে কেক কাটেন উপস্থিত সবাই। গভীর রাতে গান বাংলা কার্যালয় থেকে তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। এর মধ্যে রাজ পরীমনির বাসায় গেলেও আবার বেরিয়ে যান। সম্পর্কের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সবশেষ দুজনকে একসঙ্গে দেখা গেছে ৮ সেপ্টেম্বর মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠানে। সন্তানকে কোলে নিয়ে অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে রাজ-পরী কিছুক্ষণের জন্য পাশাপাশি বসে ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন পরীমনি। ১৮ সেপ্টেম্বর পরীমনি রাজের উদ্দেশে বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠান। তাঁর পারিবারিক একটি সূত্র খবরটি নিশ্চিত করেছে। ডিভোর্সের ব্যাপারটি নিশ্চিত করে গতকাল বুধবার সন্ধ্যার পর প্রথম আলোকে কাজি আবু সাইদ বলেন, ‘১৬ সেপ্টেম্বর আমাদের সঙ্গে পরীর পক্ষের লোকজন যোগাযোগ করেন। লেটারে উল্লিখিত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর পরীমনির আইনজীবীর গুলশান অফিসে ডিভোর্স হয়েছে। সেখান আমার সহকারী আলী আশরাফ উপস্থিত ছিলেন। পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর উত্তর বাড্ডার আলীর মোড়ে, সাতারকুল রোডের আমার অফিস থেকে ডিভোর্স লেটার রেজিস্ট্রি করা হয়। এরপর ওই দিনই দুপুর ১২টার দিকে রাজের গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী তিন মাস পরপর পাঠানো হবে এই চিঠি। যদি রাজ এই চিঠি গ্রহণ না করেন, তাহলে ৯০ দিন পর তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। আর যদি তিন মাসের মধ্যে তাঁদের আবার বনিবনা হয়, নিজেদের মধ্যে একটা সমাধান হয়, তাহলে আবারও তাঁরা সংসার করতে পারবেন।’
গতকাল সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এ নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করলেন পরীমনি। লিখেছেন একটি পোস্ট। তাতে তিনি বলেছেন, রাজ তাঁর সঙ্গে যে অন্যায়গুলো করেছেন, তাতে তাঁর জেল হওয়ার কথা। পরীমনি লিখেছেন, ‘আমার ছেলের যাবতীয় খরচ—মানে ভরণপোষণ থেকে শুরু করে আগামী দিনে পড়াশোনা, যা কিছু আছে সবই আমি বহন করব। এত দিন যেভাবে করেছি। বাচ্চার ফুল অভিভাবকত্ব এখন তার মায়ের। এ বিষয়ে যা কিছু বলার আমার আইনজীবীরা বলবেন।’
পরীমনির বিচ্ছেদের নোটিশ নিয়ে শরীফুল রাজ জানান তিনি নোটিশ আমি গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যা হওয়ার হবে। উইথ ডিউ রেস্পেক্ট, এই সময়ের মধ্যে যা হবে, সেটাই আমি মেনে নেব। পরীর সিদ্ধান্তের সঙ্গে থাকতে চাই। তাঁর সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করছি। আমাদের তো আসলে অনেক দিন ধরেই সমস্যা হচ্ছিল। আজ হোক বা কাল, সম্পর্কটা হয়তো টিকত না। বিয়ের কিছুদিন পরই আমাদের মধ্যে সমস্যা শুরু হয়। আমার মনে হয়, দুজনেরই বোঝাপড়ার বিরাট সমস্যা আছে। থ্যাংকস যে আমরা দুজনই এটা বুঝতে পেরেছি। এখন পরী যে পদক্ষেপটা নিয়েছে, সেটার সঙ্গে আমি আন্তরিকভাবে একাত্মতা পোষণ করছি।