১৯৯৭ সালের ঘটনা। সালমান শাহর মৃত্যুর পর রিয়াজ ও শাবনূরকে জুটি করে মতিন রহমান নির্মাণ করেন মন মানেনা। মুক্তির পর দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহের একটি হলে গেলেন পরিচালক। হলে হাজারো মানুষের ভিড়। বাড়তি আসন দিয়েও কুলানো যাচ্ছে না। স্বপ্নের নায়ক-নায়িকার কাছে পেয়ে দর্শকের উন্মাদনার শেষ নেই। সেদিনের ভিড়ে আহত হয়েছিলেন পরিচালক নিজেই। সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করে মতিন রহমান বলেন, ‘সেই দিন টানা শো চলছিল। একটি শেষ, তো আরেকটি শো। এমন সময় আমরা দর্শকের সঙ্গে কথা বলে বের হচ্ছিলাম। এত মানুষ! প্রশাসন ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছিল। ভিড় ঠেলে শাবনূরকে গাড়ির পেছনে সিটে বসিয়ে সামনে ওঠার জন্য যাচ্ছি। ওই সময় আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে গাড়ি। আমার এক পায়ের কিছু অংশ চাকার নিচে পড়ে যায়। আহত হই।’
এই পরিচালক মনে করেন ছবির প্রচারণায় ঢাকার বাইরে গেলে দর্শকেরা কাছ থেকে প্রিয় তারকাকে দেখার সুযোগ পান। পুরো অঞ্চলে সাড়া পড়ে যায়। দর্শক সিনেমাটি দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
ঢাকার বাইরে প্রচারে গিয়ে একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল আরেক পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানেরও। ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মুক্তির দিন বরিশালে অভিরুচি সিনেমা হলে পরিচালক ছবির নায়ক–নায়িকা সালমান শাহ ও মৌসুমিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরিচালক বলেন, ‘সেদিন মনে হয় এক লাখ মানুষ হয়েছিল। ভিড়ের মধ্যে যেন আমরা হারিয়েই যাচ্ছিলাম। আমাদের যাওয়ার পর থেকেই ওই হলে অনেক দিন হাউসফুল ছিল ছবিটি।’
এই পরিচালকের মতে, মফস্সল শহর, শহরতলি বা গ্রাম পর্যায়ের দর্শকদের প্রিয় নায়ক-নায়িকাদের সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয় না। এ ধরনের সফরে সিনেমার প্রচার বাড়ে।
একটা সময় ছবি মুক্তির পর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের সফরের রীতি ছিল। মাঝে সেটা যেন অনেকটা হারিয়ে গিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেটা আবারও ফিরে আসছে। কয়েক বছর ধরে চলা সিনেমার মন্দা কাটাতে প্রচারে জোর দিচ্ছেন তাঁরা। যাচ্ছেন দেশের নানা প্রান্তের বিভাগীয় বা জেলা শহরে। দর্শকের সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁদের সঙ্গে বসে সিনেমা দেখছেন। তারকাদের উপস্থিতির খবরে দূরদূরান্তের উপজেলা শহর, এমনকি গ্রাম থেকেও দর্শক ছুটে আসছেন হলে।
গত ঈদুল ফিতর থেকে সিনেমার প্রচারে তারকাদের নিয়মিত ঢাকার বাইরে যেতে দেখা যাচ্ছে। ওই সময় মুক্তি পাওয়া শান ছবির নায়ক-নায়িকা ও পরিচালক নারায়ণগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সফর করেছিলেন। এরপর মুক্তি পাওয়া তালাশ ছবির টিম হেলিকপ্টারে বগুড়ার বিভিন্ন হলে সফর করেছেন।
গত ঈদুল আজহায় ঢাকার বাইরে তারকারদের প্রচারণা আরও জোরদার হয়েছে। ‘সাইকো’ ও ‘পরাণ’ এবং পরে মুক্তি পাওয়া হাওয়া সিনেমার শিল্পীদের যেন সফরের ধুম পড়েছে। ‘সাইকো’র পরিচালক ও নায়ক–নায়িকা খুলনা, ময়মনসিংহ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ঘুরেছেন। ছবির পরিচালক অনন্য মামুন মনে করেন, ছবি মুক্তির পর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ছবির তারকাদের সফর করাটা সিনেমার জন্য ইতিবাচক। তিনি বলেন, ‘ছবি মুক্তির পর তারকাদের সফরের আগে থেকেই হল কর্তৃপক্ষ মাইকিং করে। দর্শকেরা তারকাদের সামনাসামনি দেখতে চান। সিনেমা দেখেন না, এমন দর্শকও খবর পেয়ে তখন হলে ছুটে আসেন। তাঁদের কাছ থেকে আরও ১০ জন ছবির খবর জানতে পারেন। মুখে মুখে খবর আরও ছড়ায়। এতে সিনেমায় দর্শক তৈরি হয়। পাশাপাশি নায়ক-নায়িকাদেরও নতুন ভক্ত তৈরি হয়।’
এই পরিচালক মনে করেন, নিয়মিত তারকারা যদি জেলাগুলো সফর করেন তাহলে সিনেমার দর্শকখরা অনেকটাই কেটে যেতে পারে।
এদিকে পরাণ ছবিরও শিল্পীরা মুক্তির পর থেকেই বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন। আগে ময়মনসিংহের পূরবী হলে গিয়েছিলেন। এরপর সিলেটে। সেখানে সিনেমা হলসহ কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছবিটির প্রচারণা চালিয়েছেন। ছবির পরিচালক রায়হান রাফি বলেন, ‘আমরা যেদিন পূরবী হলে গেলাম, বিশ্বাস করেন, এত এত দর্শকের সমাগম হয়েছিল, বাড়তি সিট হিসেবে বেঞ্চে বসে মানুষ সিনেমা দেখেছেন।
আমরা যদি না যেতাম, এত দর্শক কিন্তু হতো না। প্রিয় তারকাকে সামনাসামনি দেখতে হলে ছুটে এসেছেন অনেক দর্শক। যাঁরা ছবিটির খবর জানতেন না, তাঁরাও জেনেছেন। এটি ছবির জন্য লাভ। সিনেমা মুক্তির পর শিল্পীরা ঢাকার বাইরে জেলায় জেলায় সফর করলে, প্রযুক্তির কল্যাণে সেখান থেকে গ্রামের দর্শকও খবর পেয়ে যান। গ্রাম থেকে শহরে এসে সিনেমা দেখার সেই অতীত আবার ফিরে আসবে।’
‘হাওয়া’র শিল্পীরা খুলনা, যশোর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ সফর করেছেন। এরপর সিলেট, চট্টগ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁরা হলে হলে দর্শকের সঙ্গে কথা বলছেন, ছবি তুলছেন। ওই সব জায়গায় একটা অন্য রকম আমেজ তৈরি হচ্ছে সিনেমাটিকে ঘিরে। ছবির পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন বলেন, ‘ছবির তারকারা হলে হলে যাচ্ছেন, দর্শকের সঙ্গে কথা বলছেন, পরিচিত হচ্ছেন, এটি দর্শকের মধ্যে সিনেমা নিয়ে কৌতূহল জাগাচ্ছে। শিল্পীদের উপস্থিতিতে নতুন দর্শক আসছেন। এই চর্চাটা অব্যবহৃত থাকলে সিনেমার দর্শক বাড়বে।’
এর আগে দেবী মুক্তির পর সিনেমার পাত্রপাত্রীরা গিয়েছিলেন ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলায়। পরিচালক অনম বিশ্বাস বলেন, ‘সফরের এই রীতিটা ভালো। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের ঢাকার বাইরে সফর করা উচিত। এতে দর্শকের সঙ্গে ছবির শিল্পীরা সরাসরি কানেক্ট হতে পারেন। দর্শকেরাও খুশি হন।’