‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির নাম শোনেনি বা দেখেনি, বাংলা চলচ্চিত্রের এমন দর্শক খুব কমই আছে। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির যে ৪/৫টি ছবির নাম যদি বলতে হয়, তার মধ্যে অবশ্যই ‘ছুটির ঘণ্টা’ নামটিও থাকে। গত শতকের আশির দশকে অনেক দর্শকের প্রিয় চলচ্চিত্রের তালিকায় ছিল ‘ছুটির ঘণ্টা’।
কী মর্মান্তিক গল্প! ঈদের ছুটি ঘোষণার দিন স্কুলের বাথরুমে সবার অজান্তে তালাবদ্ধ হয়ে আটকে পড়ে একটি ১২ বছর বয়সের ছাত্র। আর তালাবদ্ধ বাথরুমে ১১ দিনের ছুটি শেষ হওয়ার প্রতীক্ষার মধ্যে দিয়ে হৃদয়বিদারক নানা ঘটনা ঘটে। অমানবিক কষ্ট সহ্য করার পর কীভাবে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, এমনই একটি করুণ ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে ছবিতে। প্রথমে স্কুলে আনা টিফিন, পরে কিছুদিন শুধু পানি পান করে বেঁচে ছিল সে। আটকে পড়া দিনগুলোতে নিজের অনুভূতিগুলো দেয়ালে লিখে রেখেছিল। শেষে শিশুটির জীবনে বাজে ‘ছুটির ঘণ্টা’। ঈদের ছুটি শেষে স্কুল খোলে। উদ্ধার হয় ছেলেটির মরদেহ। স্কুলের দপ্তরি আব্বাস মিয়া স্বেচ্ছায় এই মৃত্যুর দায় নিজের কাঁধে নিয়ে জেলে যান।
১৯৮০ সালে নির্মিত হয় ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবিটি। প্রযোজনা করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক সত্য সাহা। পরিচালক আজিজুর রহমান। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক, শওকত আকবর, খান আতাউর রহমান, শাবানা, সুজাতা, এ টি এম শামসুজ্জামান, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, শিশুশিল্পী সুমন। ছবির ‘একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাব’ আর ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ গানগুলো তখন দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
অনেকেই জানেন, ওই সময় বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বেদনাদায়ক সত্য ঘটনা চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছিল, যা পরে আরও বেশি মানুষের মনে নাড়া দিয়েছিল। আজও ছবিটির কথা উঠলে দর্শকদের মন নাড়া দিয়ে ওঠে। জীবনকালে সেই গল্প বলেছেন পরিচালক আজিজুর রহমান।
২০১৮ সালে পরিচালক আজিজুর রহমান প্রথমআলোকে জানিয়েছিলেন, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে, ফতেহাবাদ গ্রামে একটি পুকুরপাড়ে ‘অশিক্ষিত’ ছবির শুটিং করছিলেন। ওই সময় ঢাকায় জাপান এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাই হয়। ফলে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বললেন, ‘টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন মোবাইল দূরে থাক, ল্যান্ডফোনও এত সহজলভ্য ছিল না। প্রোডাকশন ম্যানেজারকে বললাম, শহর থেকে কয়েকটি পত্রিকা নিয়ে আসতে। দুপুরে বাংলার বাণী পত্রিকা হাতে আসে। পড়তে পড়তে ভেতরের পাতায় একটি খবরে চোখ আটকে যায়— “একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা”। নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলের ছাত্র ছুটির আগে বাথরুমে আটকা পড়েছিল। খবরটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। কীভাবে সে বেঁচে ছিল, সেই ঘটনাগুলোও দেয়ালে ছেলেটি লিখে গিয়েছিল!’
তিনি জানান, প্রথমেই গল্পটি নিয়ে একটি ছবি বানানোর ভাবনা মাথায় আসে। ওই দিন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করেন। কিন্তু খুব একটা উৎসাহ দেয়নি কেউ। পরে ঢাকা ফিরে যোগাযোগ করেন নানা দিকে। এই গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণের জন্য প্রযোজক মিলছিল না। ওই সময় ১০ জনের বেশি প্রযোজকের কাছে তিনি গিয়েছেন। সবার একই কথা, একটি স্কুলছাত্র বাথরুমে মারা গেছে, সেখানে কী দেখানোর আছে। তা ছাড়া তখন নায়ক আর নায়িকাপ্রধান ছবির প্রাধান্য ছিল। এ গল্পে তো নায়িকা রাখার সুযোগ নেই।
শাবানাকে নিয়ে ধোলাইখালের সুইপারপট্টিতেও গিয়েছিলেন পরিচালক। তাদের পরিবেশ, আচার-আচরণ, পোশাক, চলাফেরা কাছ থেকে দেখেছেন শাবানা আর আজিজুর রহমান।
আজিজুর রহমান বলেন, ‘নিরুপায় হয়ে আবার সত্যদাকে (সত্য সাহা) ধরলাম। বোঝালাম। “অশিক্ষিত” ছবিতে তো তিন-চার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। আমার এই ছবির জন্য পাঁচ সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করুন। একটা রিস্ক নিন। আমার আগ্রহ দেখে তিনি রাজি হলেন।’
ছবিটির সংলাপ লিখেছেন মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান। স্কুলের ঘণ্টাবাদক হিসেবে ঠিক হলো নায়ক রাজ্জাক। কিন্তু ওই প্রশ্নটা থেকেই যায়, নায়িকার কী হবে। একদিন কাকতালীয়ভাবে নায়িকার চরিত্রটি গল্পে যুক্ত হয়। তখন কাকরাইলে ফিল্মপাড়া ছিল। একদিন পরিচালক আজিজুর রহমান তাঁর কাকরাইলের অফিসের দরজা খুলে দেখতে পান, এক মহিলা অফিসের টেবিলের ওপর বসে সিগারেট ফুঁকছে। মহিলা জানালেন, তিনি সুইপারের স্ত্রী, স্বামীর জ্বর হয়েছে, তাই সে ঝাড়ু দিতে এসেছে। আজিজুর রহমান বলেন, ‘ওই দৃশ্য দেখে মাথায় নায়িকা আইডিয়া আসে। নায়িকা হবে স্কুলের ঝাড়ুদারনি। সেই চরিত্রে অভিনেত্রী খুঁজতে খুঁজতে মনে হলো, শাবানাই যথাযথ।’
ওই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শাবানাকে নিয়ে ধোলাইখালের সুইপারপট্টিতেও গিয়েছিলেন পরিচালক। তাদের পরিবেশ, আচার-আচরণ, পোশাক, চলাফেরা কাছ থেকে দেখেছেন শাবানা আর আজিজুর রহমান।
ছবির শুটিং হয়েছিল কাপ্তাই এলাকায়। সেখানকার একটি রেস্ট হাউসকে ছাত্রের বাড়ি বানানো হয়। রেস্ট হাউসের জানালা থেকে স্কুল দেখা যায়। ফলে সেখান থেকে স্কুলের ছবি নেওয়া হলো। আবার স্কুল থেকে বাড়ির দৃশ্যও ধারণ করা হলো।
ছবির শুটিং হয়েছিল কাপ্তাই এলাকায়। সেখানকার একটি রেস্ট হাউসকে ছাত্রের বাড়ি বানানো হয়। রেস্ট হাউসের জানালা থেকে স্কুল দেখা যায়। ফলে সেখান থেকে স্কুলের ছবি নেওয়া হলো। আবার স্কুল থেকে বাড়ির দৃশ্যও ধারণ করা হলো। এফডিসিতে সেট বানিয়ে ঘরের ভেতরের অংশ ধারণ করা হয়। বাথরুমের ভেতরের অংশের চিত্র ধারণ করা হলো।
ছাড়পত্র পাওয়ার পর নতুন সংকট দেখা দেয়। কোনো সিনেমা হল ছবিটি নিতে চায় না। শেষে মাত্র ২০টি হলে মুক্তি পায় ‘ছুটির ঘণ্টা’। এরপর সারা দেশে কোথাও চার-পাঁচ সপ্তাহ, কোথাও এক-দুই থেকে পাঁচ মাসও ছবিটি চলেছে।
তবে ঝামেলা হয়েছিল চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে। বোর্ড আটকে দিল। তাদের যুক্তি, এই ছবি দেখলে কোমলমতি শিশুরা ভয় পাবে, তাদের ওপর বাজে প্রভাব পড়বে। আজিজুর রহমান বিপদে পড়ে যান। তিনি বুদ্ধি বের করলেন। ছবির একটা বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেখানে বেশির ভাগ শিশুকে বাবা-মাসহ আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু ছবি শেষে দেখা গেল, শিশুরা ভয় তো পেলই না, উল্টো চোখ মুছতে মুছতে হল থেকে বের হচ্ছে, এমনকি অভিভাবকেরাও। বাচ্চারা জানায়, তারা মোটেও ভয় পায়নি। এরপর এই ছবির মুক্তিতে আর কোনো বাধা থাকল না। ১৯৮০ সালে ‘ছুটির ঘণ্টা’ মুক্তি দেওয়া হলো।
ছাড়পত্র পাওয়ার পর নতুন সংকট দেখা দেয়। কোনো সিনেমা হল ছবিটি নিতে চায় না। শেষে মাত্র ২০টি হলে মুক্তি পায় ‘ছুটির ঘণ্টা’। এরপর সারা দেশে কোথাও চার-পাঁচ সপ্তাহ, কোথাও এক-দুই থেকে পাঁচ মাসও ছবিটি চলেছে।
অনেক ঘটনা ঘটে ছবি মুক্তির পর। দিনাজপুরের মডার্ন হলে ম্যাটিনি শোতে এক মহিলা ছবি দেখতে দেখতে আবেগে কোলের শিশুসন্তানকেই চাপ দিয়ে মেরে ফেলেছেন! রাজধানীর পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রেক্ষাগৃহ আজাদের কর্মী চান মিয়া স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘মুক্তির কিছুদিন পর ছবিটি উঠিয়েছিলাম। টানা কয়েক মাস চলেছে। একদিনের কথা মনে আছে, এক শোতে “ছুটির ঘণ্টা” দেখতে আসা হলের সব দর্শকই ছিলেন নারী।’
(পুনঃ প্রকাশিত, আংশিক সম্পাদিত )