‘মুজিব আমার পিতা’র আগেও কয়েকটি টিভি নাটক ও প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন সোহেল মোহাম্মদ রানা। রাইট টু ওয়াটার প্রামাণ্যচিত্রের জন্য পেয়েছেন বার্লিন আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের গ্রিন ফিল্ম পুরস্কার, ইতালির রিভার ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ইস্তাম্বুলের কিসাকেস চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা তথ্যচিত্র পুরস্কার। কিন্তু অ্যানিমেশন ছবি, তাও আবার পূর্ণদৈর্ঘ্য? ‘অ্যানিমেশন এই প্রথম। শুধু আমিই না, আমাদের টিমের সবার জন্যই প্রথম’, কবুল করলেন রানা। মাধ্যমটাই আলাদা। দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) অ্যানিমেশন। দেশের প্রেক্ষাপটে যা নতুন। লাইভ অ্যাকশন সিনেমার সঙ্গে অ্যানিমেশন ছবির পরিচালকের কাজের ফারাকও আকাশপাতাল। পরিচালককে এখানে ছবি আঁকতে জানতে হবে। চিত্রকর্ম বোঝার ক্ষমতা থাকতে হবে। রেশিও বুঝতে হবে, চিত্রকর্মের লাইট শেডিং বুঝতে হবে। সব মিলিয়ে মুজিব আমার পিতা সম্পূর্ণ নতুন একটা জগৎ।
সিনেমাটির প্রডাকশন ডিজাইনার ইব্রাহিম খলিলের কাছ থেকে সেই নতুন জগতে প্রবেশের শুরুর গল্পটা শোনা যাক, ‘২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে প্রোলেন্সার স্টুডিও। একসময় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, সিনেমা বানাব। তবে সেটা হবে অ্যানিমেশন। ছবির বিষয় কী হবে? একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শেখ মুজিব আমার পিতা বইটি আনলেন রানা। বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলা, বেড়ে ওঠা এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার গল্প। প্রস্তাব করলেন এটা নিয়েই কাজ করা যাক।’
কিন্তু অ্যানিমেশন সিনেমা যে বানাবেন এত অ্যানিমেটর কই? রানা-খলিলের একটা সুবিধা হচ্ছে, দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার শিক্ষার্থী। ফলে আঁকিয়েদের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত ওঠাবসা। এঁদের দিয়েই অ্যানিমেটরের কাজ করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর শুরু হয় ওয়ার্কশপ। রানা-খলিলই প্রশিক্ষক। পাশাপাশি চলতে থাকে স্ক্রিপ্ট তৈরির কাজ।
২০২০ সালের মার্চ নাগাদ টিম প্রস্তুত হয়ে যায়। এবার তো কাজ দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। খলিল বলেন, অ্যানিমেশনে একটা চরিত্র কোন গতিতে কতটুকু এগিয়ে যাবে বা পেছাবে বা মাথা ঘোরাবে, সবকিছুর জন্য একটা রেফারেন্স দরকার হয়, যার ওপর ভিত্তি করে অ্যানিমেটর, ব্যাকগ্রাউন্ড যাঁরা আঁকছেন, যাঁরা লাইট করছেন, যাঁরা কালার করছেন, তাঁরা কাজ করেন। তাঁদের জন্য তাই মোটামুটি পুরো সিনেমাই কলাকুশলী নিয়ে আগে আমাদের লাইভ শুট করতে হয়েছে।
অ্যানিমেটর আরিফ সিদ্দিকী নিটল জানালেন, ‘এত বড় পরিসরে কাজের অভিজ্ঞতা আমাদের এই প্রথম। ফলে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি আমরা।’ ছবির লাইট শেডিং এবং কালারের কাজ করেছেন মনিরা আলম আশা। তিনি বলেন, বারবার আঁকতে হয়েছে, ফেলতে হয়েছে অনেক ফ্রেম। ছবির জন্য প্রায় ৩০ হাজার ফ্রেম এঁকেছেন অ্যানিমেটরা, বাদ দেওয়া ফ্রেমের তো কোনো হিসাবই নেই। সেগুলোয় রং বসাতে হয়েছে। ফ্রেম ধরে ধরে লাইট করতে হয়েছে।
এই কাজের কারিগরি দিক আরেকটু খোলাসা করলেন খলিল। অ্যানিমেটররা লাইন ড্রয়িং করেন, সেটাতে রং বসাতে হয়। প্রতিটি শটের জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করতে হয়। একদল শিল্পী থাকেন, যাঁরা ক্যারেক্টার ডিজাইন করেন। আরেক দল থাকেন যাঁরা লাইট নিয়ে কাজ করেন। চরিত্রগুলোর আদল তৈরি করেন ক্যারেক্টার ডিজাইনার। সেটা ধরে অ্যানিমেটররা লাইন ড্রইং করেন। সেটা একটা খসড়া কাজ। আরেক দল সেটা ক্লিনআপ করেন। আরেক দল আবার ব্যাকগ্রাউন্ড আঁকেন। এরপর আরেক দল লাইট এবং কালারের কাজ করেন। সবশেষে যায় কম্পোজিটরের কাছে। তিনি অ্যানিমেটেড চিত্র এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিলিয়ে দৃশ্যটা জীবন্ত করে তোলেন।
আর একা এই কম্পোজিটিংয়ের কাজটা করেছেন রানা। সিনেমার সংগীতভাবনাও তাঁর। তিনি বলেন, ‘মিউজিক নিয়ে আমার যেহেতু আগে থেকেই আগ্রহ ছিল, তাই কাজটা সহজ ছিল।’ ছবিতে তিনটা গান আছে। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন রাজু আহমেদ, মেহবুবা মিনহাজ, তাহসিনা ফেরদৌস, হিন্দোল রায় ও আনিরা মিশেল।
এরপর? রানা বলেন, ‘এর মাঝেই আসে করোনা। কাজের গতি কমে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা শেষ করতে পেরেছি। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ তরুণের পরিশ্রমের ফসল এই সিনেমা।’ মুজিব আমার পিতা দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। কোনো বিদেশি সহযোগিতা ছাড়াই সম্পূর্ণ দেশেই তৈরি হলো বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন ছবি। ২৮ সেপ্টেম্বর প্রিমিয়ার হলো সেই ছবি। আর দর্শকেরা আজ থেকে দেশজুড়ে সিনেমা হলগুলোয় ছবিটি দেখতে পারবেন।