জার্মানির বার্লিন, সুইজারল্যান্ডের লোকার্নো, কানাডার টরন্টোসহ বিশ্বের দামি সব চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছেন পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন। এসব উৎসবে গিয়ে তিনি দেখেছেন চলচ্চিত্রে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প। কিন্তু প্রায়ই রুবাইয়াতকে শুনতে হয়েছে এমন প্রশ্ন, ‘আপনাদের দেশে কি আর কোনো নারী নির্মাতা নেই? আর কেউ ছবি বানাতে পারে না?’ তখন এই পরিচালকের মনে হয়েছে, দেশের নারীদের জন্য কিছু করা দরকার। তাঁদের এগিয়ে নেওয়ার ভাবনা থেকেই রুবাইয়াত হাতে নিয়েছেন ‘সুলতানাস ড্রিম প্রজেক্ট’।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুলতানার স্বপ্ন’ থেকে নামটি নিয়েছেন রুবাইয়াত। এ প্রকল্পের আওতায় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য তহবিল দিতে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। যার শিরোনাম ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’। এ আয়োজনে দেশের ১৬ তরুণ নারী নির্মাতা অংশ নেবেন। তাঁদের বাছাই করা হয়েছে দেড় শ জনের ভেতর থেকে। গত শুক্রবার নির্বাচিত নির্মাতাদের নিয়ে শুরু হয়েছে কর্মশালা। সেখানে নেতৃত্ব, সম্পাদনা, চিত্রগ্রহণ, শব্দ, চিত্রনাট্য, প্রযোজনা পরিকল্পনা, প্রযোজকদের সামনে কীভাবে প্রকল্প উপস্থাপন করতে হয় ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত শেখানো হবে।
রুবাইয়াত বলেন, ‘একটা সময় ছিল, নারীরা এ পেশায় আসতে চাইতেন না। কিন্তু এখন শিক্ষাসহ বিভিন্ন পেশায় এগিয়ে যাচ্ছেন মেয়েরা। কিন্তু সিনেমা নিয়ে তাঁদের পড়াশোনার সুযোগ কম। সুযোগ থাকলেও মেয়েরা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারেন না। এখনো মেয়েদের জন্য ঢাকার বাইরে শুটিংয়ে যাওয়া কঠিন। দ্বারে দ্বারে মেয়েদের প্রতিবন্ধকতা। এসব আমি দেখেছি। সিনেমা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাকেও বিভিন্ন কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গনে নারীরা এখন নির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, এগিয়ে যাচ্ছে দেশের নির্মাতারা। সেখানে কোনো নারী ছিলেন না। এই ব্যবধান ঘোচাতে চাই। কর্মশালার মধ্য দিয়ে নারীদের এগিয়ে নিতেই উদ্যোগটি নিয়েছি।’
এ আয়োজনে তরুণ নারী নির্মাতাদের শেখাবেন ভেনিস, বার্লিনসহ বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেওয়া সিনেমার নির্মাতা ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষেরা। পাকিস্তানি পরিচালক সিমাব গুল। তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র স্যান্ডস্ট্রম ভেনিস, সানড্যান্সসহ একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছে। ডার্লিং স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা দিয়ে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন সায়েম সাদিক। তাঁরা দুজনই অনলাইনে কর্মশালা করাবেন। এ ছাড়া জোনাকি ভট্টাচার্য্য, নাহিদ মাসুদ, বরকত হোসেন, মেহেদী হাসান, তাসমিয়াহ্ আফরীনসহ দেশ-বিদেশের আরও অনেকেই অংশ নেবেন এবং তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে থাকবেন।
রুবাইয়াত বলেন, ‘১৬ জনকে বাছাই করা হয়েছে। তাঁদের ভেতর থেকে দুজন পাবেন চলচ্চিত্র বানানোর সুযোগ। সেই সিনেমার বিপণন থেকে শুরু করে উৎসবে পাঠানোর সব কাজে আমরা যুক্ত থাকব। আর কর্মশালা শেষে সবার হাতে একটি করে পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্য থাকবে। এ কারণে বাকিরা কেউ বসে থাকবেন না। তাঁরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ফান্ড পাওয়ার জন্যও আবেদন করতে পারবেন। এসব তাঁদের শেখানো হবে।’
কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন মনন মুনতাকা। তিনি বলেন, ‘নির্মাতা হওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। এখানে আমাকে ভয় পেতে হবে না। এখানে সবাই নারী। অন্য জায়গার মতো ১০ জন পুরুষের মধ্যে ২ জন নারী, এমন লিঙ্গবৈষম্য নেই। সিনেমা বানানোর জন্য আমার পুরো কর্মপরিবেশ কী হবে, সেসব জানতে পারব।’
চলচ্চিত্র নিয়ে পড়ছেন ফাতিহা তাইরা। তিনি বলেন, ‘আমি যদি সিনেমা নিয়ে জ্ঞান বাড়াতে চাই, তাহলে এটাই আমার কাছে সেরা সুযোগ মনে হয়েছে। “আমরা নারী, আমরাই পারি” যে এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করেছে, এটা নির্মাতা হিসেবে আমাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
কর্মশালায় অংশ নেওয়া অন্য প্রতিযোগীরা হলেন লাবনী আশরাফ, আতশী কর্মকার, জাহরা নাজিফা, নুসরাত জাহান, ফারাহ জলিল, নেহা শামীম, ফারিয়া মানার, মাহমুদা আক্তার, প্রাচিতা অহনা, ফারিশা আফরিন, সামিহা সিদ্দিকি, রিসানা তাহমিন ও মো. শিহাব (তৃতীয় লিঙ্গ)।
সম্প্রতি বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গনে নারী নির্মাতাদের জয়জয়কার দেখা গেছে। অস্কারে গত বছর নোম্যাডল্যান্ড সিনেমার জন্য সেরা পরিচালক হয়েছিলেন নারী নির্মাতা ক্লোয়ি ঝাও। ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ২৮ বছর পর কোনো নারী নির্মাতার ছবি পাম দ’র পায়, তিনি জুলিয়া দুকুরনো। গত বছর ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে হ্যাপিনিং দিয়ে বাজিমাত করেছিলেন তরুণ নারী পরিচালক অড্রে দিওয়ান। সম্প্রতি শেষ হওয়া বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবি হয়েছে আলকারাশ। তিনিও নারী নির্মাতা, কাতালুনিয়ার কারলা সিমন। রুবাইয়াত বলেন, ‘বিশ্বের নারীদের মতো আমরাও এগিয়ে যেতে চাই। সফল হলে প্রতিবছর নিয়মিত নারী নির্মাতাদের নিয়ে কাজ করব। একদিকে দেশের মেয়েরা শিখতে থাকবেন, অন্যদিকে সিনেমা বানিয়ে মেয়েরা এগিয়ে যাবেন।’