প্রথম জীবনে সুভাষ দত্ত ছিলেন চিত্রশিল্পী। হাতে আঁকা পোস্টারের যুগে তিনি ঢাকাই সিনেমার প্রচারণায় যোগ করেছিলেন বিশেষ মাত্রা। মুম্বাই থেকে ফিরে সুভাষ দত্ত সিনেমার পোস্টারের ডিজাইন করতে থাকেন। সেই সঙ্গে কৌতুকাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করতে থাকেন। একপর্যায়ে পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন।
ষাট ও সত্তরের দশকের সাড়াজাগানো ‘সুতারং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘বিনিময়’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘বসুন্ধরা’ ছবিগুলোর তিনি পরিচালক। এ কাজের মাধ্যমে সুভাষ দত্ত নিপুণ চিত্রশিল্পীর মতো গড়তে থাকেন তারকামুখ। তাঁর হাতে তৈরি হন অনেক শিল্পী, যাঁরা একসময় চলচ্চিত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলা যায়।
সুভাষ দত্ত আবিষ্কৃত শিল্পীদের নিয়ে এই ফিচার। তাঁর ছবি দিয়ে যাঁরা সিনেমায় যাত্রা শুরু করেছেন, তাঁদের কথাই রইল লেখা রইল এখানে। এই তালিকায় রয়েছেন দেশসেরা অভিনয়শিল্পীদের বেশ কয়েকজন।
সুচন্দা
সুভাষ দত্তের হাত ধরে সিনেমায় পা রাখেন সুচন্দা। তাঁর প্রথম ছবি ‘কাগজের নৌকা’। সুচন্দাদের বাড়ি যশোরে হলেও তখন তাঁরা গেন্ডারিয়ায় থাকতেন। রূপবতী বলে অনেকেরই চোখে পড়েছিলেন সুচন্দা। ষাটের দশকের শুরুতেই নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব পান তিনি। কিন্তু সুভাষ দত্তই শেষ পর্যন্ত সুচন্দার ডাগর কালো চোখ সেলুলয়েডে তুলে আনেন। সিনেমায় আনার জন্য সুচন্দাকে নতুন করে তৈরি করে নেন সুভাষ দত্ত। অভিনয়ের সব খুঁটিনাটি সুচন্দা শিখেছেন তাঁর ‘দত্ত কাকু’র কাছেই। দ্বিতীয় ছবিতেই সুচন্দা সুযোগ পান জহির রায়হানের ছবিতে। ‘বেহুলা’ ছবিতে রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি বাঁধার পর সুচন্দার জনপ্রিয়তা আর ঠেকায় কে!
কবরী
চট্টগ্রামের মীনা পাল থেকে ‘সুতরাং’ ছবিতে কবরী হওয়ার নেপথ্যে যে মানুষটি, তিনি সুভাষ দত্ত। যাঁর তুলির মতো নিপুণ ছোঁয়ায় শিল্পী হয়েছিলেন কবরী, তিনিও সুভাষ দত্ত। নায়িকা হওয়ার সময় কবরীর বয়স ছিল খুবই কম। সুভাষ দত্তের কঠোর শাসনে, আদরে পাকা অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন কবরী। প্রথম ছবিতেই তাঁর অভিনয়ে উন্মাতাল হয়েছিল দেশ। ‘সুতরাং’ ছবিতে সুভাষ দত্তের বিপরীতে কবরীর অভিনয়ে দর্শকেরা মোহাবিষ্ট হয়েছিলেন। ‘সুতরাং’ সুপারহিট হওয়ার পর কবরী সুপারস্টার হয়ে গিয়েছিলেন। সুভাষ দত্তের বিদ্যা তাঁর গোটা জীবনেই কাজে লেগেছে।
উজ্জ্বল
ক্যাম্পাসে নাটক করতেন উজ্জ্বল। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ করেন মাস্টার্স। তখন নিয়মিত নাটক করেন টেলিভিশনে। একদিন উজ্জ্বলের পরিচয় হয় সুভাষ দত্তের সঙ্গে। তিনি উজ্জ্বলকে বললেন, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তখনই বদলে যায় উজ্জ্বলের জীবন। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘বিনিময়’ ছবির নায়ক হন উজ্জ্বল। তাঁকে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে গড়ে তুলতে যা যা প্রয়োজন, সুভাষ দত্ত সেগুলো করেছিলেন দক্ষ শিক্ষকের মতো। একসময় গুরুর প্রিয় অভিনেতা হয়ে গিয়েছিলেন উজ্জ্বল। গুরুর অনেক ছবিতে কাজ করেছেন তিনি।
ইলিয়াস কাঞ্চন
মঞ্চনাটকে ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিনয় মনে ধরে সুভাষ দত্তের। তিনি কাঞ্চনকে মঞ্চ থেকে তুলে নিয়ে যান সিনেমায়। ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে কাস্ট করেন কাঞ্চনকে। প্রথম দিন শুটিংয়ে গিয়ে সহশিল্পী হিসেবে ববিতাকে দেখার পর বিস্ময়ের অন্ত ছিল না কাঞ্চনের। সুভাষ দত্তের অন্য আবিষ্কারগুলোর মতো কাঞ্চনও সুপারস্টারের মর্যাদা পান। তাঁকে প্রথম ছবিতেই শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন সুভাষ দত্ত। বাণিজ্যিক সাফল্য না পেলেও ‘বসুন্ধরা’তেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন কাঞ্চন। যার পুরো কৃতিত্ব সুভাষ দত্তের। দুজনে একসঙ্গে ‘ডুমুরের ফুল’, ‘সহধর্মিণী’, ‘আবদার’ এবং ‘ও আমার ছেলে’ ছবিগুলোতে কাজ করেছেন।
শর্মিলী আহমেদ
শর্মিলী আহমেদ প্রথম অভিনয় করেন উর্দু ছবি ‘ঠিকানা’তে। ছবিটি অসমাপ্ত রয়ে যায়। একসময় তাঁর পরিচয় হয় নির্মাতা সুভাষ দত্তের সঙ্গে। প্রস্তাব পান ‘আবির্ভাব’ ছবিতে অভিনয়ের। ছবিটি মুক্তির পর ব্যাপক সাফল্য পায়। নায়িকাকে নিয়ে সুভাষ দত্ত এরপর ‘আলিঙ্গন’ ছবিটি নির্মাণ করেন। শর্মিলী নায়িকা হিসেবে ক্যারিয়ার ধরে রাখেননি। নয়তো সুভাষ দত্তের অন্য অবিষ্কারদের মতোই সফল হতে পারতেন বলে সিনেমাপাড়ার অনেকে মনে করেন। তবে শর্মিলীর অভিনয়ে চমৎকার হাতেখড়ি হয়েছিল সুভাষ দত্তের হাতে।
খান জয়নুল
ছোটবেলা থেকে খান জয়নুলের অভিনযয়ের শখ। ১৭ বছর বয়সে শখ পূরণ করতে কলকাতা চলে যান। নাম পরিবর্তন করে ‘মৃণাল কান্তি রায়’ নামে কলকাতার কিছু ছবিতে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি চলে আসেন ঢাকায়। এখানে এসে মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করার পাশাপাশি নাটক লেখেন। ঢাকাই সিনেমায় তাঁকে ব্রেক দেন সুভাষ দত্ত। তাঁর আবির্ভাব ঘটে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে। পরের ছবি ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’। অল্প সময়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন খান জয়নুল।
বেবী জামান
বেবী জামান থাকতেন ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তাঁর সঙ্গে নাটক করতেন সুভাষ দত্ত, শওকত আকবর, হাসান ইমাম, কাজী খালেক, আকতার হোসেন, বুলবুল আহমেদ প্রমুখ। সেই সুবাদে সুভাষ দত্ত ও কাজী খালেক তাঁকে সুযোগ দেন নিজেদের ছবিতে। বেবী জামানের প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’। ‘সুতরাং’ ছবিতে তিনি নায়িকা কবরীর স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেন। ‘সুতরাং’–এর সঙ্গেই তিনি কাজ করেন কাজী খালেকের ‘মেঘ ভাঙা রোদ’ ছবিতেও।