অনুদান পাওয়া, শুটিং শুরু করে মাঝপথে থেমে যাওয়া, বিরতি দিয়ে আবার শুরু করা—এমন নানা কারণে অনেক দিন ধরেই আলোচনায় নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। শোনা যাচ্ছিল, নির্মাতা বিশাল ক্যানভাসে যেভাবে গল্প কিংবা চরিত্র ভাবছিলেন, সেটা হচ্ছিল না। প্রথম দফায় শুটিং করেও প্রত্যাশামতো ফল না পাওয়ায় শুটিং বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গত বছর আবার পুরোদমে শুরু হয় শুটিং। অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো আমন্ত্রিত দর্শক দেখলেন ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। আজ দেশের সাতটি সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে ‘প্রতীক্ষিত’ সেই চলচ্চিত্র।
বড় পর্দায় আতিকের শেষ কাজ ‘ডুবসাঁতার’। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১০ সালে। এরপর আর তাঁর কোনো ছবি মুক্তি পায়নি। ফলে তাঁর ছবির জন্য একটা অপেক্ষা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ছিল। নির্মাতা জাহিদুর রহিম অঞ্জন যেমনটা বলেছেন, ‘আমরা যারা সিনেমা নিয়ে ভিন্ন ধরনের চিন্তা করি, তারা প্রত্যেকেই অপেক্ষা করে থাকি নূরুল আলম আতিকের নতুন সিনেমার জন্য।’ নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ভাষায়, ‘ছোটবেলা থেকে যে মানুষটার ছবি দেখার জন্য সব সময় অপেক্ষা করে আসছি, সে মানুষটা হচ্ছে নূরুল আলম আতিক।’
প্রযোজক মাতিয়া বানু শুকুর ভরসার জায়গাও আতিক। তিনি বলেন, ‘নির্মাতা নূরুল আলম আতিকের প্রতি আমার আস্থা বরাবরই শতভাগ। সেই আস্থার প্রতি আতিক দায়বদ্ধ ছিলেন। ছবিটাতে একটা ভিন্নতর মাত্রা বুনে দিয়েছেন তিনি।’ তিনি জানান, কয়েক বছর আগেই ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ দর্শকের কাছে পৌঁছানোর কথা।Ñতা হতে পারেনি নানা সংগত কারণে। আর তাই অনেকটা শাপে বরের মতো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ছবিটা নিয়ে সবার সামনে হাজির হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম আমরা।’
‘লাল মোরগের ঝুঁটি’পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈয়দপুর রেলস্টেশন ও তার আশপাশের এলাকা থেকে প্রায় তিন হাজার নিরীহ বাঙালিকে বন্দী করে নিয়ে আসে সৈয়দপুর বিমানবন্দর–সংলগ্ন স্কুলঘরে। স্কুলঘরটাই হয়ে ওঠে তাদের বন্দিশিবির। তাদের বিমানবন্দর ও রানওয়ে মেরামতের কাজে লাগানো হয়। দিনরাত পরিশ্রমে অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ে, মারা যায়। পাকিস্তানি সেনারা এমন তিন শতাধিক বন্দী বাঙালি-শ্রমিককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হচ্ছে লাল মোরগের ঝুঁটির পটভূমি। মোরগ লড়াইয়ের এক উত্তেজনাকর দৃশ্য দিয়ে সিনেমার শুরু। বাঘা নামে এই লাল মোরগটি ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ক্লাইমেক্সে নতুন সূর্যের আগমনী হিসেবে তার ভূমিকা; আর মোরগের শেষ ডাকে সিনেমার পরিণতি। নির্মাতার মতে, ‘যে ডাক আমাদের সজাগ করে, সজাগ রাখে।’
লাল মোরগের ঝুঁটি নূরুল আলমের স্বপ্নের প্রকল্প। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গত অর্ধশতকে নির্মিত কাহিনিচিত্র কম নয়। তবে বেশির ভাগ মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা মানেই কিছু গৎবাঁধা দৃশ্যের বিস্তার। প্রায় সব ছবির মুখ্য চরিত্র বা অন্যদের চেহারা–চরিত্র, আচার-আচরণ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য একই রকম। নূরুল আলম জানান, তিনি এ ছবিতে প্রচলিত মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার প্রথাগত বয়ানের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে সিনেমার মুখ্য চরিত্র হিসেবে নিম্নবর্গের উপস্থিতি; তাদের তৎকালীন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও একান্ত ব্যক্তিগত অবস্থা-অবস্থান দেখিয়েছেন।
শুটিং অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি জানান, ছবির গল্প মূলত সৈয়দপুর বন্দিশালা ঘিরে। সেই আমেজ দিতে তাঁরা ময়মনসিংহের গৌরীপুরের একটি স্কুল খুঁজে পান। এ ছাড়া সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট, কুষ্টিয়ায় শুটিং হয়েছে। তিনি মনে করেন, সব মিলিয়ে দর্শকের চোখে মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ের চিত্রই ফুটে উঠবে। তাঁর আশা, এখন সিনেমার ভাষা বদলেছে। দর্শকের রুচিরও নিশ্চয়ই পরিবর্তন হয়েছে। তাঁরা কোন সিনেমাটি ভালো তা হয়তো এখন বুঝেই প্রেক্ষাগৃহে যাবেন।
পরিচালক জানালেন, বেশ কটি জনপ্রিয় মুখ অভিনয় করেছেন। প্রতিটি চরিত্র আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন লায়লা হাসান, আহমেদ রুবেল, শিল্পী সরকার অপু, আশীষ খন্দকার, ইলোরা গওহর, জয় রাজ, অশোক ব্যাপারী, আশনা হাবিব ভাবনা, দিলরুবা দোয়েল, জ্যোতিকা জ্যোতি, দীপক সুমন, জিনাত সানু স্বাগতা প্রমুখ।