বাংলাদেশের চলচ্চিত্র তাঁকে দিয়েছে ‘নায়করাজ’ উপাধি। এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্প শিল্পের ভিত তৈরি হয়েছে যাঁদের অবদানে, রাজ্জাক তাঁদের অন্যতম। চার দশকে তিনি নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। আজ তাঁর জন্মদিন, ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর ৮০ বছর পূর্ণ হতো। আজকের দিনে হয়তো এফডিসি কিংবা অন্য কোথাও নানা ধরনের আয়োজন থাকত। কিন্তু তিনি নেই। তাঁকে পাওয়া যাবে না কোনো আয়োজনে। তাঁর না থাকা বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে গতকাল তাঁর স্ত্রী খায়রুন্নেসা লক্ষ্মীর কাছ থেকে রাজ্জাকের জীবনের কিছুটা জানার চেষ্টা করি ।
প্রথম পরিচয়
রাজ্জাকের জীবনের প্রথম সময়টা কেটেছে কলকাতায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। থাকতেন নকতলা নামের একটি জায়গায়। আসা–যাওয়ার পথেই ১৯৬২ সালের কোনো একদিন বাঁশদ্রোণী এলাকায় দেখা হয় খায়রুন্নেসার সঙ্গে। যিনি রাজ্জাকের জীবনে ‘লক্ষ্মী’ হয়ে এসেছিলেন।
কীভাবে সেই লক্ষ্মীর সঙ্গে রাজ্জাকের প্রথম পরিচয় হয়েছিল জানতে চাইলেন গতকাল সন্ধ্যায় বললেন, ‘আমাদের বাসার ধার দিয়ে একটা রাস্তা ছিল। ও (রাজ্জাক) আর ওর একজন বন্ধু যাচ্ছিল। আমি তখন বাড়ির সামনে আব্বার কিনে আনা একটা খাসিকে গাছের পাতা ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছিলাম। ও আমাকে বলে, এই মেয়ে, তোমরা খাসিটা বিক্রি করবে নাকি? আমি বলছি, আমার আব্বা কিনে আনছে তো। বিক্রি করব না। এই এক কথা, দুই কথা বলে চলে গেছে। তখনো আমরা দুজন একেবারে অচেনা মানুষ।’ কলকাতার নাকতলা এলাকায় রাজ্জাক তাঁর বাড়িতে গিয়ে ভাবির কাছে খায়রুন্নেসার কথা জানালেন। খায়রুন্নেসা জানালেন, ‘ওর ভাবিকে বলছে, আমি এ রকম একটা মেয়ে দেখে আসছি, তোমরাও দেখতে পারো।’ ওই সময় রাজ্জাকের বয়স ছিল ১৯ বছর আর খায়রুন্নেসার ১৬। প্রথম দেখার এক সপ্তাহ পর রাজ্জাকের ভাবি, ভাই, চাচি সবাই খায়রুন্নেসাকে দেখতে আসেন।
তিনি বললেন, ‘এসে আমাকে দেখল টেখল, ওই সময়ে বিয়ে ঠিক করে গেছিল আরকি। এনগেজমেন্ট হয়। এরপর রাজ্জাক বোম্বে চলে যায়। ছিল এক বছরের মতো।’
এনগেজমেন্টের এক বছর পর বিয়ে হয়। তবে বিয়ের পর আর যায়নি। বাসায় থাকত। খালি নাটক নাটক আর নাটক, এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকত।
আংটিবদলের পর নিরুদ্দেশ
ষাটের দশকেই চলচ্চিত্রের কাজ শিখতে বোম্বে গিয়েছিলেন রাজ্জাক। ভাবির কাছ থেকে খায়রুন্নেসার খবরাখবর নিতেন। সেই সময়ের কথা মনে করে খায়রুন্নেসা বললেন, ‘তখন তো ফোন ছিল না, তাই কথাবার্তাও হতো না। এভাবে বছর যেতে দেখে, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে বললেন, এক বছর হয়ে গেল, আপনারা কিছুই বলছেন না! মেয়ে কি এরাম থাকবে নাকি। আমার ভাশুর এরপর বোম্বেতে খবর দিয়েছিল। তারপর সে কলকাতায় আসে। বিয়ে হয়েছে। এনগেজমেন্টের এক বছর পর বিয়ে হয়। তবে বিয়ের পর আর যায়নি। বাসায় থাকত। খালি নাটক নাটক আর নাটক, এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকত। আমাদের একটা মেটালের ফ্যাক্টরি ছিল, ওটা দেখাশোনা করত। ’
ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত
কলকাতায় টুকটাক অভিনয় করা রাজ্জাকের অভিনয়জীবনের বিকাশ ঘটে ঢাকায়। তবে শুরুর জীবনটা মোটেও সহজ ছিল না। কষ্টে দিনযাপন করতে হয়েছে। কলকাতার জায়গাজমি বিক্রি করে স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকা শুরু করেন। ঢাকায় থাকার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় উৎসাহ আর আগ্রহ ছিল খায়রুন্নেসার। ১৯৬৪ সালে রাজ্জাক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে যখন ঢাকায় আসেন, তখন প্রথম সন্তানের বয়স আট মাস।
খায়রুন্নেসা বললেন, ‘ঢাকায় আমার এক খালা ও মামা থাকতেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসি। খালার বাড়িতে এক সপ্তাহ ছিলাম। এরপর আমরা কমলাপুরে বাসা নিই। এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। তবে ও কয়েকবার বলেছে, চলে যাবে। আমি বলেছি, থাকি না এখানে। আমার তো এখানে ভালো লেগে গেছে। তারপর আমাকে রেখে কলকাতায় গেল। আমাদের জমি ছিল, বিক্রি করে চলে আসে।’
চলচ্চিত্রের শুরু
ঢালিউডে নায়ক হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্র জহির রায়হানের বেহুলা। স্মৃতি হাতড়ে খায়রুন্নেসা বললেন, ‘ঢাকায় থাকতে থাকতে একসময় আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে পরিচয়। তার একটি ছবিতে অভিনয় করল। এরপর জহির ভাই (জহির রায়হান) ডাকল। আস্তে আস্তে ব্যস্ত হয়ে উঠল। পুরোদমে ব্যস্ত হতে এক–দেড় বছর লেগে গেল। আমরা তখন কমলাপুর রেলস্টেশনে থাকতাম। এক বেড ও ড্রয়িং এবং রান্নাঘর ও দুই বাথরুমের বাসার ভাড়া ছিল তখনকার দিনে ৩০০ টাকা।’
ঢাকায় রাজ্জাকের ব্যস্ত জীবন
ব্যস্ততা বাড়তে থাকে রাজ্জাকের। ওদিকে খায়রুন্নেসার জন্য সময় কমতে থাকে। এ নিয়ে কোনো রাগারাগি হতো না, তবে মাঝেমধ্যে অভিমান হতো।
বিয়ের পর গঙ্গা যমুনা ছবিটা দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতার বসুশ্রী সিনেমা হলে। বৈজয়ন্তীমালা ও দিলীপকুমার ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে, পানির ওপর নাচছে—দেখে আমার খুব ভালো লাগল। আমি বললাম, এই, তুমি এরাম করতে পারবে? বলে কেন? এরাম করলে তুমি কি খুব খুশি হবে? আমি বললাম, তুমি কি পারবে কোনো দিন করতে?
খায়রুন্নেসা বললেন, ‘কোনো দিন রাত দুইটায়, কোনো দিন ১২টায়। তখন বাপ্পাই শুধু আমার সঙ্গে। আমি বলতাম, এত রাত করে আসো, একা একা থাকি। ও বলত, কাজ শেষ হলে তো আসব। শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকি। কী করব বলো? তারপর আমাকে শুটিংয়ের ছবি এনে দেখাত। বলত, এ রকম জড়ায়ে ধরে আমাকে অভিনয় করতে হবে। আরও নানা রকম কথা বলত, আমাকে রাগাতে চাইত আরকি। আমি বলতাম, করো আর কী করার। ও কিন্তু আমার ইচ্ছাতে সিনেমায় কাজ করেছে।’
কেমন সেটা জানতে চাইলে বললেন, ‘আমার বিয়ের পর গঙ্গা যমুনা ছবিটা দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতার বসুশ্রী সিনেমা হলে। বৈজয়ন্তীমালা ও দিলীপকুমার ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে, পানির ওপর নাচছে—দেখে আমার খুব ভালো লাগল। আমি বললাম, এই, তুমি এরাম করতে পারবে? বলে কেন? এরাম করলে তুমি কি খুব খুশি হবে? আমি বললাম, তুমি কি পারবে কোনো দিন করতে? তখন ও বলল, দেখি চেষ্টা করব আরকি পারার (হাসি)।’ রাজ্জাক অভিনীত প্রথম সিনেমা স্ত্রী খায়রুন্নেসা দেখেছিলেন জোনাকী সিনেমা হলে। চলচ্চিত্র ব্যাপারটা ভালো লাগত বলেই রাজ্জাককে নায়ক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন খায়রুন্নেসা।
আমার বাসায় তো কত নায়িকা আসত। কবরী এসে বলত, লক্ষ্মী ভাবি, খাব। ও পছন্দ করত পান্তাভাত, পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে খেতে। কবরী তো তার বড় ছেলেকে শুটিংয়ের সময় আমার কাছে রেখে যেত।
শুটিং সেট, রাজ্জাকের স্ত্রী ও তাঁর নায়িকারা
রাজ্জাক অভিনীত চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে মাঝেমধ্যে যেতেন খায়রুন্নেসা। ঢাকার বাইরে শুটিং হলে যাওয়া হতো বেশি। শুটিংয়ে গেলে নায়িকারা নাকি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করতেন। খায়রুন্নেসা বললেন, ‘শুটিংয়ের সময় আমি সামনে থাকলে নায়িকারা একটু অস্বস্তিবোধ করত। নায়িকারা ভাবত, এখন একটা রোমান্টিক সিন আসছে, কীভাবে করব। একটু আরকি অস্বস্তিবোধ করত। রাজ্জাকের নায়িকারা কেমন করে যেন আমার দিকে তাকাত (হাসি)।’
নায়িকারা রাজ্জাকের বাসায়ও আসতেন। তাঁদের সঙ্গে বেশ চমৎকার সম্পর্কও ছিল খায়রুন্নেসার। তবে কোনো নায়িকার প্রতি কোনো ঈর্ষা কাজ করত না বলে জানালেন। তিনি বললেন, ‘আমার বাসায় তো কত নায়িকা আসত। কবরী এসে বলত, লক্ষ্মী ভাবি, খাব। ও পছন্দ করত পান্তাভাত, পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে খেতে। কবরী তো তার বড় ছেলেকে শুটিংয়ের সময় আমার কাছে রেখে যেত। ওর সঙ্গে খুব ভাবটাব ছিল। এরপর তো সুচন্দা, শাবানা, ববিতা, শবনমদের সঙ্গে কাজ করত। নায়িকাদের মধ্যে শাবানা ও ববিতারা অনেক আসা–যাওয়া করত। খাওয়াদাওয়া করত। হই–হুল্লোড়। গুলশানের বাড়িতে সবাই আসত। পার্টি তো লেগেই থাকত। বিদেশ থেকে যে–ই আসত, সিনেমার সবাইকে নিয়ে পার্টি দিত।’