সে সময় ফেসবুক ছিল না। ছিল না ইনস্টাগ্রাম, টুইটার। থাকলে ভক্তরা সহজেই জেনে যেতেন তাঁদের ‘স্বপ্নের নায়ক’ কেমন ছিলেন? কী খেতে ভালোবাসতেন? কী তাঁর শখ ছিল? প্রতিনিয়ত তাঁদের স্বপ্নের নায়কের নতুন নতুন ছবি আর সেলফি দেখতেন। ‘চেকইন’ দেখে বুঝে নিতেন নায়ক তাঁদের কোথায় আছেন, কী করছেন।
পয়লা বৈশাখ ১৪০০। সেদিনের কথা পরিষ্কার মনে আছে। এক নায়ককে দেখেছিলাম ট্রাকে করে ঘুরে বেড়াতে। মৎস্য ভবনের মোড়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন তিনি। তাঁকে ঘিরে সে কী উত্তেজনা! হাত নেড়ে, উড়ো চুম্বন ছুড়ে ভক্তদের শুভেচ্ছার জবাব দিচ্ছিলেন নায়ক। সেদিনই বুঝেছিলাম কাকে বলে ‘নায়ক’।
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটে জন্ম নেওয়া চৌধুরী সালমান শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহ বেঁচে থাকলে আজ বয়স ৫০ পূর্ণ হতো। তিনি নেই। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতোই সবাইকে সম্মোহিত করেছিলেন। তফাত এটুকুই, একলা চলে গেছেন। তাঁর না থাকার কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়ে আজ অনুরাগীরা উদ্যাপন করছেন ৫০তম জন্মবার্ষিকী। আজ ১৯ সেপ্টেম্বর ফেসবুক ভরে গেছে সালমানের ছবিতে। তাঁকে নিয়ে অনেক আলাপ চলছে।
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটে জন্ম নেওয়া চৌধুরী সালমান শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহ বেঁচে থাকলে আজ বয়স ৫০ পূর্ণ হতো। তিনি নেই। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতোই সবাইকে সম্মোহিত করেছিলেন। তফাত এটুকুই, একলা চলে গেছেন।
এ প্রজন্মের ভক্তদের জানা হয়নি ‘স্বপ্নের নায়ক’ কেমন ছিলেন? কী খেতে ভালোবাসতেন? তাঁর শখ কী ছিল? চলচ্চিত্রেই-বা কী করে এলেন?
চলুন সালমান শাহের সমসাময়িক কাছের কয়েকজনের কাছে জেনে নেওয়া যাক। তাঁদের মধ্যে অন্যতম আশরাফুল হক। চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবাই তাঁকে ডন নামেই চেনেন। চলচ্চিত্রে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। ডন ছিলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে সালমান শাহের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। প্রথম আলোর কাছে এক স্মৃতিচারণায় ডন জানান, সালমান সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন ড্রাইভিং। কাজ শেষ করে প্রতি রাতেই লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়তেন দুই বন্ধু। বেশির ভাগ দিন কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকত না। গন্তব্যহীন ঘুরে বেড়াতেন ইচ্ছেমতো।
একটু জোরেই চালাতেন গাড়ি। বেশির ভাগ রাতে চলে যেতেন গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয়। একেবারে সাধারণ সে রেস্তোরাঁর মিল্কশেক খুব পছন্দ ছিল। এমনও হয়েছে, শুধু সালমানের জন্য রাতে দোকান খোলা রেখেছেন দোকানদার। মিল্কশেক খেয়ে, আড্ডা দিয়ে আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন!
আজ ১৯ সেপ্টেম্বর ফেসবুক ভরে গেছে সালমানের ছবিতে। তাঁকে নিয়ে অনেক আলাপ চলছে। তাঁর না থাকার কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়ে আজ অনুরাগীরা উদ্যাপন করছেন ৫০তম জন্মবার্ষিকী।
উত্তরার ফুটপাতের একটি দোকানের চিতই পিঠা খুব পছন্দ ছিল। একজন বয়স্ক নারী বানাতেন পিঠা। সালমান ও ডন মিলে প্রায়ই যেতেন সেখানে। সালমান ‘নানি’ সম্বোধন করতেন ওই নারীকে। দেখা যেত এক বসায় একেকজন ৯–১০টি পিঠা খেয়ে ফেলেছেন। বিল দিতেন ইচ্ছেমতো, দামের চেয়ে অনেক বেশি। দেখা যেত ৮টি পিঠা খেয়ে ৫০০ টাকা দিয়ে দিতেন। সে সময়ের হিসাবে টাকার পরিমাণ কম ছিল না।
চলচ্চিত্র সাংবাদিক লিটন এরশাদ তখন বিনোদন ম্যাগাজিন ‘ছায়াচিত্র’-র বিশেষ প্রতিবেদক। সালমানের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, একটু পাগলাটে স্বভাবের একরোখা ছেলে সালমান। খুব বেশি মিশুক ছিলেন। বড়-ছোট সবাইকে সহজে খুব আপন করে নিতেন। খুব আদরকাতর ছিলেন। খুব আবদার করতেন।
একটি দিনের স্মৃতিচারণা করে লিটন এরশাদ বলেন, একদিন এফডিসিতে শুটিং চলছিল। দৃশ্যটা ছিল একটা চলন্ত গাড়িতে ঢুকতে হবে জানালার কাচ ভেঙে। পরিচালক বলছেন, স্টান্টম্যান নেবেন।
সালমান জেদ ধরে বসলেন নিজে এ শট দেবেন। শেষ পর্যন্ত দিলেন এবং এক শটেই সে দৃশ্য ওকে হলো। আরেক দিন দেখা গেল ওপর থেকে লাফ দিতে হবে। সেখানেও কোনো স্টান্টম্যান না নিয়ে নিজেই লাফ দিলেন। সেবার স্পাইনাল কর্ডে আঘাত পেয়ে বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। আগুনের গাওয়া অনেক গানে পর্দায় ঠোঁট মিলিয়েছেন সালমান। এক স্মৃতিচারণায় আগুন বলেন, ‘সমসাময়িক অনেক নায়ক ছিল, অনেক চেনা মুখ ছিল। কিন্তু এফডিসিতে গেলে সালমানকে আলাদা করা যেত। এমনও দেখেছি, একদিন এফডিসির গেটের পাশে সিকিউরিটিদের একজন তাকে বলল, তাদের টেলিভিশন নেই। পরদিনই সেখানে টেলিভিশন চলে এল।’
এককভাবে সালমান শাহের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়িকা শাবনূর।
একদিন আমার মা শুটিংয়ের সেটে গেছেন, সেখানে বসার কিছু ছিল না। হঠাৎ ও পকেট থেকে টাকা বের করে প্রোডাকশনের একজনকে বলল দ্রুত একটা মোড়া কিনে নিয়ে আসার জন্য। মুরব্বিদের কীভাবে শ্রদ্ধা, ছোটদের কীভাবে আদর করতে হয়, সেটা সালমান খুব ভালো করেই জানত।শাবনূর, চিত্রনায়িকা
প্রথম আলোর সঙ্গে এক স্মৃতিচারণায় সালমান শাহকে ‘অনেক বড় মনের একজন মানুষ’ অভিহিত করে বলেন, ‘মানুষকে শ্রদ্ধা করতে জানত সালমান। একদিন আমার মা শুটিংয়ের সেটে গেছেন, সেখানে বসার কিছু ছিল না। হঠাৎ ও পকেট থেকে টাকা বের করে প্রোডাকশনের একজনকে বলল দ্রুত একটা মোড়া কিনে নিয়ে আসার জন্য। মুরব্বিদের কীভাবে শ্রদ্ধা, ছোটদের কীভাবে আদর করতে হয়, সেটা সালমান খুব ভালো করেই জানত। প্রোডাকশনের ছেলেদের সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে ছিল সালমান। চলচ্চিত্রের কেউ বিপদে পড়েছে অথচ সালমানের কাছে গিয়ে সহযোগিতা পায়নি, এমন নজির নেই। ভালো মনের একজন মানুষ।’
আজ যখন ভক্তরা সালমানের জন্মদিন উদ্যাপন করছেন, তখন তিনি অনতিক্রমণীয় দূরত্বে। তিনি কি দেখছেন, বাংলা চলচ্চিত্রানুরাগীদের মধ্যে আজও তিনি সবচেয়ে বেশি চর্চিত। সময়ের জনপ্রিয়তম নায়ক শাকিব খান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ক্ষণজন্মা এ মানুষ ২৫ বছর আগে চলে গেলেও আজও আমার মনে সেই ২৫ বছরের তরুণ নায়ক হয়ে দাগ কেটে আছেন। যে দাগটা তাঁর প্রস্থানের এত বছর পরও জ্বলজ্বলে...।’
সূত্র: ইউটিউব, প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া ফিচার ও ইন্টারভিউ