সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে আজ থেকে ৬৫ বছর আগে। ১৯৫৬ সালের এই দিনে পুরাণ ঢাকার ‘রূপমহল’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় বাংলাদেশের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। অনেকের মতে, এই ছবির অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে মাত্র দুজন এখনো বেঁচে আছেন। কেউ বলেন একজন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গতকাল যোগাযোগ করা হয় এই ছবির নাজমা চরিত্রে রূপদানকারী অভিনয়শিল্পী পেয়ারী বেগমের সঙ্গে।
কদিন আগে এই ছবির অন্যতম অভিনয়শিল্পী জহরত আরা লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। কথায় কথায় পেয়ারী বেগম জানালেন, তাঁরা দুজন একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন। ভালো বন্ধু ছিলেন। অসুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত তাঁদের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।
৮৫ বছর বয়সী এই অভিনয়শিল্পী প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমি তো মুক্তির তারিখটা ভুলে গেছি। আমার স্মরণশক্তি এখন খুব কমে গেছে। তবে মোটামুটি চলতে–ফিরতে পারি। এরপরও আমার অভিনীত সিনেমার ৬৫ বছর পূর্তির খবরটা শোনার পর সত্যি খুব ভালো লাগছে। এটা নিঃসন্দেহে ভীষণ ভালো লাগার অনুভূতি।’
‘রূপমহল’ সিনেমা হলে ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটির উদ্বোধন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন আবদুল জব্বার খান। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে ড. সাদেক একটি সভা আহ্বান করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়েই ছিল সেই সভা। তখন পর্যন্ত এখানে চলত ভারতীয় বাংলা, হিন্দি, পশ্চিম পাকিস্তান ও হলিউডের ছবি। বাংলাদেশে তখন ছবি নির্মাণ করা হতো না। সেই সভায় গুলিস্তান সিনেমা হলের মালিক অবাঙালি খান বাহাদুর ফজল আহমেদ বলে দিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর্দ্র আবহাওয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এ কথার প্রতিবাদ করলেন আবদুল জব্বার খান। তিনি বললেন, এখানে তো ভারতীয় ছবির শুটিং হয়েছে। তবে কেন পূর্ণাঙ্গ একটি ছবি করা যাবে না? চ্যালেঞ্জ দিলেন তিনি। বললেন, ছবি করে দেখাবেন।
করলেন তো চ্যালেঞ্জ! কিন্তু চলচ্চিত্রের ‘চ’ও জানেন না আবদুল জব্বার খান। কী করে নির্মাণ করবেন ছবি? ১৯৫৩ সালে নিজের লেখা ‘ডাকাত’ নাটক নিয়েই তৈরি করলেন চিত্রনাট্য। কলকাতা থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আনালেন পুরোনো মরচে ধরা এক ‘আইমো’ ক্যামেরা। শব্দ ধারণের জন্য ছিল একটি সাধারণ ফিলিপস টেপরেকর্ডার।
নারী অভিনয়শিল্পী তো পাওয়া যায় না। তাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে শিল্পী খোঁজা হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্রী জহরত আরা ও ইডেন কলেজের আইএর ছাত্রী পিয়ারী বেগম যোগাযোগ করলেন। কলকাতার শিল্পী পূর্ণিমা সেনগুপ্ত এগিয়ে এলেন। তিনিই হলেন নায়িকা (কুলসুম)। পিয়ারী নাম নিলেন নাজমা, অভিনয় করলেন নায়ক আফজালের বোন রাশিদার চরিত্রে। আফজাল হলেন পরিচালক স্বয়ং। ডাকাত সরদারের ভূমিকায় ছিলেন অট্টহাসির জন্য বিখ্যাত ইনাম আহমেদ। শুটিং হয় বুড়িগঙ্গার ওপারে কালীগঞ্জ, লালমাটিয়ার ধানখেত, তেজগাঁওয়ের জঙ্গল, জিনজিরা ও টঙ্গীর তুরাগ নদের পাড়ে। ১৯৫৫ সালের ৩০ অক্টোবর ছবির শুটিং শেষ হয়। ছবির মুদ্রণ, পরিস্ফুটন ও সম্পাদনার কাজ হয় লাহোরের শাহনুর স্টুডিওতে।
ঢাকার পরিবেশকেরা ছবিটি মুক্তি দিতে রাজি হননি। তখন ‘পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্ট’ ও ‘পাকিস্তান ফিল্ম সার্ভিস’ ছবিটি পরিবেশনার দায়িত্ব নেয়। ঢাকার রূপমহলে হয় উদ্বোধনী প্রদর্শনী। চারটি প্রিন্টের বাকি তিনটি দেখানো হয় চট্টগ্রামের নিরালা, নারায়ণগঞ্জের ডায়মন্ড ও খুলনার উল্লাসিনী সিনেমা হলে। দর্শক খুবই ইতিবাচকভাবে ছবিটি গ্রহণ করেন। এই ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন সমর দাস; গান করেন মাহবুবা হাসনাত ও আবদুল আলীম। নৃত্য পরিচালনা করেন গওহর জামিল। ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প।
‘মুখ ও মুখোশ’ ছবির ৬৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে পিয়ারী বেগমের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ুন প্রথম আলোর ‘বিনোদন’ পাতায় চোখ রাখুন।