চিত্রনায়ক মান্না
চিত্রনায়ক মান্না

মান্নাবিহীন ঢাকাই সিনেমা যেন অনেকটাই ‘মলিন’

মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত চিত্রনায়ক মান্না ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। বেঁচে থাকলে এত দিনে তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ কোথায় গিয়ে ঠেকত, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁর ৫৮তম জন্মদিনের উদ্‌যাপন ঠিকই করা হতো। হয়তো সহকর্মী ও চলচ্চিত্রে অন্যেরা দিনটি নিয়ে মেতে থাকতেন। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ভক্তরা দিনটি উদ্‌যাপন করতেন। টেলিভিশন চ্যানেলে হয়তো কোনো না কোনোভাবে তাঁর উপস্থিতি থাকত। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। কারণ, তিনি আজ অনেক দূরের মানুষ, যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না। অনন্তের পথযাত্রী হয়ে গেছেন মান্না।
অনন্তের পথযাত্রী মান্নাকে তাঁর সহকর্মীদের কেউ কেউ ফেসবুকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানের ফেসবুক পেজ এসকে ফিল্ম থেকে মান্নাকে নিয়ে লেখা হয়েছে, ‘আপনি সব সময় আমাদের অন্তরের অন্তস্থলে থাকবেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। শুভ জন্মদিন গণমানুষের নায়ক।’ মান্নাকে সবাই গণমানুষের নায়কই মনে করতেন। তাঁর বেশির ভাগ চলচ্চিত্রে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের কথাই বেশি বলা হতো। তাঁর সংলাপে উচ্চারিত হতো বঞ্চিত মানুষের নানা ক্ষোভের কথা।

ঢালিউডের প্রয়াত অভিনেতা মান্না

চিত্রনায়ক মান্নার জন্মদিন উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার একটি গান প্রকাশিত হয়েছে। ‘স্বপ্নের বাজিগর মান্না’ শিরোনামের গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর। বৃহস্পতিবার দুপুরে মান্নার প্রতিষ্ঠা করা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কৃতাঞ্জলির ইউটিউবে গানটি উন্মুক্ত হয়েছে।

আমীনূর রহমানের কথায় গানটির সুর করেছেন কিশোর দাস। গানের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান, চিত্রনায়িকা সাথী, সংগীত পরিচালক ইবরার টিপু, সংগীতশিল্পী কান্তা, প্রয়াত অভিনেতার স্ত্রী শেলী মান্না প্রমুখ। সোহানুর রহমান সোহান বলেন, ‘আমাদের মহানায়ক মান্না। চলচ্চিত্রকে তিনি অনেক দিয়েছেন। চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান ভোলার মতো নয়। আজ মান্না নেই, কিন্তু তাঁকে নিয়ে একসময় গবেষণা হবে। কেননা মান্না এমন একজন নায়ক ছিলেন, যিনি কিনা বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য সব সময় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।’

মান্না

১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন মান্না। তাঁর আসল নাম সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে মান্না ঢাকা কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন। ১৯৮৪ সালে তিনি এফডিসির নতুন মুখের সন্ধান কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে আসেন। নায়করাজ রাজ্জাক মান্নাকে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। ‘তওবা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে তাঁর। এরপর একের পর এক ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নিজেকে সেরা নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন মান্না। সে সঙ্গে চলচ্চিত্র অঙ্গনে নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন তিনি।

অভিনয়জীবনে তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মান্না। তাঁর চলচ্চিত্রে বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের কথা উঠে এসেছে বারবার। বঞ্চিত মানুষের কথা সিনেমার পর্দায় সুনিপুণভাবে তুলে ধরে তিনি সবার মন জয় করেন। তাই তিনি ছিলেন আপামর জনসাধারণের প্রিয় নায়ক। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মারা যান মান্না।

শাবনূর ও মান্না। ছবি: সংগৃহীত

মান্নার পরিবারের দাবি, ভুল চিকিৎসায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। মান্না অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দাঙ্গা’, ‘লুটতরাজ’, ‘তেজী’, ‘আম্মাজান’, ‘আব্বাজান’, ‘বীর সৈনিক’, ‘শান্ত কেন মাস্তান’, ‘খল নায়ক’, ‘রংবাজ বাদশা’, ‘সুলতান’, ‘ভাইয়া’, ‘টপ সম্রাট’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘ঢাকাইয়া মাস্তান’, ‘মাস্তানের উপর মাস্তান’, ‘বিগবস’, ‘মান্না ভাই’, ‘টপ টেরর’, ‘জনতার বাদশা’, ‘রাজপথের রাজা’, ‘এতিম রাজা’, ‘টোকাই রংবাজ’, ‘ভিলেন’, ‘নায়ক’, ‘সন্ত্রাসী মুন্না’, ‘জুম্মান কসাই’, ‘আমি জেল থেকে বলছি’, ‘কাবুলিওয়ালা’ ইত্যাদি।
মান্নার সঙ্গে অনেক চলচ্চিত্রে জুটি হয়েছেন চিত্রনায়িকা মৌসুমী। কাজের সূত্র ধরে তাঁদের সম্পর্ক একটা সময় পর্দার বাইরেও সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে। তাই মান্নাকে ভালো বন্ধু মনে করতেন মৌসুমী। তিনি বলেছিলেন, ‘মান্না ভাই আমার অনেক কাছের বন্ধু ছিলেন। “লুটতরাজ” ছবিতে আমি তাঁর সঙ্গে প্রথম কাজ করি, তারপর প্রায় ৪০টি ছবিতে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। মান্না ভাই ও আমার মধ্যে কাজের বোঝাপড়াটা ছিল দারুণ, তেমনি ছিল বন্ধুত্বটাও।

একটা সময় ওমর সানি কাজ কমিয়ে দিচ্ছিল, আবার অশ্লীলতার প্রকোপে সিনেমায় কাজও করা যাচ্ছিল না। মান্না ভাই না থাকলে আমার তখন সিনেমা থেকে সরে যেতে হতো। কিন্তু আমার বন্ধু মান্না ভাই সেটি হতে দেননি, একের পর এক ভালো ছবি করেছেন। তাঁর ভাবনাচিন্তার সবটাই ছিল চলচ্চিত্রকে ঘিরে। ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা আবার রাতে ঘুমানো পর্যন্ত সব সময়ের চিন্তাই ছিল চলচ্চিত্র নিয়ে। গানের জন্য সুন্দর লোকেশন, ফাইটের নতুন ধরন বা সম্পাদনায় নতুন সাউন্ড এফেক্ট, নতুন কিছু তৈরি করা— আজীবন এগুলো নিয়ে তিনি ভেবেছেন, কাজ করে গেছেন নিরলস। আজও চলচ্চিত্রের শুটিং-ডাবিং থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র আন্দোলন, যেকোনো ভালো বিষয়েই উঠে আসে মান্নার নাম। আজও আমরা সবাই মান্না ভাইয়ের অভাবটা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। মান্নাবিহীন ঢাকাই সিনেমা যেন অনেকটাই মলিন। মান্নাবিহীন পুরো চলচ্চিত্রজগতই কেমন যেন ছন্নছাড়া! তাই তো শুটিং থেকে শুরু করে ব্যবসা, এমনকি আন্দোলনের সময়ও মান্না ভাইয়ের কথা সবার মনে পড়ে। সবাই অকপট স্বীকার করেন, মান্না থাকলে এমনটি হতো কিংবা মান্না থাকলে এমনটি হতো না। কারণ, মান্না ভাই শুধু একজন নায়ক কিংবা অভিনয়শিল্পীই ছিলেন না। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নিবেদিতপ্রাণ একজন সিনেমাপ্রেমী, সিনেমাকর্মী।’