সিনেমায় প্রথমবার অভিনয় করেই প্রশংসিত হয়েছিলেন নুরুল ইসলাম। তাঁর অভিনয় করা ছবিটিও দেশ-বিদেশের দর্শকের কাছে দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। স্বীকৃতি হিসেবে দেশ তাঁকে দিয়েছিল শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সেই গৌরব আজ তাঁকে যন্ত্রণা দেয়। প্রায় ১৮ বছর আগলে রাখা সিনেমার পোস্টারটি ফেলে দিয়েছেন, পুরস্কারের স্মারকটিও নিজের কাছে রাখেননি ‘মাটির ময়না’ ছবির আনু।
অকালপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’র দুই চরিত্র আনু ও রোকন। ছবি মুক্তির ১৮ বছর পর এ দুই চরিত্রের দুজন শিল্পীর খোঁজ জানেন না চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কেউ! ছবির বয়াতি চরিত্রের অভিনেতা আবদুল হালিমের সূত্র ধরে পাওয়া গেল আনোয়ার (আনু) চরিত্রে অভিনেতা নুরুলের ঠিকানা। দেড় বছর হলো তিনি থাকেন রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে। সেখানেই তাঁর ছোট্ট দোকান।
দোকানে ঢুকতেই দেখা যায় একজন ক্রেতার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন নুরুল। পরিচয় দিয়ে ‘মাটির ময়না’র প্রসঙ্গ তুলতেই মিলিয়ে যায় সেই হাসি। এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘মিডিয়া ছাইড়া আইছি বহু বছর। এইগুলা আর ভাল্লাগে না। মিডিয়া সবার জন্য না। আমাগো মতো গরিবের জন্য আরও না। অনেক ধরা খায়া এখন ব্যবসা করি।’
জড়তা কাটার পর নুরুলের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে আক্ষেপ। তিনি বলেন, ‘মিডিয়ায় থাকার অনেক চেষ্টা করছিলাম। গরিব বলে কেউ কাজ দেয় না, দিলেও বেতন অনেক কম। পরিবারের বড় ছেলের দায়িত্ব অনেক। টাকার জন্য তিনবার তারেক আংকেলের বাসা থেকে চাকরি ছেড়ে আসছিলাম। পরে আবার আমাকে ডেকে নিয়ে গেছিলেন, কিন্তু আমার লাভ হয়নি।’
তিনি জানান, পরিচালক তারেক মাসুদের এক আত্মীয়র বাসায় কাজ করতেন। পাশাপাশি পড়তেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের একটি স্কুলে, যেখান থেকে তাকে সিনেমার জন্য তুলে এনেছিলেন তারেক মাসুদ। তারপর বছরখানেকের জন্য যুক্ত হয়েছিলেন ‘মাটির ময়না’ ছবির সঙ্গে। ‘মাটির ময়না’ (২০০২) তারেক মাসুদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এ ছবির জন্য তিনি ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্থনাইটসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
সিনেমার শুটিং শেষে তারেক মাসুদের বাসাতেই কাজে লেগে গিয়েছিলেন নুরুল। কিন্তু অভিনয়টা তাঁর আর হয়ে ওঠেনি। বাসার কাজ করতে গিয়ে পড়াশোনাও আর হয়নি। তখন তারেক মাসুদের বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল অনেক নির্মাতার। তাঁদের সবাইকেই বলেছেন, অভিনয়ের সুযোগ চান। অনেকেই কথা দিয়েছিলেন, কিন্তু কাজ দেননি।
নুরুল বলেন, ‘প্রথম যখন সিনেমা হলে গিয়ে নিজের ছবিটা দেখি, তখন মনে হইছিল, ভাগ্য বোধ হয় এবার বদলে যাবে। মানুষ খুব প্রশংসা করত। আমি ঠিক করছিলাম থিয়েটারে অভিনয় শিখে নিয়মিত মিডিয়ায় কাজ করব। তারেক আংকেলের বাসার কাজে গিয়া আর কিছুই হইল না। আংকেল বলছিলেন একটা বৃত্তিতে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিবেন, তাও হইল না।’
পরিচিত মানুষদের মাধ্যমে চেষ্টা করেছিলেন, অভিনয় না হোক, অন্তত প্রোডাকশন বয় হিসেবে কাজ করে সিনেমার সঙ্গে থাকবেন। কাজ করেছিলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ইউনিটে। বেশি দিন করতে পারেননি।
পরে সিনেমার অনেকের কাছেই গিয়েছিলেন নুরুল। এসএসসি পাস না, তাই চাকরিও হয়নি। বেঁচে থাকার জন্য ভ্রাম্যমাণ দোকান চালানো শুরু করেন তিনি। পরে দেন একটি পানের দোকান। সেই ব্যবসাও হয়ে ওঠেনি। ধারদেনা করে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে গিয়েছিলেন কাতার। ভাগ্য সেখান থেকেও ফিরিয়ে দিয়েছে তাঁকে।
তারপর গ্রামের বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে একটি চায়ের দোকান দেন কামরাঙ্গীরচরে। গত কয়েক মাস তেমন কোনো আয় হয়নি। ৩ মাসের দোকানভাড়া বকেয়া পড়ে আছে। বাসাভাড়া দেন না ৪ মাস। এখনো দেনা প্রায় ৯০ হাজার টাকা
। এসব দুঃখের ভাগ দিয়ে নুরুল বললেন, ‘আমরা বঞ্চিত হইছি। শুটিংয়ের আগে-পরে কিছুই পেলাম না। শুটিংয়ের সময় একজন অভিনেত্রী পায়ে আঘাত পেলে পরিচালকেরা তাঁকে লাখ টাকা দেন। আমি সিনামা করে কোনো টাকাই পেলাম না।’
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের স্মারকটা কী করেছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পুরস্কার দিয়ে আর কী হইব? এই দেশে এই পুরস্কারের কোনো দাম আছে? থাকলে তো আমার লাভ হইতো! এখন অভিনেতা বলে কাউকে পরিচয় দিই না। নিজের কাছ লজ্জা লাগে। জাতীয় পুরস্কারের মেডেল কই আছে, জানি না। গ্রামের বাসায় মাচার ওপর রাখছিলাম। এসবের খোঁজ রাখার সময় কই। অনেক সময় নষ্ট করছি। এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি।’
এসব আলাপ যখন চলছিল, একজন পণ্য সরবরাহকারী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিলেন নুরুলের দিকে। জানতে চান, ‘বস, কন কী, আপনি অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাইছেন? কোন ছবির জন্য?’ ফেরার সময় নুরুল অনুরোধ করে বললেন, ‘মিডিয়া থেকে তো কিছুই পেলাম না। পুরস্কার নেওয়ার সেই ছবিটার জন্য অনেকের কাছে গিয়েছি। কেউ দিতে পারেনি। যদি পারেন ছবিটা আমাকে খুঁজে দিয়েন। ছবিটা বাঁধাই করে রাখব। সব স্মৃতি তো আর ভোলা যায় না।’