ফিল্মের ক্যানে মাথা রেখে ঘুমানো নির্মাতা

জোকার ছবিতে দিলীপ বিশ্বাস
জোকার ছবিতে দিলীপ বিশ্বাস

টাকা নিয়ে পরিচালকের পেছন পেছন ঘুরছেন প্রযোজক—এ দৃশ্য আজ ভাবা যায়? অথচ ঢালিউডে এ ঘটনা ঘটেছিল আশির দশকে। সেই পরিচালকের নাম দিলীপ বিশ্বাস। তখনই তাঁর পেছনে পারিশ্রমিক হিসেবে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে ঘুরতেন প্রযোজকেরা । কিন্তু টাকার জন্য কখনো আপস করেননি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে রাতের পর রাত ফিল্মের পরিত্যক্ত ক্যানে ঘুমানো এই নির্মাতা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে মহিমান্বিত করার পেছনে যাঁদের অবদান, দিলীপ বিশ্বাস তাঁদের প্রথম সারির একজন। বেশ কিছু কালজয়ী সিনেমার এই নির্মাতার প্রয়াণের আজ দেড় দশক পূর্ণ হলো। ২০০৬ সালের ১২ জুলাই তিনি মারা যান।

গায়ক থেকে পরিচালক
দিলীপ বিশ্বাসের বাবার বাড়ি পিরোজপুরের কারখানাবাড়িতে। সিভিল সার্জন বাবার চাকরিসূত্রে খুলনা, যশোর, পাবনা, রাজশাহী, বরিশাল, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন দিলীপ। শৈশব থেকে গানের প্রতি ঝোঁক ছিল। বাবার অবসরের পর ষাটের দশকে তাঁরা থিতু হন ঢাকায়। সে সময় ঢাকার বিভিন্ন স্টেজে প্যারোডি গান করে বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন। গানের মাধ্যমেই ১৯৬৫ সালের দিকে দিলীপ বিশ্বাসের পরিচয় হয় অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর সঙ্গে। সুমিতা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন নিজের স্বামী খ্যাতিমান নির্মাতা জহির রায়হানের সঙ্গে।

পরের বছর জহির তাঁকে ‘বেহুলা’ ছবিতে গান করার প্রস্তাব দেন। সানন্দে রাজি হয়ে যান দিলীপ বিশ্বাস। জহির রায়হানের সঙ্গে তাঁর বাড়তে থাকে সখ্য। এফডিসিতে শুটিং দেখতে দেখতে সিনেমার প্রতি দিলীপের আকর্ষণ বাড়তে থাকে।

জহির রায়হান

জহির রায়হানের সহকারী হিসেবে ১৯৬৭ সালে ‘আনোয়ারা’ ছবির কাজ করেন দিলীপ। ওই সময় তিনি ‘জীবনসংগীত’, ‘মোমের আলো’, ‘আনোয়ারা’সহ বেশ কিছু ছবিতে গান করেন। হঠাৎ করেই সিনেমায় গান করা কমিয়ে দেন তিনি, মনোযোগী হন পরিচালনায়, শিখতে থাকেন। প্রায় এক দশক সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করে ১৯৭৬ সালে প্রথম ‘দাবি’ পরিচালনায় হাত দেন দিলীপ বিশ্বাস।

পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার দাঁড়ায় সাত দিনে
‘দাবি’ দিলীপ বিশ্বাসের প্রথম নির্মাণ। তবে প্রথম মুক্তি পায় দ্বিতীয় প্রচেষ্টার ছবি ‘সমাধি।’ এতে অভিনয় করেছিলেন  রাজ্জাক, সুচরিতা, উজ্জ্বল, সুমিতা দেবী প্রমুখ। ছবিটির গল্প এবং নির্মাণে ছিল নতুনত্ব। সারা দেশ হুমড়ি খেয়ে পরেছিল ‘সমাধি’তে। সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘ও আমার রসিয়া বন্ধু রে তুমি কেন কোমরের বিছা হইলা না’ গানটি তখন শোনেননি এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হতো। সেই গান এখনো আবেদন হারায়নি। এ ছাড়া ‘মাগো মা, ও গো মা’ গানটিও সপ্তাহ না ঘুরতেই দর্শকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে এফডিসিতে যাওয়া দিলীপ বিশ্বাসের দিন বদলে গেল।

ছবি মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন হলমালিকেরা আরও এক সপ্তাহ সেটি চালানোর তাগাদা দিলেন, দিলীপ বিশ্বাসকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। দিলীপ বিশ্বাস যেন সেই পরিচালক, তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। একে একে তিনি বানিয়েছেন ‘আসামি’, ‘জিঞ্জির’, ‘আনারকলি’, ‘অনুরোধ’, ‘অংশীদার’, ‘দায়ী’, ‘অপমান’, ‘অস্বীকার’সহ বহু জনপ্রিয় ব্যবসাসফল ছবি।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হাতে বাঁ থেকে আলমগীর, শাবানা ও দিলীপ বিশ্বাস।

দিলীপ বিশ্বাস মানেই তারকাবহুল ছবি
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ছবিতে অনেক তারকা নিয়ে প্রথম কাজ করেন দিলীপ বিশ্বাস। শুরু ‘জিঞ্জির’ দিয়ে। ১৯৭৮ সালে শুরু হয় সিনেমাটির শুটিং। সে সময় বাংলাদেশে চলচ্চিত্র অঙ্গনের দারুণ জনপ্রিয় অভিনেতা রাজ্জাক, সোহেল রানা, ববিতা, আলমগীরসহ অনেকেই অভিনয় করেছিলেন ছবিটিতে। একসঙ্গে এত তারকা নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করাকে অনেকে বাড়াবাড়ি মনে করেছিলেন। সিনেমাটি ব্যবসাসফল হলে বাংলাদেশে শুরু হয় তারকাবহুল ছবির প্রচলন। দিলীপ বিশ্বাসের মৃত্যুর পর মুক্তি পায় শেষ ছবি ‘মায়ের মর্যাদা’। এতে অভিনয় করেছেন হুমায়ুন ফরীদি, মান্না, শাবনূর, মৌসুমী, শাকিব খান, ববিতা, সোহেল রানাসহ একঝাঁক তারকা। এত তারকাকে একসঙ্গে এর আগে কোনো ছবিতে দেখা যায়নি।


কলকাতায় দিলীপ বিশ্বাসের সিনেমা
বাংলাদেশের পাশাপাশি দিলীপ বিশ্বাস তিনটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন ভারতের কলকাতায়। টালিগঞ্জে তখন ছবির বাজেট ছিল খুবই কম। সেখানে প্রথমবারের মতো ‘আমার মা’ ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করলেন রঞ্জিত মল্লিক, ভিক্টর ব্যানার্জি, লাবণী সরকার, অনুরাধা রায়, প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অভিষেক চ্যাটার্জি, শ্রীলেখা মিত্র, দিপংকর দে, শুভাশিস মুখার্জি প্রমুখ। কলকাতার ইতিহাসে এমন তারকাবহুল বিগ বাজেটের ছবি আগে হয়নি। ছবিটি সে বছর সবচেয়ে বেশি টাকা আয় করে।

দিলীপ বিশ্বাসের ছেলে দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, ‘এখনো কলকাতায় গেলে বাবার সঙ্গে কাজ করা শিল্পীরা বাবার প্রশংসা করেন। কলকাতায় পরে সিনেমার যে রমরমা ব্যবসা শুরু হয়, সেটা অনেকটা বাবার হাত ধরেই। কলকাতার ওই সময়ের সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন।’ উল্লেখ্য, কলকাতায় দিলীপ বিশ্বাসের বানানো তিনটি ছবিই ছিল তারকানির্ভর এবং তুমুল ব্যবসাসফল।

ছেলে দেবাশীষ বিশ্বাসের সঙ্গে দিলীপ বিশ্বাস

ছবি মুক্তি মানেই বছরের সেরা
দিলীপ বিশ্বাসের ছবি মানেই সুপারডুপার হিট—এটা ছিল অঘোষিত বাস্তবতা। হলমালিকেরা সেই সময়ে দিলীপ বিশ্বাসের নামে ছবি চালাতেন। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আসামি’ সে বছরের সেরা ব্যবসাসফল ছবি। ‘অংশীদার’ ১৯৮১ সালের সেরা ব্যবসাসফল ছবি, ‘অস্বীকার’ বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ব্যবসাসফল ছবি। ‘অস্বীকার’ সেই বছর ঈদুল ফিতরে মুক্তি পেয়ে বহু সিনেমা হলে ঈদুল আজহার পরের দুই থেকে তিন মাস একাধারে চলেছিল। হলমালিক সূত্রে খবর নিয়ে জানা যায়, ঢাকার রাজমণি এবং যশোরের মণিহারে প্রায় ছয় মাস এক নাগারে চলে ‘অস্বীকার’। ২০০১ সালে ‘আমাদের সংসার’, ২০০৬ সালে ‘মায়ের মর্যাদা’ আয়ের দিকে ছিল প্রথম দিকে। কলকাতায় মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘বছরের সেরা ব্যবসাসফল সিনেমা’র তকমা।

পরিবারের কাছে দিলীপ বিশ্বাস
দিলীপ বিশ্বাস ছিলেন একাধারে নির্মাতা, প্রযোজক, গায়ক এবং ত্রিশের বেশি ছবির অভিনেতা। বাবাকে এখনো আদর্শ মনে করেন ছেলে দেবাশীষ বিশ্বাস। বাবার সার্বিক ছোঁয়ায় ছেলে নির্মাণ করেছেন ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’। তিনি এখন পুরোদস্তুর সিনেমা নির্মাতা। দিলীপ বিশ্বাস তাঁর প্রযোজিত সব ছবিতে প্রযোজক হিসেবে রেখেছিলেন স্ত্রী গায়ত্রী বিশ্বাসের নাম। স্বামীর ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ গায়ত্রী বিশ্বাস প্রথম আলোকে জানান, তাঁর দুটি সত্তা ছিল—একটি সিনেমা, আরেকটি পরিবার। দুটি জায়গা সব সময় তাঁর কাছে আলাদা ছিল। এই নির্মাতা সব সময় গর্ব করে বলতেন, এত বড় নির্মাতা হওয়ার পেছনে স্ত্রী গায়ত্রী বিশ্বাসের অবদান সবচেয়ে বেশি।

‘স্বীকৃতি’ চলচ্চিত্রে দিলীপ বিশ্বাস, উজ্জল এবং শাবানা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রযোজকদের কাছে সোনার হরিণ
দিলীপ বিশ্বাসকে নির্মাতা হিসেবে পাওয়া প্রযোজকদের কাছে যেন সোনার হরিণ পাওয়ার সমান। ৯০-এর দশকে ছবিপ্রতি ২৫ লাখ টাকা পারিশ্রমিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল দিলীপ বিশ্বাসকে। দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, ‘অনেক প্রযোজক বড় অঙ্কের টাকা প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, দাদা, আমার ছবিটা বানিয়ে দেন। কিন্তু বাবাকে টাকা টানত না। তিনি নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করেননি। ঢাকার প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার এবং কলকাতার প্রযোজক অশোক ধানুকা বাবার ছবিতে লগ্নী করে সে সময় প্রচুর টাকা আয় করেছিলেন।’

জ্ঞানের মহাসমুদ্রে ‘অ’
নির্মাতা দিলীপ বিশ্বাসের বেশির ভাগ ছবির নাম ‘অ’ অক্ষর দিয়ে। ‘অংশীদার’, ‘অপমান’, ‘অস্বীকার’, ‘অপেক্ষা’, ‘অকৃতজ্ঞ’সহ ডজনের বেশি ছবি নাম পাওয়া যায়। কেন? দেবাশীষ জানান, তাঁর বাবা (দিলীপ বিশ্বাস) সব সময় মনে করতেন, ছবি একটি বৃহৎ পরিসর। একটি মহাসমুদ্র। তাঁর জীবনে তিনি সিনেমা নিয়ে খুব সামান্য শেখার এবং জানার সুযোগ পেয়েছেন। ‘অ’ হচ্ছে সেই শিক্ষার প্রথম ধাপ। যে ধাপ তিনি সারা জীবনে অতিক্রম করতে পারেননি।

দিলীপ বিশ্বাসকে কতটা স্মরণ করা হয়
নিজের সংগঠনেই অবহেলিত নির্মাতা দিলীপ বিশ্বাস। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করা এই নির্মাতা ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি। নিজের গড়া সংগঠন এই নির্মাতাকে সেভাবে স্মরণ করেননি। দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তাঁর কালজয়ী কোনো ছবি সংরক্ষণেরও কোনো উদ্যোগ নেই। দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি, গুণীদের সম্মান করি না। অথচ বাবার কলকাতার ছবিগুলো সেখানে তারা সংরক্ষণ করে রেখেছে।’ পরিচালক বাবার ছেলে দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালক হতে পেরে গর্বিত। বাবার সব কাজ তিনি যেমন সংরক্ষণ করেছেন, তেমনি বাবাকে নিয়ে যত লেখা–সাক্ষাৎকারও সংরক্ষণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দেবাশীষ। ২০০৬ সালে বাবাকে নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র ‘সৃষ্টিতে বিশ্বাস’।

অমিতাভ বচ্চন ও অপূর্ণতা
দিলীপ বিশ্বাসের প্রিয় অভিনেতা ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। প্রিয় অভিনেতার মতোই বেশ লম্বা ছিলেন তিনি। এমনকি প্রিয় অভিনেতার সঙ্গে নিজের চেহারার গড়ন ও অন্যান্য বিষয়ের অনেক মিল খুঁজে পেতেন এই নির্মাতা। ইচ্ছে ছিল অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু জীবদ্দশায় সেই সুযোগ তিনি পাননি। এই অপূর্ণতা নিয়ে ২০০৬ সালের ১২ জুলাই দেহত্যাগ করেন তিনি।