শ্রদ্ধাঞ্জলি

তবু মনে থাকে, সময় এক বৃদ্ধ যাযাবর

তারেক মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
তারেক মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

হারিয়ে ফেলা কোনো সৃজনশীল মানুষের যখন জন্মদিন বা মৃত্যুদিন আসে, তখন আমরা আসলে তাঁর রেখে যাওয়া কাজের মাধ্যমেই তাঁকে স্মরণ করি। তাঁর সৃজনশীলতাকেই উদ্‌যাপন করি, তাঁর ভাবনা ও দর্শনকে উদ্‌যাপন করি।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মহাসড়কে প্রাণ দিয়েছেন তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ আমাদের পাঁচ সহকর্মী। মৃত্যুর আট বছরের মাথায় আমরা তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করতে পারিনি। তবে এ বছর মিশুক ভাইয়ের জন্মদিনটি উদ্‌যাপিত হয়েছে, তারেক ভাইয়ের জন্মদিনও উদ্‌যাপিত হচ্ছে ৬ ডিসেম্বর।

শোকে বিশ্বাস করতেন না তারেক ভাই। বিশ্বাস করতেন উদ্‌যাপনেই। সে অনুযায়ী, এটাই হয়তো ঠিক। সৃজনশীল মানুষ শারীরিকভাবে হারিয়ে গেলেও তাঁদের কাজগুলো তো সবার কাছে থেকে যায়। তাঁদের কাজগুলো উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে তাঁদের শিল্পভাবনা ও দর্শনের পূর্ণ পাঠই হতে পারে যথার্থ সম্মান জানানোর প্রক্রিয়া। সে জন্মদিন অথবা মৃত্যুদিন, যা-ই হোক।

পেছনের দিকে তাকালে কত কথাই মনে পড়ে। আবার অনেক কথা ধুলোয় মলিনও হতে শুরু করে বছর পেরোতে পেরোতে। তবু মনে থাকে, সময় এক বৃদ্ধ যাযাবর, সে থামতে জানে না।

আমাদের প্রেক্ষাগৃহগুলো যখন একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন প্রথম যে নির্মাতা এর নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে চিন্তিত হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁর চলচ্চিত্র কখনো প্রেক্ষাগৃহে জায়গা পায়নি। তারেক ভাই তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’ যখন কোনো প্রেক্ষাগৃহেই মুক্তি দিতে পারেননি, তখন শুরু হয় উল্টো পথে যাত্রা। বিভিন্ন জেলায় চলচ্চিত্রটির বিকল্প প্রদর্শনী করতে গিয়ে দেখলেন, সবখানে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ। অনেক জেলায় শিল্পকলা একাডেমিরও কোনো মিলনায়তন নেই। সেসব নিয়ে চিন্তিত হয়ে যখন প্রামাণ্যচিত্র ধারণের কাজ শুরু করলেন, তখন জানতে চাইতাম অস্থির হওয়ার কারণ।

বলতেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্র তারা দেখায় না, তাতে কী। সাধারণ মানুষের তো বিনোদনের প্রয়োজন আছে। তারা যখন সুস্থ বিনোদন থেকে বঞ্চিত হবে, তখন তো তারা চুপ করে বসে থাকবে না। অসুস্থ বিনোদন খুঁজে নেবে। অন্য অর্থে, শিল্প প্রদর্শনের যদি জায়গা না থাকে, তাহলে তো শিল্পচর্চাও হবে না। কিন্তু আমরা যারা নিজেদের অগ্রসর চিন্তার মানুষ মনে করি, তাদের তো দায়িত্ব রয়েছে ভুলগুলো তুলে ধরার, দায়িত্ব রয়েছে অন্যদের পথ দেখানোর। বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর সামনে যদি মননশীল চর্চার কোনো সুযোগ না থাকে, তাহলে তারা কী চর্চা করবে, সেটা ভাবতে গেলেই তো নীতিনির্ধারকদের গা শিউরে ওঠার কথা।’

সেখানেই প্রশ্ন এসেছিল, কখন একজন সমাজসচেতন নির্মাতার কর্মী হয়ে ওঠার প্রয়োজন পড়ে? কখন একজন সৃজনশীল মানুষকে নিজের কাজটি ছেড়ে জঞ্জাল পরিষ্কার করে রাস্তা তৈরির কাজে নামানোর প্রয়োজন পড়ে? আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বয়স ৬০ পেরিয়েছে, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপন করব আমরা আর মাত্র এক বছর পরে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের একটি জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র নেই। চলচ্চিত্র এখনো একমাত্র শিল্প, যা এই উপমহাদেশে জাতীয় পতাকা প্রদর্শনপূর্বক দেখানো হয়। কিন্তু আমরা কি মনে রাখি, জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের পর পর্দায় কী দেখাতে পারি? আমাদের চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো কি সেসব মনে রাখে?

শিল্পের সব কটি শাখা যেখানে এসে মিলিত হয়, সেটি চলচ্চিত্র। সে চলচ্চিত্রকে শিল্পমাধ্যম অথবা গণমাধ্যম, যা-ই বলা হোক, একটি চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশি মানবিক, একটি চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশি সামাজিক, একটি চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী দার্শনিক, তাত্ত্বিক অথবা রাজনৈতিক ভাষ্য নিয়ে হাজির হওয়ার ক্ষমতা আর কোনো মাধ্যমের নেই। শিল্পের সব কটি শাখার সঙ্গে প্রযুক্তির আধুনিকতম সংস্করণ যেখানে এসে মিলিত হয়, সে মাধ্যমটির এমন বছরের পর বছর ধরে বুদ্ধিবৃত্তিহীন দুর্বল চর্চা, ব্যবহার ও প্রকাশ যেমন তারেক ভাইকে কষ্ট দিত, তেমনি আমাদেরও দেয়। তারেক ভাই বলতেন, আমাদের পরিণত হওয়ার পথ এখনো অনেক দূর।

কবিতা বা উপন্যাস, গান বা ছবি আঁকা একা একা করা যায়, কিন্তু চলচ্চিত্র তো একা করা যায় না। এর জন্য টিম লাগে, অর্থ লাগে। নানা আয়োজন লাগে। ঋত্বিক ঘটকের যে কথাটি তারেক ভাইও বলতেন, ‘বিশেষ এলেম লাগে’। সে এলেম তো অল্প সময়ে অর্জিত হয় না। যে কারণে যথার্থ শিক্ষা, মেধা ও সৃজনশীলতা নিয়ে খুব বেশি নির্মাতাও তৈরি হয় না এখানে। যারা হয়, তারা যখন অকালে ঝরে যায়, অবকাঠামোর ফাঁদে যখন তাদের হারিয়ে ফেলি, তখনই কেবল বুঝতে পারি আমরা কী হারিয়েছি।

পৃথিবীতে অনেক সৃজনশীল মানুষের নামে সড়ক, স্মৃতিস্থাপনা, ম্যুরাল অথবা নানা আকৃতির ভাস্কর্য স্থাপিত আছে। কোনো সমালোচকের নামে বোধ হয় একটিও নেই। তবু সমালোচকদের অতি সক্রিয়তায় নিজেকে গুটিয়ে নেয় অনেক সৃজনশীল প্রাণ। অবকাঠামোর অসহযোগিতায় উদ্যম হারিয়ে ফেলে অনেকেই। আর কেবল মরে গিয়েই প্রমাণ করা সম্ভব হয় যে একদা তিনিও বেঁচে ছিলেন এবং কিছু ভালো কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। তারেক মাসুদের নামে এখানে এখনো কিছু হয়নি, তাঁর জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে তাঁর কাজগুলোর পূর্ণ পাঠ আর তাঁর অর্জনের দিকে ফিরে তাকালে আমাদের মাঝেমধ্যে মনে করিয়ে দেয় শুধু।

এ দেশে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, নিরুৎসাহিত করার মানুষ আছে দলে দলে, প্রতিষ্ঠান আছে একাধিক। তবু কালে কালে কিছু মহাপ্রাণ আসে, যারা শুধু অন্যকে অনুপ্রাণিত করে না, পথও দেখায়, পরের প্রজন্মের জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে। উপস্থিত না থেকেও নীরবে পথচলার সাহস জোগায়।

তারেক ভাই বলতেন, সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা হচ্ছে ‘রিলে-রেস’-এর মতো। এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে যায়। আপনার জন্মদিনে, এই প্রজন্মের একজন, যে আপনারই দেওয়া সাহস ও আলোকবর্তিকা নিয়ে পথ চলছে, তেমন একজন নীরব কর্মীর বিনীত শ্রদ্ধাঞ্জলি।

প্রসূন রহমান: লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা