পুরান ঢাকায় এক কুস্তি প্রতিযোগিতায় অতিথি হয়ে গেছেন চিত্রনায়ক আজিম। সেই আসরেই কুস্তি লড়তে এসেছিলেন জসিম ও তাঁর কয়েক বন্ধু। শারীরিক গড়ন দেখে তাঁদের অভিনয়ে আসতে বলেন এই চিত্রনায়ক। সেই থেকেই জসিমের সঙ্গে আজিমের সখ্য। জসিম আর তাঁর বন্ধুদের সিনেমায় সুযোগ দিতে পরিচিত প্রযোজক ও নির্মাতাদের বলে দেন আজিম। একদিন সুযোগও পেয়ে যান জসিম। দৃশ্যটি ছিল খুবই ছোট, সিনেমার নায়িকা শাবানাকে কাঁধে তুলে পালাতে হবে। ব্যস এটুকুই। প্রথম অভিনয়, পারবেন কি না, এই নিয়ে মনে ভয় ছিল। চার দিন অপেক্ষার পর ঠিকঠাক মতোই দৃশ্যটি করেন তিনি। জসিমের অভিনয়জীবনের শুরুর এই গল্প ফাইট ডিরেক্টর আতিকুর রহমান চুন্নুর কাছে শোনা। জসিমের গড়া ফাইটিং দল জ্যাম্বস গ্রুপের তিনি সদস্য। জসিমের সঙ্গে অনেক সিনেমাতেই তিনি ফাইটার হিসেবে কাজ করেছেন।
জ্যাম্বস গ্রুপ সম্পর্কে চুন্নু বলেন, ‘বস (জসিম) আমাদের ফাইটিং শেখাতেন। তাঁর কাছেই কাজের হাতেখড়ি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। সেভাবেই শোনা, মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্রেনিংয়ে কলকাতায় যান তিনি। এ সময় থাইল্যান্ডের একজন তাঁকে মার্শাল আর্ট ও আরও কিছু ফাইটিংয়ের কৌশল শেখান। এসবের চর্চা তিনি যুদ্ধের পরও চালিয়ে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বস নায়ক আজিমের সুপারিশে রংবাজ সিনেমায় ফাইট ডিরেক্টরের কাজ পান।’
রংবাজ সিনেমার শুটিংয়ে গিয়ে তিনি মারপিটের দৃশ্যগুলো নিজের মতো করে দেখিয়ে দেন। এই সময় তিনি দেখিয়ে দেন কীভাবে শব্দ করে মারলে, কীভাবে মাটিতে পড়লে বাস্তবসম্মত হবে। নির্মাতা তাঁর কৌশল ও অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন। এর আগপর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে মারপিটের দৃশ্য বলতে ছিল লাঠালাঠি, দৌড়াদৌড়ি, পাছড়াপাছড়ি আর কুস্তি।
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় রংবাজ। আরও অনেক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি মারপিট দৃশ্যের নতুনত্বের জন্য সারা দেশের দর্শকদের মধ্যে সিনেমাটি বিপুল আগ্রহ তৈরি করে। এই সিনেমা থেকেই বাংলা ছবির মারপিটে ‘টিসুম টিসুম’জাতীয় শব্দ যুক্ত হয়। প্রশিক্ষক, ফাইটার ও খল অভিনেতা হিসেবে দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভ করেন জসিম। অনেকেই তাঁর কাছে ফাইটিং শিখতে ধরনা দিতে থাকেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ফাইটার তৈরি করার জন্য তিন বন্ধু এনামুল করিম আমান, মাহবুব খান গুই, রুহুল আমিন বাবুল মিলে ১৯৭৭ সালের দিকে গড়ে তোলেন পেশাদার ফাইটিং গ্রুপ। এটাই বাংলাদেশের প্রথম ফাইটিং দল। সবার নামের আদ্যাক্ষরের সঙ্গে বহুবচনবাচক ‘এস’ যোগ করে দলের নাম রাখা হয় ‘জ্যাম্বস’ (JAMBS) ফাইটিং গ্রুপ। সিনেমার টাইটেলে তখন লেখা থাকত ফাইট জ্যাম্বস গ্রুপ।
দোস্ত দুশমন, হুর এ আরব, আল হেলাল, বদলা, একমুঠো ভাত, লুটেরাসহ অনেক সিনেমায় ফাইট ডিরেক্টর ছিল জ্যাম্বস। বাংলা চলচ্চিত্রের দক্ষ ফাইটার তৈরিতেও এই জ্যাম্বস গ্রুপ অবদান রাখে। জ্যাম্বস গ্রুপ এখন আর নেই। মারা গেছেন জসিম ও মাহবুব খান। অন্য দুজন জীবিত থাকলেও মারপিট নির্দেশনা আর দেন না। ফাইট ডিরেক্টর ও ফাইটারদের মধ্যে আরমান, মোসলেম ও কামাল, আমির, বুলেট, নূর ইসলাম, আওলাদ, পারভেজ গাঙ্গুয়াসহ অনেকেই জসিমের ছাত্র। খল অভিনেতা পারভেজ গাঙ্গুয়া বলেন, ‘আমি সরাসরি জসিম ভাইয়ের হাত ধরে ফাইটিং শিখেছি। আমাদের দেশে ফাইটিংয়ে এখনো বসের (জসিম) ওপরে আর কেউ নেই। এখন ফাইটারদের কাজ কম। কিন্তু জসিম ওস্তাদের সঙ্গে যখন থেকেছি, তখন আমাদের জ্যাম্বস গ্রুপের প্রত্যেক সদস্যের মাসের পর মাস শিডিউল আগেই বুকিং হয়ে যেত।’ নব্বইয়ের দশকে জসিমের ছাত্র ছিলেন ২০০ জনের বেশি। তাঁরা এখন নিয়মিত সিনেমার ফাইট দলে কাজ করেন। জসিম জীবিত থাকতেই তাঁর ছাত্রদের জন্য ‘জুনিয়র জ্যাম্বস’ নামে একটি ফাইটিং দল গঠন করে দিয়েছিলেন। এই দলের সদস্যরাই অভিনেতার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে গুরুকে নিয়মিত স্মরণ করেন।