‘গল্পটা আমাদের সবার চেনা’

সোমবার রাতের কথা। যমুনা ব্লকবাস্টার সিনেমাসে ছিল ‘মৃধা বনাম মৃধা’ ছবির প্রিমিয়ার শো। শোর আগে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান, যেখানে অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজকেরা কথা বললেন। ছবি দেখার আগে নিজের ছবি নিয়ে অনেক বড় ফিরিস্তি দেননি রনি ভৌমিক। বিনয়মাখা কণ্ঠে কেবল বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই মিলে এই চেষ্টা করেছি। আগে দেখি। পরে মতামত শুনব।’

যমুনা ব্লকবাস্টার সিনেমাসে ছিল ‘মৃধা বনাম মৃধা’ ছবির প্রিমিয়ার শো
সংগৃহীত

ছবির প্রদর্শনী হয়ে গেল। শেষও হলো। রনি ভৌমিকের কি মতামত শোনার আর দরকার আছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে সিনেমাটির অভিনেতা তারিক আনাম খান আর সিয়াম আহমেদের একটি ছবি। দুজনের চোখে জল। তারিক আনাম খানের কাঁধে মাথা সিয়ামের। যেন বাবার কাঁধে ছেলের মাথা। ছবিতে তাঁরা বাবা–ছেলেই। নিজেদের গল্পটা এতটাই ছুঁয়ে গেছে তাঁদের, প্রদর্শনীর পরে এক অপরকে জড়িয়ে ধরলেন আবেগে অশ্রু ছেড়ে। আর দর্শক? যতটুকু চোখে পড়েছে, ভেজা চোখই ছিল অনেকের। সিনেমা হল ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় অজান্তেই কারও মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল, ‘অনেক দিন পরে একটা পারিবারিক গল্পের ছবি দেখলাম।’

বাবা–ছেলের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নিয়ে ছবির গল্প। গল্পটি এই শহরের। প্রত্যেকটি পরিবারের। কীভাবে এই গল্প মাথায় এসেছিল পরিচালকের? রনি ভৌমিক বলেন, ‘আমার ব্যাক পেইন ছিল। একদিন খুবই বাজে অবস্থায় পড়ি। হাসপাতালে যাই। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করিয়ে দেখলাম যে আমার ব্যাপক ঝামেলা আছে। তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। কারণ, স্বপ্ন ছিল সিনেমা বানাব।’

একটা সময় ছিল পারিবারিক গল্পের ছবিই ছিল বাংলা সিনেমার প্রাণ। দীর্ঘদিন সিনেমা হলে সেই আবহ নেই। রনি চাইলেন পরিবারকেই ফের তিনি আনবেন সিনেমা হলে

সেই স্বপ্নপূরণে যোগাযোগ করলেন রায়হান খানের সঙ্গে। এই ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য তাঁর। তাঁকে বললেন, ‘ভাই আমার জীবনে একটাই স্বপ্ন ছিল সিনেমা বানানো। এখন কী হবে?’ রায়হান খান অভয় দেন। দুজনের কথা চলে। স্বপ্ন নির্মাণে পথচলা শুরু হয়। কিন্তু কী নিয়ে হবে সিনেমা? দীর্ঘদিন ছবি তৈরি হচ্ছে না। যা হচ্ছে তাতে দর্শকও খুব একটা টানছে না। তার মধ্যে আছে করোনার হানা। এমন একটা সময়ে প্রথম সিনেমায় কী গল্প বুনতে চান রনি? তিনি বললেন, ‘আমরা এমন একটা সিনেমা বানাতে চাইলাম, যেখানে একটা মেসেজ থাকবে। শুধু প্রেম–ভালোবাসার গল্প, অ্যাকশন, থ্রিলার না করে, আমরা এমন একটা গল্প বলতে চাই, যেটা আমাদের সবার চেনা।’

একটা সময় ছিল পারিবারিক গল্পের ছবিই ছিল বাংলা সিনেমার প্রাণ। দীর্ঘদিন সিনেমা হলে সেই আবহ নেই। রনি চাইলেন পরিবারকেই ফের তিনি আনবেন সিনেমা হলে। ‘আমি একটা বিজ্ঞাপনের কাজ করছিলাম। আমাকে নোভা (ছবির অভিনেত্রী) বলল, “বাবা আর ছেলেকে নিয়ে একটা গল্প বললে কেমন হয়?” আমি বললাম, আচ্ছা। সেখান থেকে ছবি পর্যন্ত সব রায়হান ভাইয়ের কীর্তি।’ রনির ভাষ্য।

বাবা–ছেলের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নিয়ে ছবির গল্প

তবে শুধুই কি চিত্রনাট্যকারের হাতেই তৈরি হয়েছে গল্পটি! নির্মাতা রনির ব্যক্তিগত আবেগও মিশে আছে এখানে। রনি বলেন, ‘আমার বাবা নেই। সেই ইমোশনের জায়গা থেকেও গল্পটা বলতে চেয়েছি।’

গতানুগতিক নায়ক–নায়িকাধর্মী সিনেমা করার ইচ্ছা ছিল না নির্মাতার। তাই শিল্পী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও ছিল ভিন্নতা। ছবিতে নিলেন সিয়াম–নোভা জুটিকে। এ জুটি নেওয়ার কারণ কী? রনি বলেন, ‘আমি জানি এই প্রশ্নটা অনেকেই করবে। এমনকি নোভা নিজেও আমাকে এটি করেছে। আমি নোভাকে বলেছিলাম, আমি এই মেয়েটাকে এমন একটা মেয়ে হিসেবে দেখি, যে খুব সাধারণ। যাকে দেখলে আমার বিশ্বাস হবে যে এ আমার ঘরের বোন, স্ত্রী। সিয়ামের বেলাতেও তাই। আমি চাইনি সিয়াম এখানে হিরো থাকুক। আমি চেয়েছি সে শহরের অন্য ছেলেদের মতোই একজন ছেলে হিসেবে রুপালি পর্দায় আসুক। আমাদের প্রত্যেকেরই যে পারিবারিক জার্নি, সেটা উঠে আসুক।’ অভিনেত্রী নোভা ফিরোজের মন্তব্যও তাই। তিনি প্রিমিয়ারে বলেছিলেন, ‘ফিল্ম দেখি আসলে গল্প দেখার জন্য। নায়ক–নায়িকা যত চরিত্র আছে, সব আসলে সেটার একটা অর্নামেন্ট মাত্র।’

এই ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বাবা। বাবা চরিত্রে তারিক আনাম খানকে কাস্ট করার গুরুত্ব কোথায়? রনি ভৌমিকের ভাষায়, ‘আমি বাবা চরিত্রটাকে এভাবেই তৈরি করেছি যে এমন একজন বাবা লাগবে, যাকে নিয়ে আসলে ইরিটেটিংয়ের শেষ নেই। আবার সে এমন হবে, যার প্রতি আমাদের ইমোশনও কাজ করবে। তারিক ভাইকে প্রস্তাব দিতে একটু ভয়ও ছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হয়েছে গল্পটি শোনার পরে সবচেয়ে বেশি ইন্সপায়ার করেছেন তারিক ভাই। গল্পটা শোনার পরে, তিনি বললেন, চল করে ফেলি।’

ছবিটি দেখতে দর্শকের কাছে তাঁর আহ্বানে সেটি বোঝা গেল। তারিক আনাম খান বলেন, ‘এ সময় চলচ্চিত্রের যখন একটা মন্দা অবস্থা যাচ্ছে, তখন এই ছবি এসেছে। আপনাদের সবার শুভকামনা আমরা চাই। যাঁরা দেখবেন, তাঁরা বলবেন, যত দিন ছবিটি চলবে, সবাই হলে গিয়ে যেন ছবিটি দেখেন। তাহলেই আমাদের চেষ্টা ও পরিশ্রম সার্থক হবে।’

নিজেদের গল্পটা এতটাই ছুঁয়ে গেছে তাঁদের, প্রদর্শনীর পরে তারিক আনাম খান ও সিয়াম আহমেদ একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন আবেগে অশ্রু ছেড়ে

রনি ভৌমিক একটা পরিবারিক ছবি উপহার দিতে চেয়েছিলেন। সেই ছবি এসেছে। তা বোঝা গিয়েছিল সিয়ামের কথায়। প্রায় প্রত্যেক সাক্ষাৎকারেই সিয়াম আহ্বান করেছিলেন দর্শককে, যেন বাবাকে নিয়ে দেখতে আসেন ছবিটি। সিয়ামের বাবাও এসেছিলেন প্রিমিয়ারে। ছবি শেষে বাবার চোখ ছিল ভেজা। ছবির নির্মাতা প্রিমিয়ারের শুরুতে ছবি দেখার পরে দর্শকের মতামত শুনতে চেয়েছিলেন। রনি ভৌমিককে একটা মন্তব্য দিয়েই শেষ করা যাক। তবে সেটি সাধারণ কোনো দর্শকের নয়। একজন পরিচালকের। নির্মাতা তৌকীর আহমেদ সেদিন সিনেমা দেখতে বসেছিলেন দর্শক হিসেবে। সিনেমা দেখে প্রতিক্রিয়া জানালেন এভাবে, ‘পরিচালক একটা পারিবারিক বিষয়কে তুলে নিয়ে এসেছেন এবং তা খুব নিটলভাবে পর্দায় প্রেজেন্ট করেছেন। এখানে যেহেতু সম্পর্কের গল্প, সম্পর্কের সেই জায়গাটুকু অভিনয়ের কারণে আরও সুন্দর হয়েছে। তাই সবার ভালো লেগেছে।’

ছবিতে আরও দেখা যাবে নিমা রহমান, সানজিদা প্রীতি, তৌফিকুল ইসলাম প্রমুখকে। গল্প ও চিত্রনাট্য করেছেন রায়হান খান। বাবা–ছেলের আবেগ–ভালোবাসা আর পুত্রবধূর সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে টফি প্রযোজিত ‘মৃধা বনাম মৃধা’। আশফাক মৃধা তাঁর বাবা ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কর্মকর্তা। অফিস থেকে প্রমোশন নিয়ে সুইডেনে যাওয়া নিয়ে বিপত্তি ঘটে বাবা–ছেলের। তা গড়ায় কোর্ট পর্যন্ত। এই লড়াইয়ে জিতবে কে? দেখতে ২৪ ডিসেম্বর শুক্রবার থেকে যেতে হবে সিনেমা হলে।