অনেক দিনের জন্য স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই বেরিয়ে গেছে। দরজায় তালা মেরে চলে গেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। একটি ছেলে বাথরুমে গিয়ে আটকে যায়। তাঁকে উদ্ধার করতে কেউ আসে না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় সে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাঁর মৃত্যু গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বিয়োগান্ত গল্পের ছবি ‘ছুটির ঘণ্টা’ দেখতে গিয়ে আজও দর্শকেরা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। যাঁর অভিনয়ের গুণে স্কুলছাত্রটি জায়গা করে নিয়েছিলেন সবার হৃদয়ে, তিনি সুমন সাহা। আশির দশকের জনপ্রিয় শিশুশিল্পী।
‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির গানে গানে তিনি বলেছিলেন, ‘একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাব’। অভিনয় থেকে ছুটি নিয়ে সুমন সাহা চলে গিয়েছিলেন সাত সাগর তেরো নদীর ওপারে। তখন তাঁর বয়স ২২ বছর। ১৯৯০ সাল। তারপর ৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন ‘অশিক্ষিত’ ছবির মাস্টারসাব। দর্শকদের চোখে শিশুশিল্পীর ইমেজে আটকে থাকলেও সুমন সাহা এখন পরিণত মানুষ। স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে ফ্লোরিডায় তাঁর সংসার। বড় মেয়ে শ্রেয়সী সাহা ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছেন। ছোট মেয়ে সঙ্গীনি সাহা একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পথে।
সুমন সাহা অরল্যান্ডো বিমানবন্দরে চাকরি করেন। ‘বাজেট রেন্ট -এ-কার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার তিনি। চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও রয়েছে তাঁর। সুমনের ছোট ভাই সংগীত পরিচালক ইমন সাহা। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ মিলিয়ে থাকেন। তাঁদের মা রমলা সাহা কখনো বড় ছেলের সঙ্গে, কখনো ছোট ছেলের সঙ্গে থাকেন। সুমন সাহা জানান, তাঁর বাবা সুরকার সত্য সাহা ১৯৯৯ সালে মারা যান। শুধু তখনই ৪/৫ বছর ঢাকায় ছিলেন তিনি। সেই সময় তাঁদের পারিবারিক প্রযোজনা সংস্থা ‘স্বরলিপি’ থেকে একটি সিনেমাও প্রযোজনা করেছিলেন। তিনি ও তাঁর বন্ধু রাজন মিলে রিয়াজ-শাবনূর অভিনীত ‘তোমার জন্য পাগল’ ছবিতে বিনিয়োগ করেছিলেন। ছবিটি ২০০৩ সালের ঈদে মুক্তি পেয়েছিল।
সিনেমার সঙ্গে সেই তাঁর শেষ সংযোগ। তারও আগে ১৯৮৮ সালে শেষ অভিনয় করেছিলেন নিজেদের ব্যানারের ছবি ‘রাম রহিম জন’- এ। তিনি মাত্র ১০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। অভিনয় করেছেন কিছু বেতার নাটকে। দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি আশির দশকে তারকাখ্যাতি ভোগ করতেন। যে খ্যাতির রেশ এখনো রয়ে গেছে। যতবারই দেশে আসেন টেলিভিশনের নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয় তাঁকে। সেগুলো মূলত তাঁর শিশুশিল্পী জীবনের স্মৃতিচারণা। যুক্তরাষ্ট্রেও একই হাল। ফ্লোরিডায় প্রবাসীদের যেকোনো সাংস্কৃতিক আয়োজনে তাঁকে মনে করা হয়। মঞ্চে টুকটাক পারফর্মও করতে হয়। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে তাঁর পরিচিতি তো আছেই, মার্কিন সহকর্মীরাও তাঁর ‘প্রাক্তন’ শিল্পী পরিচয় সম্পর্কে জানেন। এ নিয়ে তাঁরা গর্বও করেন। তাঁকে নিয়ে গর্ব করেন স্ত্রী শুভ্রাসহ দুই মেয়েও।
মেয়েরা কি কখনো প্রশ্ন করেন, কেন তিনি অভিনয় ছাড়লেন? সুমন সাহা বলেন, ‘মেয়েরা ছোট থেকেই দেখে আসছে তাদের বাবাকে নানা রকম অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। তারা এও জানে, বাবা তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই এ দেশে থেকে গেছে। প্রথম প্রবাস জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছে। সবাইকেই এ দেশে এলে সেটা করতে হয়। হয়তো দেশে থাকলে জীবনটা আরও আরামের হতো। খ্যাতির সুখ পাওয়া যেত। ওদের জন্যই যে এ দেশে থাকা, এটা ওরা জানে। ওরা আমার সিদ্ধান্তকে অ্যাপ্রিশিয়েটও করে।’ তিনি জানান, তাঁর মেয়েদের কেউ অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। তবে সাংস্কৃতিক পরিবারে বেড়ে ওঠায় সংস্কৃতির সঙ্গে ওরা একটা আত্মিক যোগাযোগ অনুভব করে। কাকা ইমন সাহার সঙ্গে ওদের বেশ সখ্য। ভালো কোনো গান হলে কাকা ওদেরকে শোনান।
সুমন সাহার স্ত্রীও সংস্কৃতিমনা। তিনি একসময় নাচ করতেন। সুমন বলেন, ‘ও বোম্বেতে থাকত। ভালো নৃত্যশিল্পী ছিল। আমি অ্যালবামে ওর নাচের ছবি দেখেছি। কখনো নাচতে দেখিনি।’ সুমন বিয়ে করেন ১৯৯৬ সালে। সুমনের এক পিসি থাকতেন বোম্বেতে। সেখানেই শুভ্রা সাহার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ‘শুভ্রাদের আদি বাড়ি বিক্রমপুরে। ১৯৬৫ সালের দাঙ্গার পর তাঁর বাবা ভারতে চলে গিয়েছিলেন। শুভ্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এই বিক্রমপুরের কথার সূত্র ধরেই। ওদের ভিটে ছিলে এখানে, ওরা দেশ ছেড়েছিল, এসব কথা ধরেই ওর সঙ্গে আলাপ বাড়ে। ধীরে ধীরে সেটা প্রেম হয়ে যায়। তারপর বিয়ে। ও আমার সব কাজের অনুপ্রেরণা। যে প্রজেক্টে হাত দিই না কেন, ও আমার পাশে থেকেছে, আমার ওপর আস্থা রেখেছে। আমার অভিনয়ের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত, সেটাকে ও সব সময়ই সমর্থন করেছে।’ এমনটিই জানালেন সুমন সাহা।
সিনেমা ছাড়লেও অভিনয় আজও তাড়া করে ফেরে সুমন সাহাকে। হঠাৎ করে পরিচিতজনের ফোন আসে, ‘সুমন, টিভি খোলো। তোমার ছবি প্রচার হচ্ছে।’ আর পরিচিত গণ্ডির সবাই জানে, তাঁর একটা তারকা-অতীত আছে। অভিনেতা পরিচয়টা ভোলা তাই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। যদিও অভিনয়ে আর ফেরার সম্ভাবনা নেই সুমনের। তবে পরিচালনায় আসার ইচ্ছে আছে। অন্তত একটা ছবি পরিচালনা করবেন তিনি। তার জন্য কি কোনো প্রস্তুতি নিচ্ছেন? সুমন বলেন, ‘আমি শখের বশে পরিচালনা করব। সে রকম কোনো প্রস্তুতি নিচ্ছি না। যখন অভিনয়ে ছিলাম, আমাদের হাউসের ছবিগুলোর শুটিং-ডাবিং দেখেছি। নিজে ক্ল্যাপস্টিক ধরেছি। এটা-ওটা এগিয়ে দিয়েছি। সাহায্য করেছি। হয়তো অফিশিয়ালি সহকারী ছিলাম না। তবে সিনেমার সব রকম কাজ দেখেছি।’
ছবির গল্প নিয়ে ছোট ভাই ইমন সাহার সঙ্গে প্রায়ই কথাবার্তা হয় সুমন সাহার। নিজেদের ব্যানারের ছবিগুলোর স্বত্ব এখনো ধরে রেখেছেন তাঁরা। একটি-দুটি ছাড়া সব ছবির মালিকানা এখনো তাঁদের কাছে। নিজেদের প্রোডাকশন হাউস থেকেই ছবিটি নির্মিত হবে। সে ক্ষেত্রে নিজেদের পুরোনো কোনো ছবির রিমেক কি হতে পারে? ‘ছুটির ঘণ্টা’র রিমেক কেন নয়? সেই সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সুমন সাহা। তিনি জানান, অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে ‘ছুটির ঘণ্টা’ তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। এটার রিমেক দিয়ে পরিচালনায় আসতে পারলে তিনি খুশিই হবেন।