‘ঘুড্ডি’ সিনেমার গানের দৃশ্যে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা
‘ঘুড্ডি’ সিনেমার গানের দৃশ্যে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা

এক শটে ওকে হয়েছিল অসাধারণ সে দৃশ্য

‘আজ কেবল মনে পড়ছে “ঘুড্ডি”র কথা। “ঘুড্ডি”! আহা! সেই যে একদা পরিচালনা করেছিলাম ছবিটি, সেই “ঘুড্ডি” ছবির মধ্যে কত স্মৃতিসুধা, কত কিছু যে লুকিয়ে আছে।’
‘ঘুড্ডি’ ছবি নিয়ে এক স্মৃতিচারণায় এমনটা লিখেছিলেন পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী। আজ ১৯ ডিসেম্বর। ‘ঘুড্ডি’ মুক্তির চল্লিশ বছর পূর্তি। এ কথা মনে করিয়ে দিতেই অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা বললেন, ‘তাই নাকি! “ঘুড্ডি” ছবিটা ৪০ বছর আগে তৈরি হলেও এর আবেদন আজও শেষ হয়নি। গানগুলোর কথা যদি বলি, “আবার এল যে সন্ধ্যা”, “কে বাঁশি বাজায় রে”, “ঘুম ঘুম ঘুম চোখে দেয় চুম” এখনো রিমেক হচ্ছে। এটি একটি মাইলস্টোন মুভি। ট্রেন্ডসেটার সিনেমা।’

‘ঘুড্ডি’ সিনেমার গানের দৃশ্যে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা

স্মৃতির জানালায় টোকা দিতেই সামনে আসে শুটিংয়ের দিনগুলো। পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকীর স্মৃতিচারণায় জানা গেল শুটিংয়ের শুরুর দিকের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘এক শুক্রবার শুটিংয়ের কল দেওয়া হয়। প্রথম দিনের শুটিং। সবাই প্রস্তুত—সুবর্ণা মুস্তাফা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, ফরিদ আলী, তারিক আনাম খান, লাকী আখান্দ্, হ্যাপী আখান্দ্, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ক্যামেরার শফিকুল হক স্বপন, সম্পাদক সাইদুল আনাম টুটুল, সহকারী বিকাশ দত্ত আরও অনেকে।

সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী

তিনটি গাড়ি—একটা চালাচ্ছে স্বপন, ওরই গাড়ি। পাশে আমি, পেছনে সুবর্ণা, আসাদ। আরেকটি চালাচ্ছে ফরিদ আলী, আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু। ওর গাড়ি আমাকে দিয়েছিল শুটিংয়ের জন্য।

ক্যামেরা আর লটবহর আছে শেষ গাড়িতে! গাড়িতে উঠে চোখ বুজে বললাম, চল নারায়ণগঞ্জ স্টিমারঘাটে। ঘাটে পৌঁছে শীতলক্ষ্যা পার হলাম, পরিত্যক্ত সোনাকান্দা দুর্গ, পৌঁছে গেলাম! পথে সুবর্ণা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, “চরিত্রটা কী, বললেন না তো?” কী জবাব দেব? আমি নিজেই জানি না! হুট করে বললাম, এই ধর তুই স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী, কেমন?সুবর্ণার প্রতিক্রিয়া দেখতে পাইনি পেছনে তাকিয়ে। এবার আসাদের পালা। ভরাট গলায় তার প্রশ্ন, “আর আমি?” জবাব না ভেবেই দিলাম, তুই? তুই আসাদ, আসাদই! যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়ে হাতটা খালি, শহর চাষ করে বেড়াস।

‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় সুবর্ণা মুস্তাফা

ও কী বুঝল, জানি না! ছোট্ট করে প্রতিক্রিয়া দিল, “হু।” দুর্গে পৌঁছে ক্যামেরা বসিয়ে সুবর্ণাকে বললাম, তুই ক্যামেরার ডান দিক দিয়ে ইন করে ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবি, আর আসাদ বাঁ দিক দিয়ে, দুজনই ব্যাক টু ক্যামেরা, কেমন? ওদের জীবনের প্রথম শট, ব্যাক টু ক্যামেরা। অবশ্য ওদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, অভিনয়জগতের সিঁড়ি দিয়ে পৌঁছে গেছে ধ্রুবতারার জগতে। সুবর্ণা ওই দিন থেকে চলনে-বলনে পাক্কা আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টির ছাত্রী বনে গেল।’

‘ঘুড্ডি’ সিনেমার দৃশ্য

পরিচালকের স্মৃতিচারণায় আরেক দিনের কথা উঠে আসে। ছবির শেষ সময়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এক বিকেলের কথা। তিনি স্মৃতিচারণা করেন এভাবে।

‘আউটডোর, স্বল্প বাজেট, অল্প ম্যাটেরিয়াল নিয়ে গিয়েছি কক্সবাজারে! শেষ দিন, শেষ বেলা। আর থাকার পয়সা নেই আমাদের। কিন্তু মাথায় আছে লম্বা একটি সিকোয়েন্স। এক টেকে ওকে করতে হবে। কারণ, আর ম্যাটেরিয়াল নেই।’

এই দিনের স্মৃতিচারণা করে সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, ‘এদিকে টাকা শেষ। শুটিং ফিল্ম যা আছে, তা–ও অল্প। আর নেই। জাকী ভাই দৃশ্যটা একবারেই শুটিং করতে চায়। কবিতাটা আমাকে দিল। বললাম, আমাকে একটু সময় দিতে হবে। এরপর কবিতা নিয়ে রুমে চলে গেলাম। লিখে লিখে মুখস্থ করলাম। পুরোটা মুখস্থ করে বিচে গেলাম। পুরো ইউনিট প্রস্তুত। আমি সামনে, আসাদ পেছনে—পুরোটা এক শট। সিনেমার চেয়েও সিনেম্যাটিক হচ্ছে, কবিতাটা শেষ হলো। ফিল্ম শেষ হওয়ার ক্র্যাক করে শব্দ হলো। আসাদ বালুর ওপর বসে হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। কারণ, ভীষণ আবেগের ব্যাপার ছিল। স্বপন ক্যামেরা সহকারীর হাতে দিয়ে, এক লাফে সমুদ্রে। ওই মুহূর্তের কথা বলে বোঝানো সত্যিই সম্ভব নয়।’

‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় সুবর্ণা মুস্তাফা

সেদিনের স্মৃতিচারণা করে পরিচালক বলেন, ‘ছোট্ট ইউনিট নিয়ে জিপে একটানে হিমছড়ি। সুবর্ণা প্রম্পট করতে মানা করল। ওর মুখাবয়বে কোনো টেনশন নেই, মুখটি আশ্চর্যজনকভাবে নিরুদ্বিগ্ন! এদিকে আমরা আছি ভীষণ দুশ্চিন্তায়। যদি ফিল্ম রানআউট হয় বা সুবর্ণা ভুল করে বসে, এনজি হয়, তবে আর উপায় নেই, মাঠে মারা যাবে সবকিছু। বিদায় সমুদ্রস্বপ্ন! সবাই চুপ!

শুধু দু-একটি গাঙচিল আকাশে যেন উন্মুখ উড়ছে সুবর্ণার সংলাপ শোনার জন্য। ওরাই তো পৌঁছে দেবে সুবর্ণার বার্তা দূর সমুদ্রের বুকে ভাসমান নাবিকের কাছে। দীর্ঘ সংলাপে তা-ই লেখা আছে। অতঃপর বললাম, অ্যাকশন। শট শুরু হলো। আমার কান সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে শুনতে চাইছে ওর কণ্ঠ-সংলাপ।

‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা

সুবর্ণা আনমনা এগিয়ে আসছে, পেছনে উদ্বিগ্ন আসাদ, ও বলতে চাইছিল কিছু একটা, কিন্তু সুবর্ণা তখন ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন জগতে, গাঙচিলের ডানায় অজানার সন্ধানে। ৩৫ মিলিমিটারের ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ব্যাক স্টেপ দিচ্ছে স্বপন। সন্দেহ নেই কাজটি কঠিন। একটু ঝাঁকি খেলে বা সুবর্ণা ভুল করলে অথবা শেষ মুহূর্তে এসে ফিল্ম রানআউট হলে তীরে এসে তরি ডুববে। রিটেকের আর অবকাশ নেই। শেষ দিকে কিছুই শুনতে পারছিলাম না কানে, এমনকি সমুদ্রের কণ্ঠও, সব ব্ল্যাঙ্ক, চারপাশে যেন ভয়াবহ শূন্যতা। স্বপন দাঁড়িয়ে গেছে, ওরাও। স্বপনের দিকে তাকিয়ে আমি সুবর্ণাকে বললাম, একটা কিছু বল...। আমার দিকে তাকাল স্বপন। তবে ওর মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। তবে কি শট সম্পূর্ণ হয়নি? এনজি? হায় সমুদ্র! তুই কী নিষ্ঠুর!

আচমকা স্বপন একটু হেসে বলল, “ওকে, বস।” ব্যস! আমি প্রায় হুংকার দিয়ে ঘোষণা দিলাম, ওকে ওকে ওকে। সুবর্ণা তখনো নিশ্চুপ-নিশ্চল দাঁড়িয়ে অভিব্যক্তি ধরে রেখেছে, যেন সে কিছু শুনতেই পায়নি।’

‘ঘুড্ডি’ সিনেমার শুটিংয়ের দৃশ্য

অভিনেত্রী ও সাংসদ সুর্বণা মুস্তাফা বলেন, ‘আমার মনে হয়, “ঘুড্ডি” ছবির ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমাদের এতগুলো সিনেপ্লেক্সের কেউ যদি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করত, আমি নিশ্চিত দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ছুটে যেত। ওই বয়সে যাঁরা তরুণ-তরুণী ছিলেন, তাঁরা যেমন যেতেন, নতুন প্রজন্মও যেত। আমাদের তরুণ মেধাবী পরিচালক যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরাও যেতেন। নস্টালজিয়ার ব্যাপার আছে। আমার সব সময় মনে হয়, “ঘুড্ডি” সময়ের আগের ছবি। “ঘুড্ডি” দেখলে ওই সময়ের ঢাকা শহর এবং ওই সময়কার জীবন আমরা দেখতে পাই। এই ছবিতে অতিরঞ্জিত কিছুই নেই। তখনকার তরুণ–তরুণীরা এ রকমই ছিল। আমার এক বন্ধু বলেছিল, “ঘুড্ডি ছবিতে ওই সময়ে যে ধরনের কস্টিউম পরলেন, এরপর বাংলাদেশের সিনেমার কী হলো! আমরা ওই সময়ে এমন কাপড়চোপড়ই পরতাম।”’