সরকারের অনুদান পাওয়া সিনেমা ‘চন্দ্রাবতী কথা’
সরকারের অনুদান পাওয়া সিনেমা ‘চন্দ্রাবতী কথা’

একুশে এলেন ষোড়শের চন্দ্রাবতী

খুব বেশি নয়, দেড় শ বছর আগেও এই ভূখণ্ডে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পক্ষে লেখালেখি করাটা সহজ ছিল না। সেখানে আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার শ বছর আগে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে পালা রচনা করেছেন এক নারী, ভাবা যায়? নাম ছিল তাঁর চন্দ্রাবতী। তিনি মধ্যযুগে লেখা মনসামঙ্গল কাব্যধারার অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা। মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা, রামায়ণ গীতিকা তাঁরই লেখা। কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারীতে ছিল তাঁদের নিবাস। তাঁর নিজের জীবনকাহিনিও তাঁর লেখা পালার চেয়ে কম নাটকীয় নয়। তাই তাঁকে নিয়েই লেখা হয়েছে একটি গীতিকা। মৈমনসিংহ গীতিকার সেই পালার নাম জয়-চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতীর সঙ্গে প্রতারণা করেন তাঁরই পার্শ্ববর্তী গ্রামের আরেক কবি জয়ানন্দ। ভাঙা মন নিয়ে চন্দ্রাবতী কঠিন ব্রত গ্রহণ করেন, বাকি জীবন অবিবাহিত থেকে মন্দিরেই আরাধনা করে কাটাবেন। বাবার পরামর্শে নিজ ভাষায় রামায়ণ লেখেন তিনি। সেই মধ্যযুগ থেকে এখন পর্যন্ত এই চন্দ্রাবতীকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক পালা। এবার তাঁকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র করলেন এন রাশেদ চৌধুরী।

আজ মুক্তি পাচ্ছে এন রাশেদ চৌধুরীর চন্দ্রাবতী কথা। ২০১৫ সালে সরকারি অনুদান পাওয়া ছবিটি শেষ হতে হতে ২০১৯ সাল হয়ে যায়। তারপর প্রায় দেড় বছর সেন্সর বোর্ডে ছবিটি আটকে ছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, ‘চলচ্চিত্রের স্ট্রাকচার ঠিক নেই।’ রাশেদ চৌধুরী তাদের জানান, ছবিটিতে তিনি হাজার বছরের বাংলা নাট্যরীতি অনুসরণ করেছেন। ব্যবহার করা হয়েছে পালাগানের কাঠামো, গল্পকথনরীতি। ব্যাখ্যা শুনে পরে ছবিটির অনুমোদন দেয় বোর্ড। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ২৫তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির বিদেশ প্রিমিয়ার হয়। পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও ছবিটি প্রদর্শিত হয়। কিন্তু দেশের মানুষই ছবিটি দেখতে পাচ্ছিল না। অবশেষে গত মঙ্গলবার রাজধানীর সীমান্ত স্কয়ারে স্টার সিনেপ্লেক্সে ছবিটির বাংলাদেশ প্রিমিয়ার হয়।

চন্দ্রাবতীর জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারীতে হয়েছে ছবির বেশির ভাগ দৃশ্যের শুটিং

চন্দ্রাবতীর জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারীতে হয়েছে ছবির বেশির ভাগ দৃশ্যের শুটিং। সে গ্রামের সাধারণ মানুষও ছবিতে অভিনয় করেছে। বিশেষ করে পালাকার বা বয়াতি চরিত্রগুলোতে সেখানকার মানুষই অভিনয় করেছেন। অংশ নিয়েছেন খোকন বয়াতি ও তাঁর দল, শংকর গায়েন, লাল মাহামুদ ও তাঁর জারির দল। নির্মাতা রাশেদ চৌধুরী জানান, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্রাবতীর জন্মস্থান ছাড়াও ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার অন্যান্য এলাকায় বিভিন্ন ঋতুতে শুটিং হয়। ভারতে হয়েছে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ। গবেষণা, শুটিং পূর্বপ্রস্তুতি, শুটিং, পোস্ট প্রোডাকশন—সব মিলিয়ে ছবিটি শেষ করতে পাঁচ বছরের মতো সময় লেগেছে।

এন রাশেদ চৌধুরী

চন্দ্রাবতী কথার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিলরুবা দোয়েল। কাজটা তাঁর কাছে ‘অসাধারণ অভিজ্ঞতা’। তাঁর বিবেচনায় অসাধারণ একটি টপিক। তিনি বললেন, ‘প্রিমিয়ার ছাড়াও ফেসবুকে সবাই ছবিটি নিয়ে কথা বলছে। মোরশেদুল ইসলাম ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ স্যাররাও ছবিটি নিয়ে কথা বলেছেন। এগুলো আমার জন্য ভীষণ অনুপ্রেরণার। আমি নার্ভাসও।’ সোনাই চরিত্রটি করেছেন কাজী নওশাবা। তিনি বলেন, ‘এ ছবিতে অভিনয়ের আগে পাঁচবার অডিশন দিতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ছবিতে আমাকে কতটা রাখা হয়েছে, জানি না। তবে এই ছবির জন্য নিজেকে তৈরি করতে অনেক পড়েছি, সমৃদ্ধ হয়েছি। এ ছবির পরিচালক খুঁতখুঁতে, আমি নিজেও তা–ই। সব মিলিয়ে ভালো একটা কাজ হয়েছে।’

ছবিতে আরও অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, গাজী রাকায়েত, আরমান পারভেজ মুরাদ, এহসানুর বর্ষণ, তনয় বিশ্বাস, শশাংক সাহা, মিতা রহমান, জয়িতা মহলানবিশ প্রমুখ।

আজ মুক্তি পাচ্ছে এন রাশেদ চৌধুরীর চন্দ্রাবতী কথা

ছবিটি দেখেছেন এমন কয়েকজন দর্শকের অভিমতও জানা গেল। নাট্যকলার শিক্ষার্থী কামরুজ্জামান কমল বলেন, ‘আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনয়, ডিজাইন, আলো, নির্দেশনা নিয়ে পড়াশোনা করি এবং স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সমৃদ্ধ করবে এই চলচ্চিত্র।’ আরেক দর্শক কামরুল আহসানের মতে, ‘এর চেয়ে ভালো ছবি হয়তো অনেকই আছে, শিল্পের ক্ষেত্রে ভালো বিষয়টা আপেক্ষিক; কিন্তু এ ছবি যত বিষয় ধরে আছে, যে ভাষাভঙ্গিতে গল্পটা বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা অভিনব। যেন একটা সুর উঠছে, একটা তাল রক্ষা করে ছবির গল্পে এগিয়ে যায় চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সের দিকে।’ লাবণী আশরাফ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে যখন বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ পড়েছিলাম, তখন মনে হতো, আরে আমাদের সিনেমার শৈলীতে এর প্রয়োগ নেই কেন, সেই খেদ মিটিয়েছে চন্দ্রাবতী কথা। নিঃসন্দেহে বাংলা সিনেমায় চন্দ্রাবতী কথা এক নতুন সংযোজন।’

১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিটের ছবিটি এর মধ্যেই কয়েকবার দেখে ফেলেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তাঁর কাছে কেমন লাগল চন্দ্রাবতী কথা? ‘অদ্ভুত প্রাণবন্ত ছবি। দেখলেই মনে একধরনের শান্তি আসে, এত সফট!’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী এ নির্মাতা বলেন, ‘বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতিতে প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ কোনো চলচ্চিত্র দেখলাম। যে কাজ সেলিম আল দীন, আমি, আমরা দীর্ঘদিন নাটকে করে আসছিলাম। সর্বোপরি ছবিটা দেখে আমার কাছে সফল দৃশ্যকাব্য মনে হয়েছে।’

নতুন উপস্থাপনার ‘প্রাণবন্ত’ ছবিটি দেখতে দর্শক যাবেন—এমন প্রত্যাশা করেন নির্মাতা। সে প্রত্যাশা আমাদেরও। শুভকামনা, ‘চন্দ্রাবতী কথা’।

গবেষণা, শুটিং পূর্বপ্রস্তুতি, শুটিং, পোস্ট প্রোডাকশন—সব মিলিয়ে ছবিটি শেষ করতে পাঁচ বছরের মতো সময় লেগেছে