বৃষ্টি, কাদা মেখে রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে যখন ঢুকলাম, ঘড়িতে তখন পৌনে একটা। বড় পর্দায় ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ থেকে ১৫ মিনিট দূরে। লিফটম্যানের কাছ থেকে খোঁজখবর জানতে চাইলে বললেন, ‘কুথাও করোনা নাই আপা। সবাই নরমালের মতোই কিনাকাটা করতেছে। শুক্রবার আর বৃষ্টি বলে একবারে লিফট পাইলেন। না হলে লম্বা সময় লাইনে দাঁড়ায়ে থাকা লাগত।’
দীর্ঘদিন পর সিনেপ্লেক্সের সামনে চেনা হইচই, পোস্টারের সামনে ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক আর পপকর্নের ঘ্রাণ মিলেমিশে একাকার। বেশির ভাগ মানুষের মুখে মাস্ক ছিল। টিকিটের লাইনে বারবার নিরাপত্তারক্ষী এসে সামাজিক দূরত্বের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। হলে ঢুকে সিট খুঁজে নিয়ে বসতে বসতে দেখি, পর্দায় নীরারূপী শার্লিন ফারজানার ফাইনাল ইয়ারের প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশন প্রায় শেষ। প্রজেক্ট পছন্দ হয়নি শিক্ষকের...। যাহ, শুরুটা মিস হয়ে গেল!
এই ছবির মূল চরিত্র দুজন। নীরা আর অয়ন। নীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সে বাবার গাড়ি নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অয়নকে দেখে। অয়ন যে বাড়িতে থাকে, সেই পাড়ার মোড়ের দোকানে বান্ধবী নিয়ে চা খায়। তারপর রাস্তার মাঝখানে অয়নকে ডেকে ব্যাগ থেকে গরম চায়ের জার বের করে গ্লাসে ঢেলে চা আর টোস্ট বিস্কুট খায়। হুট করে বৃষ্টির দিনে দুহাত ভরে খাবারের প্যাকেট নিয়ে হাজির হয় অয়নের বাসায়। অয়নের কাপড় কেচে দেয়। পরদিন বেড়াতে গিয়ে ল্যাবরেটরির দুই বোতলে নিজের আর অয়নের নিশ্বাস ভরে বিয়ে দেয়। অয়ন যখন বলে, ‘আপনি একটু পাগল আছেন’, তখন বলে, ‘আমি একটু না, পুরোটাই পাগল।’ বাংলা সিনেমায় এর আগে এ রকম প্রেমিকার দেখা মেলেনি।
অয়ন কোত্থেকে এল, তার মা–বাবা কে, তা কেউ জানে না। পেশায় সে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। অসহায় রোগীরা যেন অয়নের বড় কাছের আত্মীয়। নিজের সবকিছু দিয়ে সে অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তাঁর সঙ্গে নীরার দেখা ঢাকা শহরের কোনো এক ব্যস্ত রাস্তায়, শত মানুষের ভিড়ের ভেতর। অয়নের প্রেমটাও হলো সদরঘাটের কোলাহলে, ফার্মগেটের ওভারব্রিজের মাঝখানে আর একমাত্র হেলমেটটা নীরার মাথায় চাপিয়ে ‘ভটভটি’ চালাতে চালাতে।
ছোট পর্দার গুণী নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের কাছ থেকে দর্শকের প্রত্যাশার পারদ ছিল ঢাকা শহরের উঁচু উঁচু দালানকোঠার মতোই উঁচুতে। সেই প্রত্যাশা তিনি পূরণ করেছেন বললে বাড়াবাড়ি হবে না। সিনেমায় একাধিক দৃশ্যে তালি পড়েছে। চমৎকার সব সংলাপ। সেখানে রসবোধ, আবেগ আর যুক্তির সমন্বয় আছে। অভিনয়ের বাড়াবাড়ি নেই। বিশেষ করে অয়ন চরিত্রে ইমতিয়াজ বর্ষণের অভিনয়ের উঁচু–নিচু গ্রাফ হল থেকে বের হওয়ার পরেও আপনার মনে লেগে থাকবে। পাল্লা দিয়ে অয়নের সঙ্গে পর্দায় জায়গা করে নিয়েছে ফারজানা শার্লিনের শরীরে জীবন্ত হওয়া নীরা। সাউন্ড আর মিউজিকও কানে, মনে ভালো অনুভূতি দিয়েছে। গানের কথা সিনেমার গল্পের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, মানানসই।
কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি নেই। ঢাকা শহর যেমন, তেমনইটাই দেখানো হয়েছে। পোশাক, মেকআপে কড়াকড়ি নেই। নীরার দুই বন্ধু অর্থি আর সিয়ামের চরিত্রের অভিনয়ও বেশ সাবলীল। প্রথম অর্ধেক এ গল্পের গাঁথুনি তরতর করে এগিয়েছে। কখন যে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পেরিয়ে গেল টের পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় অর্ধেক দেখতে বসে আপনি হাসবেন, কাঁদবেন, তবে এর মধ্যে কিঞ্চিৎ খেইও হারিয়ে ফেলতে পারেন। একটি প্রেমের সিনেমা ধীরে ধীরে কিছুটা সায়েন্স ফিকশন, কিছুটা ভৌতিক আর সামাজিক বার্তা নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু শেষটায় আপনি জানবেন সব ছাপিয়ে এটি একটি তুমুল প্রেমের সিনেমা। প্রেমের এমন শৈল্পিক, জেন্ডার রোলের ক্ষেত্রে বৈকল্পিক উপস্থাপন বাংলাদেশের বড় পর্দায় সেভাবে চোখে পড়ে না।
দ্বিতীয় অর্ধেক খানিকটা ধীর। কিঞ্চিৎ খাপছাড়া কি? পরিচালক যদি ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের ছবিটাকে ২ ঘণ্টা ১৫–২০ মিনিটের ভেতর বেঁধে ফেলতেন, তাহলে হয়তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পের প্রবাহ আর দর্শকের মনোযোগ এতটুকু পড়ত না।
সব মিলিয়ে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিনেমাটা দেখে ফেলুন। ঢাকায় সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার আর চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিনে চলছে ছবিটি। টিকিটের টাকা গচ্ছা যাবে না। হল থেকে বের হয়ে সবটা ভুলে যাবেন না। বেশ কিছু দৃশ্য, সংলাপ আর সামাজিক বার্তা আপনাকে মনের ভেতরে মুড়ে বাড়ি নিয়ে যেতেই হবে।
বাচ্চাদের যেমন কলার ভেতরে ওষুধ লুকিয়ে খাওয়ায়, এই সিনেমায় পরিচালক একইভাবে প্রেমের গল্পের ভেতর চুপটি করে সামাজিক বার্তা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখানেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন এই নির্মাতা। কী সেটা? জানার জন্য তো ছবিটি দেখতে হবে আপনাকে।