আজ শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে নতুন কাহিনিচিত্র রূপসা নদীর বাঁকে। গতকাল বৃহস্পতিবার শিল্পকলা একাডেমির মূল মিলনায়তনে ছিল ছবিটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী। একজন ত্যাগী বামপন্থী নেতাকে ঘিরে এ সিনেমার গল্প। ১৯৭১ সালে ওই নেতাকে হত্যা করে রাজাকাররা।
বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন বামপন্থী রাজনীতিকেরা। সার্বিকভাবে সমাজের প্রগতির লক্ষ্যে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও বামপন্থীদের অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। তাঁদের জেল-জুলুম–নির্যাতনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ধরে রাখার চেষ্টা রয়েছে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ ছবিতে।
প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টার এ ছবিতে তিরিশ দশকের স্বদেশি আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, রাজশাহী জেলখানার খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্টদের হত্যাসহ উল্লেখযোগ্য নানা ঘটনা একজন বিপ্লবীর জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরা হয়েছে।
২ ঘণ্টা ১৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি গড়ে উঠেছে মূলত খুলনা জেলার রূপসা নদীর পারে কর্ণপাড়া গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত বামপন্থী বিপ্লবী নেতা নেতা মানবরতন মুখোপাধ্যায়ের জীবন নিয়ে। কৃষক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কারণে এলাকার সবার কাছে ক্রমে ‘কমরেড মানবদা’ নামে পরিচিত ও সম্মানিত হয়ে উঠেছিলেন মানবরতন মুখোপাধ্যায়।
প্রথমে ব্রিটিশ সরকার ও পরে পাকিস্তান আমলে জেল-জুলুম-নির্যাতন ও নানা সংগ্রামের মধ্যে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন কাটে মানবরতন মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর জীবনের এক বড় অর্জন ছিল ডাকাতিয়ার বিলে বাঁধ দিয়ে কৃষকদের জন্য হাজার হাজার বিঘে কৃষিজমি উদ্ধার করা।
আর সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতাটা হলো ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে জেলবন্দীদের গুলি করে মারার ঘটনাটি, যে ঘটনার তিনি ছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
১৯৪৭–এর দেশভাগের পরে একে একে ভারতে চলে যেতে থাকেন মানব মুখোপাধ্যায়ের আত্মীয়স্বজন ও পুরোনো সঙ্গীরা। কিন্তু মানব মুখোপাধ্যায় রয়ে যান তাঁর প্রিয় হিন্দু-মুসলমান দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে।
পাকিস্তানি আমলের শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এ দেশে থেকেই সমাজ প্রগতির পক্ষে কাজ করে যেতে থাকেন। ১৯৭১ সালে রাজাকাররা বৃদ্ধ মানব মুখোপাধ্যায়কে হত্যা করে।
চিরকুমার মানব মুখোপাধ্যায়ের শৈশবে এক প্রেমিকা ছিল। ছিল এক অনুরক্তাও। কিন্তু দেশ বিভাগের ডামাডোলের মধ্যে হারিয়ে যায় তাঁর বাল্যপ্রেমিকা ঊর্মিমালা।
ছবিটির বাজেট ছিল ৯৬ লাখ টাকা, যার ৬০ লাখ অনুদান হিসেবে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ঘাটতি ছিল ৩৬ লাখ টাকার। এ ধরনের বিষয়বস্তুর একটি ছবির জন্য করপোরেট পুঁজির দ্বারস্থ হতে চাননি পরিচালক। তাই বাকি টাকা গণ-অর্থায়নের মাধ্যমে সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন। তিনি জানান, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এ ছবির জন্য আর্থিকভাবে অবদান রেখেছেন।
পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল জানান, খুলনার বটিয়াঘাটা ও ফুলতলার গ্রামাঞ্চল, দৌলতপুর রেলস্টেশন এবং কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ ছবির শুটিং হয়েছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রটির বিভিন্ন বয়সের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান শোভন, খায়রুল আলম সবুজ ও তাওসিফ সাদমান তূর্য।
এ ছাড়া ছবিতে আরও অভিনয় করেছেন রামেন্দু মজুমদার, চিত্রলেখা গুহ, ঝুনা চৌধুরী, নাজিবা বাশার, আফজাল কবির, রাজীব সালেহীন, মাসুম বাশার, মিলি বাশার, উত্তম গুহ, আবদুল্লাহ রানা, সংগীতা চৌধুরী, বৈশাখী ঘোষ, পাভেল ইসলাম, ব্রিটিশ অভিনেতা অ্যান্ড্রু জোন্স প্রমুখ।
আজ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ দেখা যাবে শাহবাগের সরকারি গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে। প্রতিদিন বেলা তিনটা, বিকেল সাড়ে পাঁচটা ও রাত আটটায় ছবিটির তিনটি প্রদর্শনী থাকবে। এ ছাড়া বিজয় দিবসে বেলা ১১টায় একই জায়গায় হবে ছবির আরেকটি প্রদর্শনী। আজ (শুক্রবার) থেকে স্টার সিনেপ্লেক্স (বসুন্ধরা সিটি, সীমান্ত সম্ভার ও মহাখালীর এসকেএস) ও যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাস ও চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিনে ছবিটির নিয়মিত প্রদর্শনী হবে।
এর আগে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘চিত্রা নদীর পারে’, ‘লালসালু’, ‘লালন’, ‘রাবেয়া’, ‘জীবনঢুলী’সহ বেশ কিছু সিনেমা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ পেয়েছে দেশ-বিদেশের নানা পুরস্কার।
ছবিগুলো প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে। জানা গেছে, সামনের বছর জানুয়ারিতে ভারতের আসন্ন গোয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রূপসা নদীর বাঁকে ছবিটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হতে যাচ্ছে।