আজাদ এখন ঐতিহ্যের কঙ্কাল

নাগরিক বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম চলচ্চিত্র। ষাট ও সত্তরের দশকে ঢাকার সিনেমা হলগুলোয় দেশ-বিদেশের নতুন, আলোচিত সব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। নব্বইয়ের দশকের শেষ প্রান্তে এসে দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্পে মন্দা শুরু হয়। তার প্রভাব পড়ে সিনেমা হলের ব্যবসায়। গত আড়াই দশকে ঢাকায় তিনটি সিনেপ্লেক্স হলেও নতুন কোনো সিনেমা হল তৈরি হয়নি। এই শহরে নব্বইয়ের দশকে অর্ধশত সিনেমা হল থাকলেও কমতে কমতে হলের সংখ্যা এখন ২৬–এ এসে ঠেকেছে। পুরোনো এসব হল নিয়েই এই সাপ্তাহিক আয়োজন
কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার জনসন রোডের আজাদ সিনেমা হল
কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার জনসন রোডের আজাদ সিনেমা হল


রায়সাহেব বাজার ছেড়ে সদরঘাটের দিকে এগিয়ে গেলে জনসন রোডের মাঝামাঝি হাতের বাম পাশে মিলবে হলুদ রঙের ভবনটি। এখানে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করলে হয়তো শুনতে পাবেন নায়িকার কান্না-হাসির আওয়াজ কিংবা ভিলেনের ভয়াল চিৎকার। ৮৮ বছরের পুরোনো ভবন এখন আর শব্দের ঢেউ আটকাতে পারে না।

আজাদ সিনেমা হল। ঐতিহ্যের কঙ্কাল হয়ে এখনো সচল, তবে জীবনপ্রদীপ নিবুনিবু। ঢাকার প্রথম দিককার ১০টি সিনেমা হলের অন্যতম এটি।

এই হলটিই একসময় ঢাকার অভিজাত পরিবারের সদস্যদের বিনোদনের মূল কেন্দ্র ছিল। লেখক, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রের শিল্পী-কলাকুশলীদের পদভারে মুখরিত থাকত আজাদ সিনেমা হল। ঘোড়ার গাড়ি, রিকশায় চড়ে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন। ইংলিশ, উর্দু, হিন্দি, বাংলা ছবিতে বিশ্বকে দেখতেন তাঁরা।

এই আজাদ হলের নাম প্রথমে ছিল মুকুল টকিজ। তখন মালিক ছিলেন মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জি। ১৯২৯ সালে ঢাকায় নির্মিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ চলচ্চিত্রটি এ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ওই সিনেমা দিয়েই হলটির যাত্রা শুরু। এর উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য ও বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার (আরসি মজুমদার)।

পাশে অলস পড়ে আছে প্রক্ষেপণযন্ত্র। ছবি প্রদর্শিত হয় কম্পিউটারের সাহায্যে

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন এই মুকুল সিনেমা হলের শেয়ার কিনেছিলেন ১০০ টাকায়। তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান যোবায়দা মির্জার লেখা থেকে জানা যায়, ১০০ টাকায় শেয়ার কিনে প্রতি ছবির জন্য প্রথম শ্রেণির দুটো ফুল এবং একটি হাফ টিকিট এবং মাসে একটি ফ্যামিলি পাস পেতেন কাজী মোতাহার হোসেন। ‘রচনাসংগ্রহ’ গ্রন্থে যোবায়দা মির্জা লিখেছেন, ‘...আব্বু সময় পেলেই আমাকে কত গল্প শোনাতেন, ঘুমাবার সময় তো বটেই, অন্য সময়ও। আর প্রতি সপ্তাহে সিনেমায় নিয়ে যেতেন মুকুলে।’ তিনটি ঘোড়ার গাড়ি করে কাজী মোতাহার হোসেনের পরিবার এবং বেড়াতে আসা অতিথিসহ সবাই গিয়েছিলেন শিশির ভাদুড়ীর ‘সীতা’ দেখতে। ‘তিরিশের দশকে ঢাকায় সিনেমা দেখা’ শিরোনামে যোবায়দা মির্জার লেখায় ওই সময়ে ‘লরেল হার্ডি’, ‘চার্লি চ্যাপলিন’ থেকে শুরু করে ‘কপাল কুণ্ডলা’, ‘চণ্ডীদাস’, ‘সোনার সংসার’, ‘প্রহ্লাদ’ ছবিগুলোর কথা জানা যায়।

হলটির বর্তমান প্রধান ব্যবস্থাপক এম এম হাসান ১৯৬৪ সাল থেকে চাকরি করছেন এখানে। তিনি বলেন, ‘ওই বছর (১৯৬৪ সালে) বোম্বের শের আলী রামজি এ হলটি মুকুল বাবুর কাছ থেকে কিনে নেন। তিনি নতুন নাম দেন আজাদ সিনেমা। ভবনটির নাম আজাদ ম্যানশন। ১৯৭৪ সালে ঢাকার এক চলচ্চিত্রপ্রেমী এ ইউ এম খলিলুর রহমান আজাদ সিনেমা হল কিনে নেন শের আলী রামজির কাছ থেকে। খলিলুর রহমানের মৃত্যুর পর এখন তাঁর চার ছেলে এই হলের মালিক।’

আছেন মাত্র ১০ জন কর্মী। তাঁদের বেশির ভাগই কৈশোরে যোগ দিয়েছিলেন চাকরিতে

লেখক ইমদাদুল হক মিলনের স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে আজাদ হল। শৈশবে তাঁরা থাকতেন জিন্দাবাহারের তৃতীয় লেনে। বাবা চাকরি করতেন লক্ষ্মীবাজারের মিউনিসিপ্যালটি করপোরেশনে। স্মৃতিচারণা করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতি মাসে নতুন ছবি এলে সবাইকে নিয়ে বাবা হইহুল্লোড় করে মুকুল হলে ছবি দেখতে নিয়ে যেতেন। পরে আমরা চলে যাই গেন্ডারিয়া। ইতিমধ্যে হলের নামও মুকুল থেকে আজাদ হয়। আমিও শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে। বন্ধুদের সঙ্গে যেতাম আজাদ হলে। ছবি দেখা শেষে হলের পাশেই দিল্লি মুসলিম হোটেলে মোগলাই, কাবাব খেয়ে বাসায় ফেরা দিনগুলো খুব মনে পড়ে।’ মিলন বলেন, ছবি দেখার পাশাপাশি বিশেষ আরেকটি কারণে এই হল তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তাঁর বড় ভাইয়ের নাম আজাদ, ছোট বোনের নাম মুকুল।

আজাদ হলের ঐতিহ্য আছে, তবে সেই জৌলুশ এখন আর নেই। গতকাল শুক্রবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, পুরোনো একটি ছবি চলছে হলে, ‘খুনি শিকদার’। দর্শক তেমন নেই। রিয়াল স্টলের সামনে বসে পত্রিকার পাতায় মগ্ন এক কর্মী। প্রক্ষেপণ কক্ষেও ৮৮ বছরের বৃদ্ধের ছাপ। পুরোনো দুটি প্রক্ষেপণ যন্ত্র আছে। তবে ছবি প্রদর্শনী হচ্ছে পেনড্রাইভ থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে।

প্রধান ব্যবস্থাপক এম হাসান নিজের কক্ষ ছেড়ে কাউন্টারের সামনে বসে নিজেই টিকিট বিক্রি তদারক করছেন। মাথায় ক্রিকেটারের মতো গোল ক্যাপ। কথা বলতে কিছুটা অনাগ্রহ তাঁর। তবু স্মৃতিতে কড়া নাড়ায় খুলে যায় ষাট দশকের মুকুল আর আজাদ হল। তখন তিনি কিশোর। ক্রিকেটার ছিলেন। বললেন, ‘আমাদের মালিক খলিল সাহেব খেলাধুলা খুব পছন্দ করতেন। এ জন্য আমাকে যথেষ্ট ছাড় দিতেন। ডিউটি করে বেলা দুইটায় চলে যেতাম। মায়ায় পড়ে পুরা একটা জীবন এখানে পার করে দিলাম।’

প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, লেখক সরদার ফজলুল করিম, সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতিচারণায় এই সিনেমা হলে নিয়মিত ছবি দেখার অনেক কথা জানা যায়। এসব বিখ্যাত মানুষের আসা-যাওয়া দেখেছেন হলের কর্মী চান মিয়া। তিনি বলেন, পাশেই ঢাকা আর্ট কলেজ ছিল। ছাত্ররা এখানে এসে মানুষের ছবি আঁকতেন। চান মিয়া ’৬৩ সাল থেকে এই হলে চাকরি করছেন। বাবা জুম্মন মিয়াও এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। বললেন, তখন তো গেট খুললেই হাউসফুল হয়ে যেত। পাঁচটি শ্রেণির আসন ছিল। তৃতীয় শ্রেণিতে ৯ আনা, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১ টাকা এবং প্রথম শ্রেণিতে ছিল ১ টাকা ৩ পয়সা। এ ছাড়া ডিসি ও ব্যালকনিতে যথাক্রমে ৩ টাকা ও ২ টাকার বিনিময়ে টিকিট বিক্রি হতো। প্রতি প্রদর্শনীতে আর্মিদের জন্য কিছু আসন বরাদ্দ রাখা হতো। ম্যাজিস্ট্রেট এসে নিয়মিত পরিবেশ দেখে যেতেন। এমনকি টিকিটে লাগানো স্ট্যাম্প আসল কি না, তা–ও পানিতে ভিজিয়ে পরীক্ষা করতেন!

টিকিট কাউন্টারের সামনে দর্শক

‘জনতা এক্সপ্রেস’ ছবিটি আজাদ হলের মূল প্রতিষ্ঠান দ্য ঢাকা পিকচার প্যালেস লিমিটেডের নিজস্ব প্রযোজনা ছিল। ‘সারেং বউ’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ডাকু মনসুর’, ‘মহানগর’, ‘সাম্পানওয়ালা’ ও ‘জনতা এক্সপ্রেস’-এর মতো কালজয়ী ছবি প্রদর্শিত হয়েছে এখানে। এক শোতে ‘ছুটির ঘণ্টা’ দেখতে আসা হলের সব দর্শকই ছিলেন নারী—এই স্মৃতি এখন ভুলতে পারেন না চান মিয়া।

মূল ভবনসহ ভেতরের অফিস কক্ষগুলো আগের মতোই আছে বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানের পুরোনো কর্মীরা। কোনো কিছু পরিবর্তন করা হয়নি।

কর্মচারী ইউনিয়নের কক্ষে সাইনবোর্ড আছে। কিন্তু ভেতরে ফাঁকা। ষাট দশকের শুরুতে এই ইউনিয়ন গঠিত হয়। বর্তমানে ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ সলিম মিয়া। এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা তিনি। হলের সুপারভাইজার সলিম মিয়া হতাশা জানালেন অকপটে। শুনেছেন মালিক হল ভেঙে ফেলতে চাইছেন। বড় মার্কেট করবেন। অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই বলেন, ‘পুরা জীবনটাই শেষ করলাম এহেনে, কী পাইলাম!’ তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে ৪০ জনের বেশি কর্মী ছিলেন। এখন সাকল্যে ১০ জন আছেন।

টিকিট কাউন্টারের সামনে দর্শক

হলের হিসাবরক্ষক পরিতোষ রায়ও বলেন, হলটি ভাঙার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এমনিতেই দর্শকের অভাব। তার ওপর আশপাশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সংগঠনের পরিচয় দিয়ে ফ্রি ছবি দেখে চলে যায়। কিছু বললে ভাঙচুর শুরু করে। এসব যন্ত্রণায় মালিক হল ভেঙে মার্কেট করার পরিকল্পনা করেছেন।

মুকুল টকিজ থেকে আজাদ হল। ৮৮ বছরের এই যাত্রা থেমে যাওয়ার ঘণ্টাধ্বনি প্রকাশ্য। কদিন পর চিহ্নটুকুও মুছে যাবে আজাদ ম্যানশনের।