অশোক কুমার অভিনীত ‘কিসমত’ বলিউডের প্রথম ব্লকব্লাস্টার ছবি। ১৯৪৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি প্রথম ভারতীয় সিনেমা, যা বক্স অফিসে কোটি রুপি আয় করেছিল। বোম্বে টকিজের প্রযোজনায় বাঙালি পরিচালক জ্ঞান মুখোপাধ্যায়ের এ ছবির পর ভারতীয় চলচ্চিত্র দুনিয়ায় বলিউডের জয়রথ দুর্বার গতিতে চলতে থাকে। বছরের পর বছর চলতে থাকা এ জয়রথ যেন থমকে গেছে বিগত দুই বছরে। একের পর এক ফ্লপ হচ্ছে হিন্দি ছবি-নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী থেকে প্রযোজকদের ঘুম হারাম।
এমন বাজে সময় গত সাত দশকেও দেখেনি বলিউড। বড় বাজেট, ছবিতে একাধিক বড় তারকা, ব্যাপক প্রচারণা-কোনো টোটকাই কাজে লাগছে না। ব্যর্থতার মিছিলে নাম লিখিয়েছে ‘পৃথ্বীরাজ’, ‘লাল সিং চাড্ডা’, ‘এইট্টিথ্রি’, ‘রানওয়ে থার্টিফোর’, ‘জার্সি’, ‘বচ্চন পান্ডে’, ‘শামসেরা’, ‘ধাকড়’, ‘রক্ষাবন্ধন’, ‘বাধাই দো’, ‘ঝুন্ড’, ‘হিরোপান্তি ২’, ‘গেহরাইয়া’, ‘অ্যাটাক’সহ আরও অনেক ছবি।
অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগন, শহীদ কাপুর, আমির খান, রণবীর কাপুর, রণবীর সিং, জন আব্রাহামের মতো বড় নামও ছবিগুলোকে ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। একের পর এক ছবি বক্স অফিসে ব্যর্থ হওয়ায় রুটিরুজিতে টান পড়ছে অভিনেতা, নির্মাতা থেকে শুরু করে বহু চলচ্চিত্রকর্মীর।
দক্ষিণি ছবি হিন্দি বলয়ে যে দাপট দেখাচ্ছে, আমরা তা পারছি না। বহু বছর আগে শোলে এই দাপট দেখিয়েছিল। আমার মনে হয়, ছবির কনটেন্ট ভালো হওয়া চাই। তবেই দর্শক দেখবেন।আমির খান
শুরুতে কোভিড, পরে বর্জন
বলিউডের এই সাম্প্রতিক ব্যর্থতার প্রথম বড় ধাক্কাটা দিয়েছে কোভিড। হলে গিয়ে ছবির দেখার অভ্যাসটাই যেন চলে গেছে দর্শকের। গত কয়েক দিন মুম্বাইয়ের বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুরোনো অনেক হল বন্ধ হয়ে গেছে। কোভিডের পর খোলেনি, এমন হলও বেশ কিছু আছে। সালমান খান পরিবারের জন্য সুপরিচিত জুহুর চন্দন সিনেমা হল (সালমান খানের যেকোনো ছবি মুক্তি পেলে বাবা সেলিম খান পরিবারের সবাইকে নিয়ে এখানে ছবি দেখেন) যেন গোডাউনে পরিণত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে নামকরা সিনেমা হল ইরোজ। মারাঠা মন্দির, রিগাল সিনেমা হলে গিয়েও দেখা গেল দর্শকের উপস্থিতি একেবারেই কম। অথচ কয়েক বছর আগেও এসব সিনেমা হলের প্রতিটি শো থাকত হাউসফুল।
এর মধ্যে ‘গোদের উপর বিষফোড়া’র মতো এসেছে চলতি বছরের ‘বর্জন’ ঝড়। এ বিষয়ে মুম্বাইয়ের কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী ও চিত্রসমালোচকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। প্রায় সবারই মত, বলিউড সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করতে একটি ‘বিশেষ বাহিনী’ সক্রিয় হয়েছে। চলচ্চিত্রকে নেওয়া হয়েছে রাজনীতি ও ধর্মীয় অবস্থানে। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলেন, এখন ছবির মুক্তির আগেই বেশ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন নানা বিষয় সামনে এনে বর্জনের ডাক দেয়। কেবল বর্জনের ডাক দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, রাস্তায় নেমে আন্দোলনও করেছে তারা। নানা ইস্যুতে নির্মাতা ও অভিনেতাদের আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে সংগঠনগুলো। তবে এর বাইরে আরও কারণ আছে।
অনেকের মতে, হিন্দি ছবিতে ভালো কনটেন্টের অভাব। কেউ আবার মনে করছেন, ওটিটির স্বাদ পাওয়ায় মানুষ প্রেক্ষাগৃহে যাচ্ছে না। দক্ষিণি ছবির ঝলমলানিতে বলিউডে অন্ধকার নেমে এসেছে বলেও অনেকের ধারণা। এ-ও অভিযোগ উঠেছে, এখন বলিউডের নিজস্ব কোনো গল্প নেই, নির্মাতারা রিমেকেই বেশি আগ্রহী। এ সময়ের প্রজন্ম কোরিয়ান সিরিজ ও সিনেমার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। তাই প্রেক্ষাগৃহে তরুণদের ভিড় কম।
বিনোদন সাংবাদিক ভাবনা মিশ্রা জানান, লকডাউনের পর ‘জার্সি’ ও ‘ঝুন্ড’ ছাড়া কোনো বলিউড ছবি তাঁর ভালো লাগেনি। তাঁর মতে, ‘এখন বলিউডে নিজস্ব গল্প বলতে কিছু নেই। আমরা বড্ড বেশি রিমেকে ঝুঁকেছি।’ মুম্বাইয়ের স্থানীয় বাসিন্দা পৃথা সান্যাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বলিউড ছবির পোকা। ছবি মুক্তি পাওয়ামাত্রই হলে যেতাম। কিন্তু এখন সেই আকর্ষণ কোথাও হারিয়ে গেছে। লকডাউনে মেয়ের সঙ্গে বসে কোরিয়ান ছবি দেখেছি। শুরুতে অতটা আগ্রহ পাইনি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমিও কে-ড্রামাতে মজেছি। কোরিয়ান কনটেন্ট খুবই সমসাময়িক। আমাদের সংস্কৃতির না হলেও ছবিগুলোর সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারি।’
চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম পাক্ষিকের প্রতিটি দিন মুম্বাইতে তারকাদের কোনো না কোনো আয়োজন হয়েছে। যে তারকাদের পেতে এত দিন সংবাদকর্মীরা জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে চেষ্টা-তদবির করেছেন, সেই সংবাদকর্মীরা প্রতিদিন অনুষ্ঠান কাভার করতে করতে রীতিমতো ক্লান্ত!
ব্যর্থতা নিয়ে যা ভাবছেন তারকারা
এক জরিপে দেখা গেছে, চলতি বছর মুক্তি পাওয়া ৭৭ শতাংশ হিন্দি ছবিই ফ্লপ। বলিউডের ভান্ডারে যে অর্থ এসেছে, তার মোটা অঙ্ক এসেছে দক্ষিণ ভারতের ছবির দৌলতে।
‘আরআরআর’, ‘কেজিএফ ২’, ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’-এর মতো দক্ষিণি ছবিগুলো হিন্দিতে ডাব করার ফলে কিছুটা ব্যবসা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে নড়চড়ে বসেছেন বলিউডের তারকারা। যে তারকাদের বছরের পর বছর পাওয়া যেত না, তাঁরাও নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং, মতবিনিময় ও জনসংযোগ করছেন। শহর থেকে শহরে ছুটছেন। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম পাক্ষিকের প্রতিটি দিন মুম্বাইতে তারকাদের কোনো না কোনো আয়োজন হয়েছে। যে তারকাদের পেতে এত দিন সংবাদকর্মীরা জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে চেষ্টা-তদবির করেছেন, সেই সংবাদকর্মীরা প্রতিদিন অনুষ্ঠান কাভার করতে করতে রীতিমতো ক্লান্ত!
এত প্রচার করেও সিনেমাপ্রেমীদের হলমুখী করা যাচ্ছে না। তারকা ও নির্মাতারা মনে করছেন, কোভিড ও বর্জন ছাড়া আরও কিছু কারণ আছে বলিউডের মন্দা অবস্থার। এ নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন তারকার সঙ্গেও।
অভিনেতা আমির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিডের পর বক্স অফিসের অবস্থা নাজুক হলেও “পুষ্পা”, “ভুল ভুলাইয়া ২”, “কাশ্মীর ফাইলস” ও “আরআরআর” ভালো ব্যবসা করেছে। দক্ষিণি ছবি হিন্দি বলয়ে যে দাপট দেখাচ্ছে, আমরা তা পারছি না। বহু বছর আগে শোলে এই দাপট দেখিয়েছিল। আমার মনে হয়, ছবির কনটেন্ট ভালো হওয়া চাই। তবেই দর্শক দেখবেন। এ ছাড়া ছবি মুক্তির পর খুব তাড়াতাড়ি তা ওটিটিতে চলে আসছে। তাই দর্শক হলে যাচ্ছেন না। ভাবছেন, ঘরে বসে ওটিটিতেই ছবিটা দেখবেন।’
নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপ মনে করেন, দক্ষিণি ছবিগুলো নিজেদের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। তামিল, তেলেগু, মালয়ালম ও কন্নড় ছবির নির্মাতারা নিজেদের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে ছবি বানান। কিন্তু হিন্দি ছবির কোনো শিকড় নেই। নির্মাতারা নিজেদের শৈলী ও ঘরানার বাইরে গিয়ে ছবি করছেন। এই নতুন শৈলী বিপুলসংখ্যক দর্শকের বোধগম্য হচ্ছে না।
অনুরাগ বলেন, ‘অনেক নির্মাতা কথা বলেন ইংরেজিতে, কিন্তু তাঁরা বানাচ্ছেন হিন্দি ছবি। মূলধারার নির্মাতারা যদি নিজের স্টাইলে ছবি বানান, তাহলে তা নিশ্চয় চলবে। এই দেখুন “গাঙ্গুবাই” ও “ভুল ভুলাইয়া ২” অতিমারির মধ্যেও ভালো ব্যবসা করেছে।’ অনুরাগ আরও মনে করেন, বলিউডের নির্মাতাদের ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি নিয়ে কোনো ধারণাই নেই। অনেকেই বাস্তব জীবন নয়, বরং সিনেমা দেখে সিনেমা বানান। কিছুদিন আগেই তিনি এ প্রসঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রভাবশালী দুই বলিউড প্রযোজক করণ জোহর ও আদিত্য চোপড়াকে ধুয়ে দেন।
সালমান খানের মতে, হিন্দি ছবির ব্যর্থতার বড় কারণ বলিউড ছবিতে ‘হিরোইজম’ ও ‘আসল ভারত’-এর অনুপস্থিতি। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অভিনেতা বলেন, ‘দক্ষিণি ছবিতে এখনো “হিরোইজিম” দেখা যায়। আমরা দু-একজন ছাড়া কেউ এখন লার্জার দ্যান লাইফ ছবি বানাই না। কিছু মানুষের বক্তব্য, এসব নাকি বস্তাপচা চিন্তাভাবনা। এখন বাস্তবধর্মী ছবি প্রয়োজন। কিছু মানুষ ভারত বলতে বোঝে ক্যাফ প্যারেড আর আন্ধেরির মধ্যকার ঝাঁ-চকচকে এক দুনিয়াকে। কিন্তু এর বাইরেও যে এক জগৎ আছে, তা মানুষের ধারণার বাইরে। আমার কথা হলো, বাইরে বের হও, আর দেখো। আমার সিনেমা “আসল ভারত”-এর মানুষের জন্য। আমার সিনেমা দেখে বের হওয়ার পর দর্শকের রক্ত ফুটতে থাকে। দক্ষিণ ভারতীয় ছবিতে নায়কদের এখনো নায়কোচিতভাবেই পর্দায় তুলে ধরা হয়। সেলিম খান ও জাভেদ আখতারের সিনেমার ধারা এটা। ওরা এই ধারাকে আপন করে আরও বড় আকারে নিয়ে গেছে। আমরা “বাস্তবধর্মী” ছবি নির্মাণে ব্যস্ত।’
ছবি চলছে না তার দোষ আমার, আমাদের। পরিবর্তন আনতে হবে। জানতে হবে দর্শক কী চান। তাঁদের রুচি অনুযায়ী ছবি বানাতে হবে। এ ব্যাপারে অন্য কাউকে দোষারোপ করতে চাই না।অক্ষয় কুমার
এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন অক্ষয় কুমারও। ব্যর্থতার দায় মাথা পেতে নিয়ে তিনি বলেন, ‘ছবি চলছে না তার দোষ আমার, আমাদের। পরিবর্তন আনতে হবে। জানতে হবে দর্শক কী চান। তাঁদের রুচি অনুযায়ী ছবি বানাতে হবে। এ ব্যাপারে অন্য কাউকে দোষারোপ করতে চাই না।’ অভিনেতা ও নির্মাতা রাকেশ রোশন মনে করেন, এখনকার চিত্রনির্মাতারা নিজেদের ও নিজেদের বন্ধুবান্ধবের কথা মাথায় রেখে ছবি করছেন। তাঁরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছেন না। কারিনা কাপুর খানও জোর দিচ্ছেন গল্পের ওপর, কোভিডের সময় থেকে ওটিটিতে দর্শক ভালো ভালো কনটেন্ট দেখতে পাচ্ছেন। তাই গল্প ভালো হলেই কেবল তাঁরা থিয়েটারে যাবেন।
দক্ষিণি তারকাদের দাপট
চলচ্চিত্র বাজারে দক্ষিণি নায়ক-নায়িকারাও বলিউড নায়ক-নায়িকাদের থেকে এগিয়ে গেছেন গত কয়েক বছরে। যেমন দ্য ওরম্যাক্স স্টার অডিয়েন্স পুলের জরিপ অনুযায়ী, এ বছর সেরা ভারতীয় নায়িকার তালিকায় মাত্র তিনজন বলিউডের। আলিয়া ভাট আছেন ২-এ, দীপিকা পাড়ুকোন ৫-এ ও ক্যাটরিনা কাইফ আছেন ৮ নম্বরে। দীপিকার মতো অভিনেত্রীকে পেছনে ফেলেছেন কাজল আগরওয়াল; যিনি আছেন ৪-এ। পূজা হেগড়ে ১০-এ। কাজল ও পূজা কাজ করেছেন হিন্দি ছবিতেও। তবে দক্ষিণি ছবির জোরেই তাঁরা এই স্থান অর্জন করেছেন। তেলেগু অভিনেত্রী সামান্থা রুথ প্রভু এই দৌড়ে আলিয়াকে পেছনে ফেলে শীর্ষে আছেন। তবে নায়কদের অবস্থা আরও উদ্বেগজনক।
তালিকায় বলিউড থেকে একমাত্র ঠাঁই পেয়েছেন অক্ষয় কুমার। তা-ও তাঁর স্থান ৫-এ। বাকি স্থানগুলো দক্ষিণি নায়কদের দখলে। ‘বয়েজ ক্লাব’-এর শীর্ষে আছেন বিজয়, ঠিক তাঁর পেছনে আছেন জুনিয়র এনটিআর, প্রভাস ও আল্লু অর্জুন।
‘ব্রহ্মাস্ত্র’ আশার আলো
মন্দার বাজারে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে বলিউড? আদৌ কি পারবে? ভারতের স্বনামধন্য পরিবেশক পিভিআরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্জীব কুমার বিজলি মনে করেন, বলিউডের সাময়িক দুঃসময় চলছে। একটা হিট ছবি ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা বদলে দেবে।
গত সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ তেমনই আশা দেখাচ্ছে। মুক্তির তৃতীয় দিনের মাথায় এ ছবিরে ভান্ডারে যোগ হয়েছে ১০০ কোটি রুপি! নিকট সময়ে তো নয়ই, বলিউডের খুব কম ছবি আছে, যা আয়ের দিক থেকে এত দ্রুত সাফল্য পেয়েছে। বলিউডের মন্দার বাজারে এ ঘটনা রীতিমতো দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন সমালোচকেরা।