রাজেশ খান্না
রাজেশ খান্না

অহংকার, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ তাঁকে ‘একা’ করে দিয়েছিল

সুদর্শন এক যুবক। তাঁর অভিনয়ের আঙ্গিক, সংলাপ বলার কায়দা—সবই ছিল অন্য রকম, বরাবরই ছিলেন ‘টক অব দ্য টাউন’। তাঁকে বলা হতো ‘কিং অব রোমান্স’। সত্তরের দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্র দুনিয়ার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ছিলেন রাজেশ খান্না। অনেকে বলে থাকেন, তিনিই রঙিন যুগের বলিউডের প্রথম সুপারস্টার।

সেই সময়ে তাঁর অগণিত নারী ভক্ত ছিলেন। এমনও শোনা যায়, নারী ভক্তরা তাঁকে নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে পাঠাতেন। উদ্ধত ছিলেন, ইচ্ছেমতো চলতেন তিনি। শুটিংয়ের সেটে দেরি করে আসতেন, যখন ইচ্ছা যেতেন। তারপরও পরিচালক–প্রযোজকেরা তাঁকে ছবিতে নেওয়ার জন্য লাইন দিতেন। পারিশ্রমিক বেশি দিয়েও রাজেশ খান্নাকে ছবিতে নিতে চাইতেন তাঁরা। আজ প্রয়াত এই বলিউড তারকার জন্মদিন।

তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাঞ্জাবের অমৃতসরে। জন্মদিনে নানা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করছেন চিত্রসমালোচক, ভক্ত ও অনুরাগীরা। রাজেশ খান্নার নাম এলে প্রথমেই মনে আসে সেই বিখ্যাত সংলাপ, ‘পুষ্পা, আই হেট টিয়ার্স।’ চোখের পানি তিনি পছন্দ করতেন না। অথচ নিয়তি কী নির্মম, শোনা যায়, একসময় বন্ধ কামরার মধ্যে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন এই বলিউড তারকা। যাঁর জন্য তিনি কাঁদতেন, তিনি অমিতাভ বচ্চন। অমিতাভের উত্তরণ সইতে পারেননি তিনি।

এমনও হয়েছে, অমিতাভকে সবার সামনে অপমানও করেছিলেন রাজেশ। তখন রাজেশ খান্নার রাজত্ব, যাঁর ওপর কথা বলার সাহস কারও ছিল না। এদিকে অমিতাভের সঙ্গে তখন জয়া ভাদুড়ির (বচ্চন) প্রেম চলছে। ‘বাবুর্চি’ ছবির সেটে জয়ার সঙ্গে অমিতাভ প্রতিদিন দেখা করতে যেতেন। এসব দেখে খুব বিরক্ত হতেন রাজেশ। তিনি তখন সবার সামনেই অমিতাভকে অপমানসূচক কথা বলেন। যশপ্রার্থী অভিনেতা অমিতাভ সেদিন কোনো প্রতিবাদ করেননি। তবে চুপ থাকেননি ঠোঁটকাটা স্বভাবের জয়া। বলিউডসম্রাটের মুখের ওপর সেদিন বলেন, ‘আজ যাঁকে আপনি সবার সামনে অপমান করছেন, কাল সে আপনাকে টপকে যাবে। আপনার চেয়ে বড় তারকা হয়ে দেখিয়ে দেবে।’
পরে জয়ার কথাই সত্য হয়েছে, এ কথা তো সবারই জানা। জানা যায়, এক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে যখন রাজেশ খান্নাকে ছেড়ে সবাই ‘বিগ-বি’কে ঘিরে ধরেন, তখন রাগে-অপমানে ফেটে পড়েন তিনি। সেদিন নাকি বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিলেন রাজেশ।

অভিনেতা রাজেশ খান্না ও তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী ডিম্পল কাপাডিয়া। ছবি: ফেসবুক

রাজেশ খান্নার পারিবারিক নাম যতীন খান্না। রাজেশ খান্নাকে ভালোবেসে সবাই কাকা বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর বাবার নাম লালা হিরানন্দ ও মায়ের নাম চন্দ্রানী খান্না। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক।
রাজেশ খান্নার জন্মস্থান এবং বাবার কর্মস্থল পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে। রাজেশ খান্নাকে পরে তাঁর এক কাছের আত্মীয় দত্তক নেন। তাঁদের নাম চুনীলাল খান্না ও লীলাবতী খান্না। তাঁদের কাছেই রাজেশ খান্না বেড়ে ওঠেন। চুনীলাল খান্না ভারতীয় রেলে কাজ করতেন এবং ১৯৩৫ সালে তিনি লাহোর থেকে মুম্বাই শহরে চলে যান। রাজেশ খান্না সেন্ট সেবাস্টিয়ান গোন হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন।

সেখানেই তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছিল রবি কাপুরের সঙ্গে। রবি কাপুর পরবর্তীকালে ভারতীয় সিনেমার নায়ক জিতেন্দ্র নামে পরিচিতি পান।

রাজেশ খান্না

স্কুল ও কলেজে থাকার সময়েই রাজেশ খান্না মঞ্চনাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন এবং কলেজে অভিনয় করে বেশ কিছু অ্যাওয়ার্ডও পান।
১৯৬৫ সালে মুম্বাইয়ে ইউনাইটেড ফিল্মফেয়ার ট্যালেন্ট প্রতিযোগিতার মঞ্চে রাজেশ খান্না ও বিনোদ মেহরা একই সঙ্গে ছিলেন। দুজনের হাসিই সবার হৃদয় জয় করে। কিন্তু সেদিন শেষ হাসিটা হেসেছিলেন রাজেশ। বিনোদ এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হন। রাজেশ ও অভিনেতা জিতেন্দ্র একই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ওই সময় ইন্টার স্কুল নাটকে দুজন অংশ নেন। অভিনয়ের ব্যাপারে জিতেন্দ্রকে নানা পরামর্শ দিতেন রাজেশ। তিনি জিতেন্দ্রকে অভিনয়ের ব্যাপারেও উৎসাহ দিতেন।
১৯৬৬ সালে রাজেশ খান্নার প্রথম সিনেমা ‘আখেরি খাত’ মুক্তি পায়। এই সিনেমা ভারত থেকে অস্কার প্রতিযোগিতায় পাঠানো হয়েছিল; যদিও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত মনোনয়ন পায়নি। তখন নামকরা বাঙালি পরিচালক শক্তি সামন্ত তাঁর কাছে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন ‘আরাধনা’ সিনেমার। শুরুতে রাজেশ খান্নার মনে হয়েছিল, এই সিনেমার কাহিনি নায়িকাকেন্দ্রিক, তিনি সেখানে কী অভিনয় করবেন! তিনি শক্তি সামন্তকে বলে দিলেন, অভিনয় করবেন না। কিন্তু শক্তি খুব বুঝিয়ে রাজেশ খান্নাকে অভিনয় করতে রাজি করালেন ‘আরাধনা’র জন্য। সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পরের বাকিটা ইতিহাস। বক্স অফিসে ব্যাপক ঝড় তোলে এই ছবি। রাজেশ খান্নার ক্যারিয়ার সুপারস্টার হওয়ার পথে এগিয়ে চলে। একের পর এক সিনেমা হিট হতে থাকে।

‘আরাধনা’–পরবর্তী ভারতীয় হিন্দি সিনেমায় পরপর রাজেশ খান্নার ১৬টি সিনেমা সুপারহিট হওয়ার রেকর্ড হয়, যা হিন্দি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে একটি ইতিহাস হয়ে আছে।
রাজেশ খান্নার জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে ভারত ও বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁর ভক্তরা প্রতি মাসে হাজার হাজার চিঠি তাঁর উদ্দেশে পাঠাতেন। বলিউডে রাজেশ খান্নার একের পর এক হিট ছবি দেখে তখন ভারতে অনেক ছেলের নাম রাখা হয় ‘রাজেশ’। শোনা যায়, একবার রাজেশ খান্না অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বলিউডের অনেক চিত্রনির্মাতা অসুস্থতার বাহানা করে ওই হাসপাতালে তাঁর ঘরের আশপাশের ঘরগুলোয় থাকতে শুরু করেন, তাঁকে ছবির চিত্রনাট্য শোনাবেন বলে। তবে অনেকে মনে করেন, রাজেশ খান্নার এই সফলতার পেছনে গায়ক কিশোর কুমার এবং সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মণের অনেক অবদান রয়েছে। কিশোর কুমার এই বলিউড নায়কের ৯১টি ছবিতে গান গেয়েছেন। আর রাহুল দেব বর্মণ তাঁর অভিনীত ৪০টি ছবির গানে সুর দিয়েছেন।

পর্দায় রাজেশ খান্না

কলেজজীবন থেকে রাজেশ খান্নার সঙ্গে অঞ্জু মহেন্দ্রর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সবাই জানতেন, তাঁদের দীর্ঘ সাত বছরের প্রেম বিয়ে অবধি গড়াবে। শোনা যায়, অঞ্জুর প্রতি একটু বেশিই কড়া ছিলেন রাজেশ। সম্পর্কটাকে নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে রাখতে চাইতেন। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরলে অঞ্জুকে যেন ঘরের মধ্যে দেখতে পান, এমনই দাবি ছিল রাজেশের। অন্যদিকে অত্যধিক ‘ইগো’র জন্যই অঞ্জুর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে তাঁর। এর জেরেই নাভিশ্বাস ওঠে অঞ্জুর। ফলে বিচ্ছেদ ছিল অবধারিত। রাজেশের জীবনে আসেন ডিম্পল কাপাডিয়া। এক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে মুম্বাই থেকে আহমেদাবাদ যাওয়ার পথে বিমানে পাশাপাশি বসেন রাজেশ আর ডিম্পল। তখন তিনি সুপারস্টার আর ডিম্পল নবাগত। ডিম্পল তখন সবে ‘ববি’ ছবির শুটিং শুরু করেছেন।

রাজেশ তখন তাঁকে চেনেন শুধু রাজ কাপুরের ছবির নায়িকা হিসেবে। প্রথম দেখাতেই ডিম্পলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন ‘রোমান্সের কিং’। ‘ববি’ মুক্তির ছয় মাসের মধ্যে ঘটা করে বিয়ে হয় এই দুই বলিউড তারকার। ডিম্পল কাপাডিয়ার সঙ্গে সাংসারিক জীবন ছন্দে চলছিল না রাজেশ খান্নার। ওই সময় টিনা মুনিমের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান রাজেশ খান্না। নিজের অর্ধেক বয়সী অভিনেত্রীর সঙ্গে পর্দার রসায়নও ভালো ছিল রাজেশের। ব্যক্তিগত জীবনেও এরপর একে অপরের কাছে আসতে শুরু করেন রাজেশ খান্না ও টিনা মুনিম। ১৯৮৪ সালে ডিম্পল কাপাডিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের পরই টিনার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান রাজেশ।

রাজেশ খান্না ও অমিতাভ

মুমতাজের সঙ্গে রাজেশ খান্নার সম্পর্ক নিয়ে বলিউডে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম গুঞ্জন শুরু হয়। তাঁদের পর্দার রসায়নও ছিল জব্বর; যদিও রাজেশ খান্নার সঙ্গে সম্পর্ক কোনো দিনই প্রকাশ্যে আনেননি মুমতাজ। তাঁরা একে অপরের বন্ধু বলেই বারবার দাবি করা হয়েছে। রাজেশ খান্নার সঙ্গে অনিতা আদভানির সম্পর্কও সর্বজনবিদিত; যদিও রাজেশ খান্নার মৃত্যুর আগপর্যন্ত অনিতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে মেনে নিতে পারেননি ডিম্পল কাপাডিয়া।
শোনা যায়, এই অভিনেতার ক্যারিয়ার যখন সবে শুরু, তখনো প্রযোজকদের কাছে যেতেন সে সময়ের দামি ‘ইমপালা’ গাড়িতে চড়ে। সেই গাড়িতে করে তিনি প্রযোজকদের নামীদামি রেস্তোরাঁয় খাওয়াতেও নিয়ে যেতেন। রাজেশ তখন যে গাড়িতে চড়তেন, অনেক বড় বড় বলিউড তারকার কাছেও সেই গাড়ি ছিল না।

অনেক চিত্রসমালোচকই মনে করেন, রাজেশের পতনের কারণ তিনি নিজেই। দাম্ভিকতা, অসংযমী জীবনযাপন, বদমেজাজ, কাজের প্রতি নিষ্ঠার অভাবই তাঁকে ‘একা’ করে দিয়েছিল।

আরাধনা ছবিতে শর্মিলা ঠাকুর ও রাজেশ খান্না

একবার রাজেশ খান্না অমিতাভ প্রসঙ্গে বলেছিলেন ‘আমি কেরানি নই, আমি সুপারস্টার, তাই আমি আমার মুডের চাকর নই। যখন আমার ইচ্ছা হবে, তখন আমি কাজ করব।’ এভাবে রাজেশের নাম, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, অনুরাগী, এমনকি পরিবার—একে একে সবাই তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। রোগে–শোকে শেষ জীবনটা কষ্টে কেটেছে। তবু তিনি নিজের দুনিয়ায় খুব খুশি ছিলেন। বলিউডের প্রথম সুপারস্টার বলেছিলেন, ‘আবার যদি সুযোগ আসে, আমি রাজেশ খান্না হয়েই জন্মাতে চাই এবং একই ভুলগুলো আবার করতে চাই।’ ২০১২ সালের ১৮ জুলাই রাজেশ খান্না মারা গেছেন ঠিকই, কিন্তু আজও তাঁর সিনেমা ও অভিনয় দর্শকের মনে দাগ কাটে। ইউটিউবে খুঁজে ফেরেন তাঁর গানের ভিডিও।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস