সালমান খান। পর্দায় গ্যাংস্টার কিংবা খলনায়কের সঙ্গে লড়াই করেছেন বহুবার। শেষ পর্যন্ত হয়েছেন জয়ী। নায়ক সব সময় জিতবেন। নায়ক হারতে পারেন না। ‘রাধে’, ‘চুলবুল পান্ডে’ বা ‘টাইগার’-এর মতো সব চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক মাতিয়ে রেখেছেন। আবার ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ থেকে হয়ে গেছেন সবার ভাইজান। সেই ভাইজান এখন বাস্তবে লড়ছেন। লড়ছেন একজন গ্যাংস্টারের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সালমান খানের বাড়িতে গুলি চালানো হয়েছে। অবশ্য যে দুজন গুলি চালিয়েছিলেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে সালমান খানের নিরাপত্তা।
গ্রেপ্তার দুজনের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, জেলবন্দী গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইয়ের ভাই আনমোল বিষ্ণোই তাঁদের এ কাজের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। আনমোল চেয়েছিলেন, ১৯৯৮ সালে যোধপুরের কাছে কৃষ্ণকায় হরিণ শিকারের জন্য সালমানকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক কে এই লরেন্স বিষ্ণোই? কেন তাঁর সালমান খানের সঙ্গে শত্রুতা?
ঘটনার শুরু
১৯৯৮ সালের ঘটনা। ভারতের যোধপুরে সালমান খান গিয়েছিলেন পুরো ইউনিট নিয়ে শুটিং করতে। ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ সিনেমার শুটিং চলাকালে ঘটনাক্রমে দুটি কৃষ্ণকায় হরিণ হত্যা করেন সালমান খান। মামলা করে বিষ্ণোই সম্প্রদায়। বিরল প্রজাতির এই হরিণকে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন। মামলাটির পেছনে তাঁদের ক্রমাগত লেগে থাকার কারণে ২০ বছর পর ২০১৮ সালে এসে পাঁচ বছরের জেল হয় সালমানের। পরে অবশ্য জামিনে মুক্তি পান তিনি। সেখানেই ঘটনার সমাপ্তি ঘটতে পারত, কিন্তু তা হয়নি।
কৃষ্ণকায় হরিণ ও বিষ্ণোই সম্প্রদায়
প্রশ্ন জাগতেই পারে, কৃষ্ণকায় হরিণ হত্যার সঙ্গে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক কী? তারা কেন মামলা করেছে? কেনই-বা লরেন্স বিষ্ণোই ও তাঁর গ্রুপ এত বছরের ঘটনা বয়ে চলেছে?
এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানায়, বিষ্ণোই সম্প্রদায় ভারতের প্রভাবশালী একটি সম্প্রদায়। তারা কয়েক শ বছর ধরে অক্ষরে অক্ষরে ২৯টি রীতি মেনে চলার চেষ্টা করে। সেসব রীতির মধ্যে প্রকৃতির সুরক্ষা, বৃক্ষ রক্ষা, জঙ্গলের প্রাণী রক্ষা অন্যতম। এ সম্প্রদায় যে কৃষ্ণকায় হরিণকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করে, সেই হরিণই হত্যা করেছেন সালমান। যা তাদের ভাবাবেগে আঘাত করেছে। বিলুপ্তপ্রায় এই কৃষ্ণকায় হরিণ চিংকার নামেও পরিচিত।
কে এই লরেন্স বিষ্ণোই
৩১ বছরের লরেন্স বিষ্ণোই প্রায় দুই ডজন হত্যা ও চাঁদাবাজির মামলায় আটক হয়ে বর্তমানে ভারতের তিহার জেলে বন্দী। পাঞ্জাবের ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ফাজিলকা জেলার দত্তরানওয়ালি গ্রামে লরেন্সের জন্ম। গ্রামটিতে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
লরেন্সের বাবা লাভিন্দর বিষ্ণোই ও মা সুনিতা বিষ্ণোই এখন বাইরের কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না। পাঞ্জাবি র্যাপার ও সংগীতশিল্পী সিধু মুসেওয়ালাকে হত্যার সঙ্গে লরেন্সের নাম উঠে আসার পর থেকে তাঁরা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন।
লরেন্সের ছোট ভাই আনমোল বিষ্ণোই। তিনি সালমান খানের বাড়িতে গুলি চালানোর ঘটনার দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি নাকি যুক্তরাষ্ট্রে বসে সালমানের বাড়িতে গুলি চালানোর ছক কষেন। মুসেওয়ালার হত্যার ঘটনার পর থেকে আনমোল পলাতক।
লরেন্স যেভাবে গ্যাংস্টার
লরেন্সের গ্রামে গিয়ে তাঁর বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে গ্রামবাসীর চোখেমুখে কেমন যেন আতঙ্ক ফুটে ওঠে। তাঁরা জানিয়েছেন, মুসেওয়ালা হত্যাকাণ্ডের পর দিল্লি ও পাঞ্জাব পুলিশ লরেন্সের বাড়িতে আসে। এ ঘটনার পর গ্রামের অনেক যুবক গা ঢাকা দিয়েছেন, যাতে পুলিশের হাতে হয়রানির শিকার না হতে হয়। গ্রামবাসীর আক্ষেপ, লরেন্সের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে দত্তরানওয়ালি গ্রামের বদনাম হচ্ছে।
গ্রামবাসী জানান, লরেন্স খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। ক্রিকেট, ভলিবল ও ঘোড়া চালানোয় প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল। তিনি ভদ্র স্বভাবের ছিলেন। গ্রামের কেউ কখনো তাঁকে মারামারি করতে দেখেননি।
লরেন্স যখন চণ্ডীগড়ের পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে এলএলবিতে ভর্তি হন, যোগ দেন পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস স্টুডেন্টস কাউন্সিলে। সেখানে দেখা হয় আরেক গ্যাংস্টার গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে। গোল্ডিই সিধু মুসেওয়ালাকে হত্যা করেন বলে দায় স্বীকার করেছেন। গোল্ডির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই বদলে যেতে থাকেন লরেন্স। জড়িয়ে পড়েন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে।
সালমানকে হত্যার হুমকি
‘ভাইজান’ যেহেতু বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষের ভাবাবেগে আঘাত দিয়েছেন, সেহেতু লরেন্স বিষ্ণোই তাঁকে হত্যা করতে চান বলেই জানিয়েছেন।
গত বছর এক ই-মেইলের মাধ্যমে সালমানকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এর আগে তাঁর বাবা সেলিম খান এক উড়োচিঠি পেয়েছিলেন। এই চিঠিতেও ভাইজানকে প্রাণে মেরে ফেলার কথা বলা হয়েছিল।
দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে যোগ
কৃষ্ণকায় হরিণ হত্যা ছাড়াও গ্যাংস্টার দাউদ ইব্রাহিম ও ছোটা শাকিলের সঙ্গে সালমান খানের যোগাযোগ রয়েছে, লরেন্স ও তাঁর ভাই আনমোলের দাবি এমনটাই। সালমানের বাড়িতে গুলি চালানোর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেন আনমোল বিষ্ণোই। সেখানে একদম শেষের দিকে এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন আনমোল, ‘তুমি দাউদ ইব্রাহিম ও ছোটা শাকিলকে ভগবান মেনে এসেছ। এর চেয়ে বেশি বলার অভ্যাস আমার নেই।’
অতঃপর গুলি...
সালমান খান মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন চার দশক ধরে। ১৪ এপ্রিল ভোরে সেখানে চারটি গুলি চালান ভিকি ও সাগর। সালমানের ফ্ল্যাটে দুটি গুলির চিহ্ন শনাক্ত করা গেছে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে।
জানা যায়, কারাগারে থাকা গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইয়ের ছোট ভাই আনমোল বিষ্ণোই যুক্তরাষ্ট্রে বসে হামলার পরিকল্পনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক গ্যাংস্টার রোহিত গোদারাকে দায়িত্ব দেন আনমোল। ভারতজুড়ে রোহিতের দলের প্রশিক্ষিত শুটার রয়েছে। সেখান থেকে দুজনকে নির্বাচন করা হয়। পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে সালমানের বাড়িতে ১০টি গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর কী
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া ওই পোস্টের শুরুর দিকে আনমোল লিখেছেন, ‘আমরা শান্তি চাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে যুদ্ধই ঠিক আছে। সালমান খান, এই ঘটনা শুধু একটা ট্রেলার, তোমাকে যা আমরা দেখাতে চেয়েছিলাম। তুমি যাতে আমাদের শক্তি বুঝতে পারো, আর আমাদের পরীক্ষা নিয়ো না। এটা প্রথম এবং শেষ হুমকি। এরপর গুলি শুধু বাড়িতে চলবে না।’
এ থেকে বোঝা যায়, লরেন্স ও তাঁর ভাই আনমোল এবার সরাসরি সালমান খানের ওপর হামলা চালাবেন।
কী করবেন সালমান
বসে থাকতে চান না সালমান খান। ২০২৫ সালের ঈদের জন্য সালমান তাঁর পরবর্তী সিনেমা ‘সিকান্দার’-এর শুটিং চালিয়ে যেতে চান। আগামী মাসেই এ আর মুরুগদাস পরিচালিত সিনেমাটির শুটিং শুরু করবেন তিনি।
গুলি চালানোর পর থেকে সালমান খানের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে সালমানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন।
কোনো কিছুর পরোয়া না করে বাস্তবের এই লড়াইয়ে পর্দার নায়কের মতোই লড়বেন সালমান খান, ভক্তরা নিশ্চয় সেটাই চাইছেন!
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, ট্রিবিউন ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টাইমস, ডিএনএ, বিবিসি বাংলা