‘সায়রাকে আঘাত দেওয়ার জন্য আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না’

বেঁচে থাকলে আজ শতবর্ষ পূর্ণ করতেন দিলীপ কুমার। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর পেশোয়ারে জন্ম হয় তাঁর। দিলীপ কুমারের আত্মজীবনী ‘দ্য সাবট্যান্স অ্যান্ড দ্য শ্যাডো’। সেই বই থেকে নির্বাচিত অংশ

দিলীপ কুমার

বম্বে টকিজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এখানে দেবিকা রানী আমাকে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এর চেয়ে ভালো কাজ আর খুঁজে পেতাম না। একদিন খবর পেলাম, দেবিকা আমাকে তাঁর অফিসে তলব করেছেন। যাওয়ার পর বললেন, ‘ইউসুফ, তোমাকে অভিনেতা হিসেবে সুযোগ দেব ভাবছি। তবে মন্দ হয় না, যদি তুমি পর্দার জন্য নতুন একটা নাম নাও।’ মুহূর্তের জন্য আমি বাক্যহারা হয়ে গেলাম। তিনি আমাকে নতুন নাম নিতে বলছেন! এ জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বললাম, শুনতে ভালোই লাগছে, কিন্তু এটা কি জরুরি? তিনি মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, এটিই হবে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। আরও বললেন, এমন একটা নাম নিতে, যা নিজেই একটা পরিচয় হয়ে ওঠে। নামটির যেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ আবেদনও থাকে। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বললেন। পুরো দিন বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করলাম, কিন্তু ঘুরেফিরে দিলীপ কুমার নামটিই কানে বাজছিল।

অবশেষে শুটিংয়ের প্রথম দিনটি এল। আমাকে দেওয়া হলো সাধারণ একটি প্যান্ট-শার্ট। দেবিকা রানী সেটে এসে আমার ঘন ভ্রু ছাড়া আর সব বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তিনিই এক মেকআপশিল্পীকে ডেকে ভ্রু থেকে অতিরিক্ত চুল ফেলে দিতে বললেন।

আমাকে অনেকেই ১৯৪৪ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমা নিয়ে কথা বলতে বলেন। সত্যি বলতে, পুরো অভিজ্ঞতাটাই আমার মনে দাগ কাটতে পারেনি। তখন সেটিই করেছিলাম, যা আমাকে করতে বলা হয়েছিল।

সায়রা বানু ও দিলীপ কুমার

প্রসঙ্গ রোমান্টিক দৃশ্য
একটা প্রশ্ন আমাকে প্রায়ই করা হয়, পর্দায় অন্তরঙ্গ দৃশ্যগুলোতে অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা যে আবেগ ফুটিয়ে তোলেন, সেটা কি তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলে? আমাকে যেমন সুনির্দিষ্টভাবে ‘মুঘল-এ-আজম’-এর সেলিম ও আনারকলির মধ্যকার দৃশ্য নিয়ে অনেকবার প্রশ্ন করা হয়েছে। সোজা কথায় বললে, পর্দার জুটি বাস্তবে আবেগের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কি না, আমার সৎ উত্তর হলো, হ্যাঁ ও না—দুটিই। অন্তরঙ্গ দৃশ্যগুলোয়, বিশেষ করে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা ও আবেগের দৃশ্যে পরিচালকের চাওয়া থাকে একধরনের উষ্ণতা তৈরি হোক। তবে সবার চাওয়া থাকে, এটা যেন শুটিংয়ের বাইরে প্রবাহিত না হয়। আমরা পাত্র-পাত্রীরা ভালোই জানি পুরো ব্যাপারটি আদতে কৃত্রিম, এই আবেগ কেবল ক্যামেরার সামনেই চলছে।

দিলীপ কুমার-মধুবালার বাস্তবজীবনের প্রেম, ভাঙন আর বেদনাবিধুর বিচ্ছেদ যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল পর্দার সেলিম-আনারকলির চরিত্রে

মধুবালা
সন্দেহাতীতভাবে আনারকলি চরিত্রে মধুবালা ছিল সঠিক পছন্দ। ‘মুঘল-এ-আজম’-এর শুটিংয়ের সময় আমাদের বিয়ে হয়েছে কি না, এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তবে মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খান আমাকে বিয়ে করার বিরোধিতা করেননি। তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা ছিল, আমাদের একই ছাদের নিচে পেলে তিনি খুশিই হতেন। চেয়েছিলেন, তাঁর প্রযোজনা সংস্থা থেকে আমি ও মধু ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত কাজ করি। যখন আমি এ পরিকল্পনার কথা জানলাম, তাঁদের বুঝিয়ে বললাম, আমার কাজ করার ও সিনেমা নির্বাচনের নিজস্ব রীতি আছে। এমনকি আমার নিজের প্রযোজনা সংস্থার হলেও শিথিলতা দেখাই না। তিনি মধুকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, আমি অভদ্র ও অহংকারী। আমি আন্তরিকভাবে বললাম, আমাদের ব্যক্তিগত জীবন পেশাদার জীবন থেকে দূরে রাখা উচিত। মধু ও তার বাবা আমাকে বোঝাতে থাকলেন, বিয়ে হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমি বুঝেছিলাম, যে কঠোর পরিশ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে ক্যারিয়ার তৈরি করেছি, সেটা এ ধরনের আত্মসমর্পণে ভেস্তে যেতে পারে। পুরো পরিস্থিতি সুখকর ছিল না। তবে আমরা যে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করিনি, সেটিই ঠিক হয়েছে।

বৈজয়ন্তীমালা ও দিলীপ কুমার

বৈজয়ন্তীমালা
বৈজয়ন্তীমালা ও আমার মধ্যে একধরনের পেশাদারি বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল—প্রথমে দেবদাস, পরে আরও ছয়টি সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করেছিলাম। সে ছিল দুর্দান্ত শিল্পী, যে দ্রুত শিখতে পারত। ‘দেবদাস’-এর পর আমরা ‘মধুমতী’ করি। যে সিনেমায় সংলাপ বলা ও চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে সে প্রভূত উন্নতি করেছিল। সে ছিল পরিশ্রমী এক অভিনেত্রী। পরিস্থিতির জটিলতা, গতি নিজের মধ্যে ধারণ করত। বিশেষ করে বলা যায় মধুমতীর কথা। পরাবাস্তব ও আধিভৌতিক দৃশ্যগুলোর জন্য সে নিজেকে তৈরি করেছিল।

সায়রা বানু ও দিলীপ কুমার

সায়রা বানু
ব্যক্তিগতভাবে ‘রাম অউর শ্যাম’ আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সিনেমাটি করার সময় আমি সায়রাকে বিয়ে করি। ১৯৬৬ সালে আমাদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নানা ধরনের খবর আসছিল। যদিও আমি বেশ কিছু কারণে তার সঙ্গে কাজ করতেই অনিচ্ছুক ছিলাম। বিষয়টি এবার খোলাসা করা যাক। প্রথমত, আমি জানতাম, সে মোহাম্মদ এহসান সাব ও নাসিম বানুজির মেয়ে। নাসিম আপা আমার ভাই আয়ুবের সিনেমায় কাজ করেছে। ওস্তাদ বেলায়েত খানের সেতার বা গানের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে সবাইকে নিয়ে ছোট জমায়েতের কথা মনে পড়ে। নাসিম আপাকে সব সময় নিমন্ত্রণ করত আমার বোন আখতার। নাসিম আপার প্রতি সব সময়ই আমার অন্য রকম একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ফলে ষাটের দশকের শুরুতেই সায়রার সঙ্গে যখন আমর বিয়ের কথা উঠল, শুরুতেই ‘না’ বলে দিলাম।

সায়রার সঙ্গে বিয়ে হয়। ১৯৬৬ সালে ২ অক্টোবর আমাদের বাগদানের ঘোষণা চমক তৈরি করে। সায়রা ও আমি একসঙ্গে সময় কাটাতে থাকি। বিয়ের অনুষ্ঠান শুরুর আগে আমাদের আলাদা করে দেওয়া হয়। বড়রা আমাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎও বন্ধ করে দেন, যা আমাদের হৃদয় ভেঙে দেয়। অবশেষে ১১ অক্টোবর বিয়ে হয়। কেমন বোধ করেছিলাম সেদিন? অনেক দিন ধরে ‘মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর’ খেতাব ভেঙে যাওয়া নিয়ে আমি কী নার্ভাস ছিলাম? না, খুব শান্ত বোধ করছিলাম। মনে হচ্ছিল, নিরাপদ কোনো শান্তির স্বর্গে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।

আসমা রেহমান ও দিলীপ কুমার

আসমা রেহমান
আমার জীবনের একটা ব্যাপার ভুলে যেতে চাইব, সেটি হলো আসমা রেহমান নামের ভদ্রমহিলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। হায়দরাবাদের একটি ক্রিকেট ম্যাচ চলার সময় পরিচয়। সে নিজেকে আমার ভক্ত হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। সে ছিল আমার বোনদের বন্ধু। ১৯৮২ সালে তার সঙ্গে আমার বিয়ের খবর যখন প্রকাশিত হলো, সায়রা সেটি পড়ে স্বভাবতই আকাশ থেকে পড়ল। তার জন্য খবরটি ছিল খুব বেদনার, সে আমাকে বিশ্বাস করত, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিল। সায়রাকে আঘাত দেওয়ার জন্য আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না।
আরেকটি বিষয় নিয়ে সায়রাকে ভুলভাবে বলা হয়, সে নাকি সন্তান ধারণ করতে পারে না। সত্য হলো, ১৯৭২ সালে তার গর্ভে সন্তান আসে, কিন্তু অষ্টম মাসেই আমরা তাকে হারাই।

কৌতূহলী অনেকেই জানতে চান, সন্তানের বাবা হতে না পেরে আমি অসুখী কি না। আসলে সন্তান থাকলে দারুণ ব্যাপার হতো, কিন্তু এটা নিয়ে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই। আল্লাহ আমাদের পরিবারে অনেক ছেলেমেয়ে দিয়েছেন।
অনুবাদ: লতিফুল হক