রহস্যময়ী রেখা। তাঁর নামের সঙ্গে অনেকে এমন বিশেষণও দেন। আর যা–ই হোক, তিনি বরাবরই সাহসী। গতানুগতিক সমীকরণ থেকে বেরিয়ে নিজের ছন্দেই বেশি সাবলীল। আজ বলিউডের তারকা ‘সিলসিলা’, ‘উমরাও জান’ অভিনত্রী রেখার জন্মদিন। আজ মঙ্গলবার ১০ অক্টোবর ৬৯ বছর পূর্ণ করলেন বলিউডের ‘চিরসবুজ’ এই অভিনেত্রী।
রহস্য, রটনা, চিরসবুজ, অমিতাভ বচ্চন। এই শব্দগুলো চলেই আসে রেখা নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে। তাঁকে নিয়ে বলিউডে নানা রটনা চলছে যুগের পর যুগ। রেখা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ‘ভাইরাল’। তাঁকে বলা হয়, চিরসবুজ নারী। অনেকে বলেন ‘এজলেস বিউটি’। অমিতাভের সঙ্গে তাঁর নামটি যেন মুদ্রার অন্য পিঠ।
বছরের পর বছর দুটি নাম পাশাপাশি চর্চিত, অমিতাভ আর রেখা। এ দুটি নাম মনে এলে একটি দৃশ্য চোখে ভাসে অনেকের, দিগন্তবিস্তৃত বর্ণিল টিউলিপ ফুলের সমারোহে একাকার তাঁরা। আর সঙ্গে গান ‘দেখা এক খাব তো ইয়ে সিলসিলে হুয়ে’। রেখার আবেগঘন অভিব্যক্তি দারুণ সার্থক করেছে এই গানের কথা ও সুরকে। অনেকে বলেন সত্যিকারের প্রেম না থাকলে এমন অভিব্যক্তি সম্ভব না!
না, ছবির প্রেমিক অমিতাভের সংসার হয়েছে, প্রেমিকা রেখা একাই রয়ে গেলেন। আজ ১০ অক্টোবর পূর্ণ করলেন ৬৯ বছর। চিরসবুজ রেখা ৭০ ছুঁলেন। গতকাল রাত থেকে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে নতুন করে ফিরে এসেছেন রেখা। শুভেচ্ছার বৃষ্টি ঝরেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে।
অবশ্য ফিরে এলেন বললে ভুল হবে। রেখা ছিলেন না কবে? রেখা তো বছরের পর বছর আছেনই। আছেন গল্পগুজবে, আছেন আলোঝলমলে কোনো তারকাবহুল সন্ধ্যায় উজ্জ্বল তারকা হয়ে।
রেখা নিজেই যেন সব সময় নতুন। রেখার নামের পাশে চিরসবুজ লিখলে একবিন্দুও বাড়াবাড়ি হয় না। যিনি চিত্তহরণ করেন কিশোর, তরুণ, যুবক, প্রৌঢ়, এমনকি বৃদ্ধেরও।
জীবিকার দায়ে রুপালি পর্দায়
শুরুতে বলে ফেলেছি, তাঁর নামের সঙ্গে ‘রটনা’ শব্দটা চলে আসে। যেটা বলা হয়নি, সেটা ‘সংগ্রাম’ শব্দটার কথা। রেখা তিনি, যিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। রেখা তিনি, যিনি নেহাতই পেটের দায়ে চলচ্চিত্রে নেমেছিলেন। নিজের জন্য, সংসারের জন্য। মা-বোনদের জন্য।
ওই যে বললাম, সংগ্রামের কথা, সেটা যেমন তেমন না। রীতিমতো যুদ্ধ। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ। গত শতকের ৫০ দশকের মাঝামাঝি। সে সময়ের পরিচিত তামিল অভিনেতা জেমিনি গণেশন ও তেলেগু অভিনেত্রী পুষ্পাভ্যালির ঘরে ভানুরেখা গণেশন ওরফে রেখার জন্ম ১৯৫৪ সালে। তবে রেখার মায়ের ছিল না বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি। সে কারণেই রেখার জন্মের পর বাবার স্বীকৃতি মেলেনি।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সে জন্য রেখাকে বিভিন্ন সময়ে শুনতে হয় নানা কটু কথা। বাবা জেমিনিও রেখার ছোটবেলায় তাঁকে সন্তান হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। পিতৃপরিচয়ের সংকট নিয়ে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে আসেন রেখা। হার মানেননি; বরং স্বপ্ন দেখতেন বিমানবালা হওয়ার। কিন্তু বাবার অনুপস্থিতিতে পরিবারে দারিদ্র্য নেমে আসে।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রেখা হয়ে ওঠেন তাঁর ছয় সদস্যের পরিবারের কান্ডারি। কিশোরী রেখা পরিবারের হাল ধরেন। পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া এই নারী নিজেই বলেছেন, ‘বেশির ভাগ সময় আমি ছিলাম আমার ভাইবোনদের মা, এমনকি আমার মায়েরও মা।’
কিশোরী রেখা ঠিক করেন বলিউডে নেমে পরিবারের অভাব দূর করবেন। অডিশন দিতে লাগলেন। কিন্তু রেখা ছিলেন কৃষ্ণকলি, কালো তাঁর গায়ের রং। গায়ের রং ফরসা ছিল না। তখন বলিউডে নায়িকা হতে গেলে প্রথম শর্ত, ফরসা হতে হবে। আবার হিন্দিও জানতেন না একেবারেই। তাই প্রযোজক-পরিচালকেরা ফিরিয়ে দিতে থাকেন তাঁকে।
শুরুতেই অঘটন
১৯৬৯ সালে ‘গোয়াদাল্লি সিআইডি ৯৯৯’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে রুপালি পর্দায় তাঁর ভ্রমণ শুরু। তার আগে অবশ্য রেখা ১৯৬৬ সালে তেলেগু চলচ্চিত্র ‘রাঙ্গুলা রত্নম’–এ বেবি ভানুরেখা নামে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৭০ সালে ভানু রেখা গণেশন অভিনয় করেছিলেন বলিউডের ছবি ‘শাওন ভাদো’তে। ওই বছরই প্রথম হিন্দি ছবি ‘আনজানা সফর’-এ সুযোগ মেলে তাঁর; কিন্তু কপাল ফেরেনি। সে ছবি মুক্তি পেতে কয়েক বছর লাগে।
প্রথম দিকে মুক্তি না পাওয়ার জন্য দায়ী না হলেও কারণ রেখাই। ‘আনজানা সফর’ ছবিটি ওই সময় সেন্সর বোর্ডে আটকে যায়। কারণ, সহশিল্পী বিশ্বজিতের সঙ্গে কিশোরী রেখার পাঁচ মিনিটের দীর্ঘ চুম্বনের দৃশ্য।
কয়েক বছর আগে ভারতের সাংবাদিক ইয়াসির ওসমানের লেখা রেখার জীবনীগ্রন্থে জানা যায়, জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র আনজানা সফরে অভিনয় করতে গিয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হন তিনি। ওই ঘটনা নিয়ে ইয়াসির ওসমান লিখেছেন, বোম্বের (এখনকার মুম্বাই) মেহবুব স্টুডিওতে ‘আনজানা সফর’ চলচ্চিত্রের শুটিং চলছিল। সেদিন রেখা ও বিশ্বজিতের মধ্যে প্রেমের দৃশ্য চিত্রায়ণের কথা ছিল। পরিচালক ‘অ্যাকশন’ বলার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় শুটিং। কিন্তু পরিচালক যেভাবে দৃশ্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সেভাবে হচ্ছিল না; বরং নায়ক বিশ্বজিৎ রেখাকে নিজের বাহুতে জোরে আটকে ধরে চুমু দিতে শুরু করেন। চিত্রনাট্যের বাইরে গিয়ে নায়কের এমন আচরণে রেখা হতবাক হয়ে যান; কিন্তু তাঁর কিছুই করার ছিল না। নায়ক তাঁকে ছাড়ছেন না, পরিচালকও ‘কাট’ বলছেন না। শুটিং ইউনিটের লোকজন এই দৃশ্য দেখে মজা পেয়েছেন আর সিটি বাজিয়েছেন। অনেক দিন পর্যন্ত এ ঘটনা রেখাকে প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে।
রেখার প্রথম মুক্তি পাওয়া হিন্দি ছবি ‘সাওয়ান ভাদো’। ওই ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন অভিনেতা নবীন নিশ্চল। বক্স অফিসে ব্যাপক হিট হয় সেই ছবি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
একে একে সুপারহিট ছবি আসে রেখার জীবনে। ‘কাহানি কিসমত কি’, মিস্টার নটবরলাল, ‘সিলসিলা’, ‘উমরাও জান’, মুকাদ্দার কা সিকান্দর, ‘খুন-পাসিনা’, ‘উৎসব’, ‘দো আনজানে’—তালিকাটা এতই লম্বা যে গুনে শেষ করা যাবে না।
বারবার আলোচনায়
আজকাল অনেক শিল্পীই কাজের বাইরে নানা কারণে আলোচনায় আসেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় তাঁদের ‘কর্মকাণ্ড’। চিরসবুজ রেখাও সেকালে নানা সময়ে নানাভাবে আলোচনায় এসেছিলেন, আসেন।
এক সন্ধ্যার কথা। রেখা তখন সুপারস্টার। দিনটা ১৯৮০ সালের ২২ জানুয়ারি। আরকে স্টুডিওতে ঋষি কাপুর আর নিতু কাপুরের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। এমন সময় রেখা পৌঁছান সেখানে। মাথায় সিঁদুর, গলায় মঙ্গলসূত্র। যেমনটি থাকে হিন্দু বিবাহিত নারীদের; কিন্তু রেখার তখনো বিয়ে হয়নি। ঘটনা কী?
এমনিতে ওই সময় আবার চলচ্চিত্র জগতে অমিতাভ বচ্চন-রেখার সম্পর্ক নিয়ে নানা গুঞ্জন। এসব নিয়ে অতিথিদের মধে৵ ফিসফাস।
যদিও পরে রেখা বলেছেন, তিনি নাকি একটি ছবির শুটিংয়ে ছিলেন। সেখান থেকেই চলে যান বিয়ের অনুষ্ঠানে। মেকআপ তোলার কথা একেবারেই খেয়াল ছিল না। সেই সন্ধ্যার কথা বেশ কিছুদিন আলোচিত হয় বলিউড পাড়ায়।
এরপর প্রায় এক মাসের মধ্যে তখনকার প্রখ্যাত শিল্পপতি মুকেশ আগরওয়ালকে বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু বিয়ের এক বছর পরেই আত্মহত্যা করেন মুকেশ। কেন মুকেশ আত্মহত্যা করেন, তা আজও জানা যায়নি। এরপর একের পর এক রটনা, গল্পগুজব, ফিসফাস রেখাকে নিয়ে।
একসময় তাঁর নাম জড়ায় অভিনেতা বিনোদ মেহরার সঙ্গে। শোনা যায়, কলকাতায় নাকি বিয়ে করেন তাঁরা। কিন্তু বিনোদের মা তাঁকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এমনও শোনা যায়, কলকাতায় বিয়ে করার পর বিনোদ রেখাকে তাঁর মুম্বাইর বাড়িতে নিয়ে যান।
দরজা দিয়ে ঢুকে বিনোদের মায়ের পায়ে হাত দিতেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন তিনি। রেখাকে বাড়িতে থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। বিনোদের মা এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে পায়ের স্যান্ডেল খুলে রেখাকে মারতে শুরু করেন। ‘রেখা দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ বইয়ে এ ঘটনার উল্লেখ আছে, যদিও এ ব্যাপারে কোনো দিন মুখ খোলেননি রেখা।
শুধু বিনোদ মেহরা অথবা অমিতাভ নন, শত্রুঘ্ন সিনহা, রাজ বাব্বর, কমল হাসান এমনকি সঞ্জয় দত্তের সঙ্গেও তাঁকে নিয়ে রটে নানা গল্প। বয়সে ছোট, এমন অনেকের সঙ্গে তাঁকে নিয়ে গুজব উঠেছে।
এত কিছুর পর শেষ পর্যন্ত সংসার করা হয়নি রেখার। তাতে কখনো আফসোস করতে দেখা যায়নি। তাঁর পাওয়ার খাতা ভরপুর। পেয়েছেন পদ্মশ্রী, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং কয়েকটি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। আর ভক্তদের ভালোবাসা।
অভিনয় হোক কিংবা সৌন্দর্য অথবা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা বিতর্ক, রেখা কিন্তু সব সময় আলোচনায় ছিলেন ভারতের ছবিপাড়ায়, বিনোদন সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। এখন বড় পর্দায় তাঁকে সেভাবে দেখা যায় না; কিন্তু আজও মুম্বাইয়ে নানা পুরস্কার বিতরণ বা বিনোদন আয়োজনে প্রথম সারিতে দেখা যায় রেখাকে। এ যুগের তারকাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মঞ্চে আলো ছড়াতে এতটুকু কার্পণ্য তিনি করেন না।
সূত্র: ইয়াসির উসমানের লেখা ‘রেখা দ্য আনটোল্ড স্টোরি’