এ সময় ভারতের অন্যতম সেরা নির্মাতা দিবাকর ব্যানার্জির সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন কানু বেহেল। ‘ওয়ে লাকি! লাকি ওয়ে!’, ‘এলএসডি: লাভ সেক্স অউর ধোঁকা’র মতো সিনেমার সহচিত্রনাট্যকার ছিলেন। পরে ২০১৪ সালে কানু যখন নিজের প্রথম সিনেমা ‘তিতলি’ বানান, সেটা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। ঠিক ১০ বছর পর মুক্তি পেল তাঁর দ্বিতীয় সিনেমা ‘ডেসপাচ’।
একনজরেসিনেমা: ‘ডেসপাচ’স্ট্রিমিং: জিফাইভপরিচালনা: কানু বেহেলঅভিনয়: মনোজ বাজপেয়ী, সাহানা গোস্বামী, অর্চিতা আগরওয়াল, ঋতুপর্ণা সেনদৈর্ঘ্য: ১৫১ মিনিট
গল্প কী নিয়ে
ছাপা সংবাদপত্রের দিন শেষ, ডিজিটাল সাংবাদিকতাই ভবিষ্যৎ। প্রিন্টের আগে ডিজিটাল—শুরুতেই এ বার্তা দেওয়া হয়। তবে মুম্বাইভিত্তিক পত্রিকা ‘ডেসপাচ’-এর অনুসন্ধানী সাংবাদিক জয় পুরোনো ঘরানার। খবরের শিকড় পর্যন্ত যাওয়া তাঁর স্বভাব।
টু–জি স্ক্যামের গোড়ায় পৌঁছাতে চায় সে। তবে পেশাগত জীবনে নাছোড়বান্দা সাংবাদিক হলেও ব্যক্তিজীবনে প্রবল খামখেয়ালি জয়। স্ত্রীর সঙ্গে টানাপোড়েন, ব্যক্তিজীবনে শান্তি নেই। খবরের জন্য অনুসন্ধান আর জয়ের ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন মিলিয়ে এগিয়ে যায় গল্প। শেষ পর্যন্ত সে কোথায় পৌঁছায়?
কী ভালো
‘ডেসপাচ’ তৈরি করার জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে সবিস্তার গবেষণা করেছেন পরিচালক। সিনেমা দেখলেই সেটা বোঝা যায়। সিনেমায় সাংবাদিকের গল্প আগেও একাধিকবার দেখানো হয়েছে। তবে এ সিনেমা নানা কারণেই আলাদা। সেই স্বতন্ত্রতা মনোজ বাজপেয়ী নিজের অভিনয় করা জয় চরিত্রে বজায় রেখেছেন।
তিনিই ছবির প্রাণভোমরা। গল্পের সঙ্গে যেহেতু আন্ডারওয়ার্ল্ড, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আছে, ফলে সিনেমায় রোমাঞ্চও আছে। কিন্তু আপনি যদি ওটিটির প্রচলিত থ্রিলার দেখে অভ্যস্ত হন আর পরতে পরতে চমক আশা করেন, তবে এ ছবি আপনার জন্য নয়। নির্মাতা থ্রিলার বানাতে চাননি; বরং তিনি চেয়েছেন জয়ের রোমাঞ্চকর যাত্রাপথে দর্শককে শরিক করতে। এই পথ কখনো মন্থর, কখনো দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে।
জয় ঘটনাচক্রে জানতে পারে টু–জি স্ক্যামের কথা। এই স্টোরি সে ধাওয়া করে প্রায় কিছু না জেনেই। যে সংস্থা থেকে এই ‘স্ক্যাম’-এর সূত্রপাত, সেই জিডিআরের পেছনে কোন অদৃশ্য ক্ষমতাবান কলকাঠি নাড়ছে, সেটা জানাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে মনে হতেই পারে, সে প্রথাগত ‘হু ডান ইট’ ফর্মুলাতেই হাঁটছে।
কিন্তু দর্শকের জায়গা থেকে পুরো বিষয়টিকে দেখতে গেলে মনে হয়, সেই ক্ষমতাবান ঠিক কে, তা এ ছবিতে না দেখালেও চলবে। কারণ, এ ছবিতে ‘কে অপরাধ করল’, সেটার চেয়ে পুরো ঘটনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রচলিত থ্রিলার বানানোর লোভ সামলে নিজের মতো করে গল্প বলার জন্য নির্মাতা বাহবা পাবেন।
‘ডেচপাচ’-এর বড় সম্বল এর অভিনয়। মনোজ বাজপেয়ী, সাহানা গোস্বামী, অর্চিতা আগরওয়াল—প্রত্যেকেই নিজেদের চরিত্রে দুর্দান্ত। তবে মনোজ বাজপেয়ী যে ছবিতে থাকেন, সেখানে তিনি যে নিজের দিকে সব আলো কেড়ে নেবেন, সেটা বলাই বাহুল্য। এখানেও তা–ই হয়েছে। বেপরোয়া সাংবাদিক, সংসারজীবনে ত্যক্তবিরক্ত এক ব্যক্তির চরিত্রে মনোজ মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিব্যক্তি, হাঁটাচলা, ধীরস্থিরভাবে সংলাপ বলা দারুণভাবে মানিয়ে গেছে চিত্রনাট্যের সঙ্গে। উচ্ছ্বাসহীন এক চরিত্র, যে অনেক সময়ই প্রায় বালখিল্য কাজ করে জীবনের সংকট ডেকে আনে, অথচ তারও বেঁচে থাকার বিপুল ইচ্ছা—এমন এক জটিলতাকে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। আড়াই ঘণ্টা ধরে মনোজ সেই কাজই করেছেন। সাহানা গোস্বামী, অর্চিতা আগরওয়াল, ঋতুপর্ণা সেনও নিজেদের চরিত্রে ভালো করেছেন।
এ ছবির আরেকটি ইতিবাচক দিক চরিত্রের প্রতি সৎ থাকা। বেশির ভাগ উপমহাদেশীয় সিনেমায় দেখা যায়, প্রধান চরিত্রকে সব সময় নিষ্কলঙ্ক দেখানো হয়। যে নায়ক, তার সবই যেন ভালো। এ রাস্তায় হাঁটেননি নির্মাতা কানু। ছবিতে দেখা যায়, প্রধান চরিত্র একাধিক নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। গাড়ি থেকে শুরু করে সহকর্মীর বাড়িতে যৌনতায় লিপ্ত হয়। দুঁদে অনুসন্ধানী সাংবাদিক হলেও সে যে বারবার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, সেটা দেখাতে দ্বিধা করেননি নির্মাতা।
কোথায় দুর্বল
‘ডেসপাচ’ অনেক ক্ষেত্রেই মন্থরতায় ভোগে। যে মন্থরতার কোনো ব্যাখ্যা নেই। একটা সময় পর মনে হয়, এ ছবিতে নির্মাতা আসলে ঠিক কী দেখাতে চেয়েছেন, তিনি নিশ্চিত তো? ছবিতে স্ক্যামকে নিয়ে আসা হয়েছে কোনো রাজনৈতিক যোগ ছাড়াই। এটা কেন, সেটাও ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি নির্মাতা। পুরো ছবিতে অনেকগুলো ধোঁয়াশার জায়গা তৈরি করেছেন কানু বেহেল, পরে যেগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও দেননি। ছবির গল্পে আরও ধার প্রয়োজন ছিল। সাংবাদিক ও অপরাধজগতের লুকোচুরি খেলা আরও একটু জমলে মন্দ হতো না।
নগ্ন মনোজ
‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর তুমুল জনপ্রিয়তার পর ওটিটিতে অনেক কাজ করেছেন মনোজ বাজপেয়ী। কিন্তু তাঁকে পর্দায় অন্তরঙ্গ দৃশ্যে দেখা যায়নি। সবাইকে চমকে দিয়ে ‘ডেসপাচ’-এ কয়েকটি ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করেছেন তিনি।
একটি দৃশ্যে তো তাঁকে পুরোপুরি নগ্ন দেখানো হয়েছে। ছবির প্রচারে অভিনেতা বলেছেন, এ ছবি চূড়ান্তভাবে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। ফলে চাইলেও এ ছবির কথা তিনি ভুলতে পারবেন না। তিনি বলেছেন, এ ছবির জন্য তিনি রূপক ও আক্ষরিক—দুইভাবেই নগ্ন হয়েছেন।
কতটা জমল
বেশ কিছু দুর্বলতা থাকলেও কেবল মনোজ বাজপেয়ীর অভিনয় দেখার জন্য হলেও ‘ডেসপাচ’ একবার দেখাই যায়। প্রচলিত বাণিজ্যিক ধারার হিন্দি সিনেমা দেখতে দেখতে যাঁরা ক্লান্ত, তাঁরাও স্বাদ বদলের জন্য ঢুকে পড়তে পারেন ‘ডেসপাচ’-এর দুনিয়ায়।