বালকটি ছিল উর্দু গোয়েন্দা গল্পের ভক্ত। তবে এক রাতে ঘটনাক্রমে হাতে এল একখানা কবিতার বই। চার আনার বিনিময়ে এক লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়ত সে। যে লাইব্রেরি থেকে রোজ বই নিত, যাওয়ার পর জানা গেল নেওয়ার মতো একটাই বই আছে, সেটা আবার কবিতার বই। তা–ই সই। বইটি নিয়ে ফেরত এল বালকটি। ভাগ্যিস ওই বয়সেই বইটি হাতে এসেছিল, এরপর তো জীবন আমূল বদলে গেল। বইটি ছিল ১৯১৩ সালে ম্যাকমিলান লন্ডন প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি কবিতা সংকলন ‘দ্য গার্ডেনার’-এর উর্দু অনুবাদ। সেই যে রবীন্দ্রনাথ–ভক্ত হলেন, আর ছাড়লেন না। সেই বইটি আর নাকি ফেরতও দেয়নি বালকটি। রেখে দেয় নিজের কাছে। তিনি আর কেউ নন, গুলজার। তিনি কবি, গীতিকার, নির্মাতা। গুলজারের আজ ৯০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে আলো ফেলা যাক তাঁর জীবনে।
‘দ্য গার্ডেনার’-এর উর্দু অনুবাদ পড়ার পর রবীন্দ্রনাথের পাঁড় ভক্ত হয়ে ওঠেন। এখন তো তিনি দাবি করেন, বাঙালিদের চেয়েও নাকি তিনি রবীন্দ্রনাথ ভালো বোঝেন। কেবল রবীন্দ্রনাথই নন, অনেক বাঙালি লেখক-সাহিত্যিকের ভক্ত গুলজার।
১৯৩৪ সালের ১৮ আগস্ট বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে জন্ম গুলজারের। নাম ছিল সমপূরণ সিং কালরা। দেশভাগের পর গুলজারের পরিবার অমৃতসরে চলে গেলেও তিনি মুম্বাই চলে আসেন। তখন গ্যারেজে কাজ করতেন। অবসর সময়ে লিখতেন কবিতা।
পিতৃপ্রদত্ত সমপূরণ সিং কালরা নামটিকে বদলে লেখক-নাম গুলজার করায় তৎকালীন জনপ্রিয় উর্দু কবি রাজিন্দর সিং বেদি পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ‘সঙ্গে আরও কিছু জোড়া দাও। নয়তো ফাঁকা শোনাচ্ছে।’ গুলজার উত্তর দেন, ‘আমি নামটি ছাড়ছি না।’ জন্মসূত্র শিখ, বেড়ে উঠেছেন দিল্লিতে উত্তর প্রদেশের সংস্কৃতির মধ্যে। ৫০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন মুম্বাইয়ে। তবে তাঁকে বাঙালি বললেও ভুল হয় না। বাঙালি লেখকদের প্রচুর লেখা পড়েছেন বলেই নয়; বিমল রায়, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বিমল রায়, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটকের সান্নিধ্য পেয়েছেন যিনি, তাঁকে বাঙালি বলাই যায়। এ ছাড়া তাঁর স্ত্রী রাখি গুলজারও যে বাঙালি, সেটাও তো কারও অজানা নয়।
পরে বাঙালিদের সঙ্গে স্মৃতি নিয়ে তিনি বই লিখেছেন ‘পান্তাভাতে’। বইতে তিনি নিজের সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি আসলে একজন বাঙালি, যে কি না বাই চান্স জন্মে গিয়েছি একটা পাঞ্জাবি পরিবারে।’
বইতে তিনি সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেককে নিয়েই স্মৃতিচারণা করেছেন। সলিল চৌধুরীকে নিয়ে গুলজার লিখেছেন, স্টুডিওতে সারাক্ষণ ক্যারম খেলতেন। আর খেলতেন টেবিল টেনিস। একদিকে সংগীত সাধনা চলছে অন্যদিকে ক্যারম খেলে সাধনার সময় নষ্ট করা, এটি দেখে গুলজার বলেন, ‘ইনি সলিল চৌধুরী। মানুষ আর সুর—দুটোই যেন অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়া পাহাড়ি ঘরনা। যত সুন্দর, ততই ম্যাজেস্টিক; যত মনোহরণ, ততই আকর্ষক।’
হেমন্তকে নিয়ে তাঁর লেখায় পাওয়া যায়, ‘সাদা ধুতি আর শার্ট পরা একটা ভীষণ লম্বা লোক মার্সিডিজ চালিয়ে বোম্বে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ষাটের দশকে এমন কলারতোলা বাঙালি দেখা যেত না।’ গুলজারের স্মৃতিচারণায় আমরা দেখি, হেমন্ত সিগারেট খেতেন, নস্যি নিতেন। যা দেখে গুলজার অবাক মানতেন, কারণ, এতে গলা নষ্ট হওয়ার কথা। গানের আগে সিগারেট কেন খান, এ প্রশ্ন করলে হেমন্ত উত্তর দেন, ‘না হলে আমার গলার গ্রেনটা ভালো আসে না, গলাটা পরিষ্কার হয় না।’
সলিল চৌধুরীদের সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের শেষে মুম্বাইয়ে বিমল রায়ের বন্ধু দেবু সেন তাঁর কাব্যপ্রতিভার খোঁজ পেয়ে বলেছিলেন সিনেমায় গান লিখতে। গুলজার নারাজ। দেবু বুঝিয়েছিলেন সেদিন, ‘তোমার কী ধারণা, সব পরিচালকই অশিক্ষিত? একবারটি গিয়েই দেখো না।’ তিনিই নিয়ে গেলেন বিমল রায়ের কাছে, যিনি গুলজারের সঙ্গে শচীন দেববর্মনের পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর বাকিটা তো ইতিহাস।
গীতিকার শৈলেন্দ্রর সঙ্গে তখন মনোমালিন্য চলছে শচীনকর্তার। ‘বন্দিনী’ ছবির গান ঝুলে রয়েছে, কাজিয়ার জেরে সরে গিয়েছেন শৈলেন্দ্র। বৈষ্ণব–ভাবাপন্ন একটি গানের প্রয়োজন। উর্দু কবিতায় গুলজারের হাতযশের কথা জেনেও খুব একটা উৎসাহ পাননি কর্তা। কারণ সহজবোধ্য, তিনি বৈষ্ণব ভাষ্য খুঁজছিলেন। জেদ চেপে গেল গুলজারের, রচিত হলো তাঁর প্রথম সংগীত, ‘মোরা গোরা অঙ্গ লেই লে’। এরপর শৈলেন্দ্রর সঙ্গে কর্তার আবার মিটমাট হয়ে যায়, কিন্তু জহুরি বিমল রায় চিনে নিলেন রত্ন। ছবি পর্দায় এলে গানটি সুপারহিট হলো।
১৯৫৬-এ বিমল রায়ের ‘বন্দিনী’ ছবিতে নূতনের লিপে তাঁর লেখা ‘মোরা গোরা অঙ্গ লেই লে...’ প্রথম আলোড়ন তোলে। তার পরে ‘তুজ সে নজর নেহি...’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে...’ থেকে হাল আমলের ‘জয় হো...’ একের পর এক বিখ্যাত গান তাঁর লেখা। সুরকার হিসেবে পেয়েছেন শচীন দেববর্মন, সলিল চৌধুরী, শঙ্কর জয়কিষেণ, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল, মদন মোহন হয়ে এ আর রাহমানকেও। ২০০৯-এ ‘স্লাম ডগ মিলিওনিয়ার’ ছবিতে রাহমানের সুরে তাঁর লেখা ‘জয় হো...’ গানটি অস্কার জেতে।
গান লেখার পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছেন। তাঁর পরিচালিত ‘আঁধি’, ‘মাসুম’ প্রশংসিত হয়েছে। ছোট পর্দার জন্য তৈরি করেছেন ‘মির্জা গালিব’ ও ‘তহরির মুনশি প্রেমচন্দ কি’। দূরদর্শনের ধারাবাহিক ‘হ্যালো জিন্দেগি’, ‘পোটলি বাবা কি’ এবং ‘জঙ্গল বুক’-এর জন্য লেখা তাঁর গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকারের মতো পরিচয় ছাপিয়ে কবিতাকে নিজের ভেতরে ধরে রেখেছেন গুলজার আজীবন। হিন্দি সিনেমার গানে কবিতাকে বুনে দিয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘ছবিতে সূর্যাস্তের আয়োজন করতে তাঁকে ক্যামেরা, লেন্স, ফোকাল পয়েন্ট, আলোর মাপের হিসাবে দিশাহারা হতে হয়, তবেই তৈরি হয় একটি সার্থক সূর্যাস্ত।’
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পাঁচবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন গুলজার, ফিল্ম ফেয়ার পেয়েছেন ২২টি; পদ্মভূষণ, দাদা সাবেহ ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর লেখা গান জিতেছে অস্কার ও গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস।
গুলজার বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী রাখী গুলজারকে। তাঁদের মেয়ে মেঘনা গুলজার সিনেমার মানুষ। এই সময়ের হিন্দি সিনেমায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা তিনি।