ভারতের তো বটেই, বাংলাদেশের অনেক দর্শকের কাছে শ্রীদেবী শুধু বলিউডের নায়িকা নন, শ্রীদেবী মানে নস্টালজিয়া। শ্রীদেবী মানে ভিউ কার্ডে হলুদ শিফন শাড়ি গায়ে জড়ানো নারী। দেয়ালে পোস্টার, পড়ার বইয়ের পাতায় তাঁর ছবি, তাঁর নাম। সেটা গত শতকের আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের। আজ যেন ফিরে এসেছেন সেই নস্টালজিয়া উসকে দেওয়া শ্রীদেবী। ফিরে এসেছেন ফেসবুকে। ফিরে এসেছেন রংবেরঙের শিফন জর্জেট বা জামদানি শাড়িতে অনন্য শ্রীদেবী।
আজ ১৩ আগস্ট তাঁর জন্মদিন। তামিলনাড়ুতে ১৯৬৩ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীদেবী। বাবা ছিলেন একজন আইনজীবী। এক বোন ও দুই সৎভাই নিয়ে যৌথ পরিবারে দক্ষিণি আদর্শে বেড়ে ওঠা তাঁর। বেঁচে থাকলে আজ হতেন ৬১ বছরের, শ্রী আম্মা ইয়াঙ্গের আয়াপ্পান, শ্রীদেবী নামেই যিনি আমাদের কাছে পরিচিত। সিনেমার মানুষটি হঠাৎ করেই ছবি হয়ে গেলেন ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি।
বলিউডের ‘নারী অমিতাভ বচ্চন’
শুনতে যেন কেমন লাগছে, তাই না? একজন নারীকে পুরুষের সঙ্গে কেন তুলনা করা হচ্ছে? আসলে একসময় এমনটাই বলা হতো শ্রীদেবীকে। ওই সময় তিনি শাসন করতেন বলিউডের দুনিয়া। নায়কেরা অস্বস্তিতে পড়েন রীতিমতো। আর পুরুষ দর্শকের মতো নারী দর্শকের হৃদয়ে ঝড় তুলতেন তিনি। তাঁর মতো হলদে বা নীল শিফন শাড়ি জড়িয়ে আঁচল ছড়িয়ে দিয়ে ছবি তুলতেন স্টুডিওতে গিয়ে। একসময় পর্দায় শ্রীদেবীর উপস্থিতিতে বিবর্ণ হয়ে যান সহশিল্পীরা। ধর্মেন্দ্রর ছেলে সানি দেওলের কথাই বলি। ১৯৮৯ সাল। কয়েকটি ছবি মুক্তি পেয়েছে তাঁদের। একসময় ‘চালবাজ’ মুক্তি পেল। দারুণ হিট। কিন্তু সানি দেওল বলে দিলেন, শ্রীদেবীর সঙ্গে আর কাজ করবেন না। কারণ, ছবিতে শ্রীদেবী থাকলে নায়কের কিছু করার থাকে না। বটে! যেখানে নায়ক ছবি পর্দা শাসন করেন, এমন অলিখিত কথা প্রচলিত ছিল, সেখানে কিনা শ্রীদেবী শাসন করেছেন ছবিটি।
যাঁরা ‘শাসন করেছেন’ শব্দ দুটি শুনে ভ্রু কুঁচকালেন, তাঁদের জন্য আরও কিছু তথ্য দিই। শুনুন সে কথা। আশির দশক। অমিতাভ বচ্চনের উত্তাল সময়। অবশ্য উত্তাল সময় না হলে সোনালি সময় বলা হয়তো বেশি মানানসই। সে যাকগে, ওই সময় দক্ষিণ ভারতের নায়িকা শ্রীদেবী কিনা ফিরিয়ে দিচ্ছেন অমিতাভকে! একসঙ্গে মাত্র দুটি ছবি—‘ইনকিলাব’ আর ‘আখেরি রাস্তা’। এখানেই শেষ নয়। যখন ক্যারিয়ার পড়ন্ত, তখনো এমন দাপুটে ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সাল। ওই সময় ‘জুরাসিক পার্ক’ ছবিটি নিয়ে ব্যস্ত হলিউডের নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ। শ্রীদেবীর কথা শুনেছিলেন তিনিও। এ ছবিতে শ্রীদেবীকে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। সেদিন স্পিলবার্গের এমন প্রস্তাব পছন্দ হয়নি। দ্বিধাহীনভাবেই স্টিভেন স্পিলবার্গকে ‘না’ বলে দেন।
ওই সময় ছবিপিছু টাকার অঙ্কে অমিতাভ বচ্চনের পরই ছিলেন শ্রীদেবী। শ্রীদেবী তাই একক অভিনেতা। হিন্দি চলচ্চিত্রে যে কজন অভিনেত্রী পুরুষ সহকর্মীর সহায়তা ছাড়াই বক্স অফিসে ঝড় তুলতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে শ্রীদেবী অন্যতম।
অর্জনটা নিজ গুণে
অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ছবি না করা কিংবা স্টিভেন স্পিলবার্গকে ‘না’ বলে দেওয়ার ‘স্পর্ধা’ এমনি এমনি অর্জন করেননি। তিনি নিজেকে সেভাবে তৈরি করেন। কাজের প্রতি তিনি দারুণ দায়িত্বশীল ছিলেন। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৮৯ সালে ‘চালবাজ’ ছবির গান ‘না জানে কাহা সে আয়ি হ্যায় এ লাড়কি’ শুটিংয়ের সময় অসুস্থ ছিলেন তিনি। ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে শুটিং হয়েছিল। অথচ পুরো গানে ছিল বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য।
নিজের ফিটনেস নিয়ে সচেতন ছিলেন শ্রীদেবী। এমনকি ৫০ পেরিয়েও এ ব্যাপারে ছাড় দেননি। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে জিমে যেতেন। পরিচিত মানুষেরা জানিয়েছেন, নিয়মিতভাবেই শরীরচর্চা করা তাঁর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। জুহুর জে ডব্লিউ ম্যারিয়টের মতো পাঁচ তারকা হোটেলের জিমেই কড়া ট্রেনিং করতেন। ম্যারিয়টের জিমে নিয়মিত ট্রেনিং করতে বেশ ভালোই খরচ করতে হতো তাঁকে।
চ্যালেঞ্জের মুখে আপন শক্তিতে জ্বলজ্বলে
শ্রীদেবী আসলে বরাবর চ্যালেঞ্জের মুখেই জ্বলে উঠেছেন। হিন্দি ছবির নায়িকা হিসেবে তাঁকে প্রথম দেখা যায় ‘সোলওয়া সাওন’ ছবিতে। সেটা ফ্লপ ছিল। তাঁর হিন্দি উচ্চারণ নিয়েও কথা ওঠে। অবশ্য শুরুটা মাত্র চার বছর বয়সে, তখন থেকে ক্যামেরার সামনেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য শ্রীদেবী। প্রথম ছবি ‘থুনাইভান’ থেকেই ‘ছোট্ট শ্রীদেবী’ হিট। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি অবধি শিশু অভিনেত্রী হিসেবেই পরপর ছবি করে গেছেন।
হিন্দি ছবিতে তাঁকে প্রথম বালিকা চেহারাতেই দেখা যায়। ১৯৭৫ সালের ‘জুলি’ ছবিতে নায়িকা লক্ষ্মীর বোন সেজেছিলেন শ্রীদেবী। পরের বছর মাত্র ১৩ বছর বয়সে নায়িকা। প্রখ্যাত তামিল পরিচালক কে বালচন্দ্রের ছবি ‘মুন্দ্রু মুদিচু’। সঙ্গে কমল হাসান আর রজনীকান্ত। ‘গায়ত্রী’, ‘সিক্সটিন ভায়াথিনিলে’, ‘সিগাপ্পু রোজাক্কাল’—কখনো কমল হাসান, কখনো রজনীকান্তের সঙ্গে শুরু শ্রীদেবীর অবিরাম যাত্রা। ১৯৮৬-৮৭ সময়ে শ্রীদেবী পুরোপুরি অভিনয়প্রধান চরিত্রে মন দেন। এই যেমন ‘ঘর–সংসার’, ‘সুহাগন’, ‘নাগিনা’র পরই এল ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’।
শাড়িতে অনন্য
এ কথা বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হবে না, শ্রীদেবী নিজে ছিলেন তাঁর সময় থেকে এগিয়ে। পোশাকে ও শরীরী ভাষায়। নাচে, অভিনয়ে। ওই সময়, অর্থাৎ আশি অথবা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পোশাকে শ্রীদেবীকে অনুসরণ করতেন ভারত ও বাংলাদেশের অনেক নারী। তবে একটা পোশাক খুব মানিয়ে যেত শ্রীদেবীকে, শাড়িতে।
‘চাঁদনি’ ছবির গল্প যতজনের মনে আছে, নিশ্চিত করে বলা যায়, তার চেয়ে বেশি আছে শ্রীদেবীর সেই দৃশ্যগুলো। ছবির দৃশ্যগুলোয় বিভিন্ন শাড়িতেই ধরা দেন শ্রীদেবী। বিশেষ করে হলুদ রঙের শিফন শাড়িতে ওই গানটা—‘তেরে মেরে হোটোঁ পে’। কপালে হলুদ টিপ, পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্যের সঙ্গে শুভ্র সমুজ্জ্বল দর্শকের দৃষ্টিকে শান্তি দিয়েছিল। আর ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ ছবির গান, ‘কাটে নেহি কাটতি’। রিপোর্টারের চরিত্রে অভিনয় করা সারা ছবিতে আধুনিক পোশাকের শ্রীদেবীকে ‘কাটে নেহি কাটতি’ গানে নীল রঙের শিফন শাড়িতে দেখার কথা সহজে ভুলতে পারবেন দর্শক? ‘নাগিনা’ ছবির নাগিন নৃত্যে হলদে শাড়িও সাড়া ফেলেছিল। ‘লামহে’ ছবিতে শ্রীদেবীর দুটি শাড়ি সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছিল দর্শকের। একটি নীল রঙের, আরেকটি গোলাপি রঙের। এই তো সেদিনের ছবি ‘ইংলিশ ভিংলিশ’। একদমই শেষ জীবনের ছবি। সেখানে বেশির ভাগ সময় শ্রীদেবীকে দেখা যায় আটপৌরে শাড়িতে। অথচ সব কটিই সাড়া ফেলেছে দর্শকের মধ্যে।
কত উত্থান-পতন!
খুব অল্প বয়সে পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় ধরেছিলেন শ্রীদেবী। একবার এক সাক্ষাৎকারে আফসোস করে বলেন, ‘এমন একটা পরিস্থিতি এসেছিল, যখন সিনেমা আর পড়াশোনার মধ্যে আমাকে একটা বেছে নিতে হয়। আমি সিনেমা বেছে নিই। ইশ্! যদি আরও একটু পড়তে পারতাম!’ মাত্র চার বছর বয়স থেকে অভিনয় করেছেন শ্রীদেবী। আর ৮ বছর বয়সে, ১৯৭১ সালে মালয়ালাম সিনেমা ‘পুমবাতা’য় অভিনয়ের জন্য তিনি সেরা শিশু অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।
এরপর পাঁচ দশকের অভিনয়জীবনে তিনি ৩০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত সিনেমার মধ্যে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’, ‘চাঁদনি’, ‘চালবাজ’, ‘তোফা’, ‘গুমরাহ’, ‘মাওয়ালি’, ‘নাগিনা’ ও ‘সদমা’ অন্যতম। তামিল সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করা শ্রীদেবী দক্ষিণ ভারতকেও বঞ্চনা করেননি। রজনীকান্ত, কমল হাসান থেকে শুরু করে চিরঞ্জীবী—সবার সঙ্গেই কাজ করেছেন চুটিয়ে।
১৯৯৭ সালে শ্রীদেবীর ‘জুদাই’ সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর এই বৈচিত্র্যময় অভিনেত্রী চলচ্চিত্রশিল্পকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ২০১২ সালে ‘ইংলিশ-ভিংলিশ’ সিনেমার মাধ্যমে আবার চলচ্চিত্রজগতে ফিরে আসেন। ১৫ বছর পর সেই নির্বাসন ভেঙে ফিরে এসে পান ‘ভারতের মেরিল স্ট্রিপ’ খেতাব। ২০১৭ সালে সর্বশেষ তাঁকে ‘মম’ সিনেমায় দেখা গেছে। এর মাঝের সময়ে কত উত্থান-পতন! সেই শুরুতে, অভিনেত্রী মেয়ে যে পারিশ্রমিক পেতেন, তা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে বন্ধু-আত্মীয়দের ওপর ভরসা করতেন শ্রীদেবীর বাবা। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর আত্মীয়রা বিশ্বাসঘাতকতা করেন। সম্পত্তি নিয়ে ধারণা না থাকায় ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে বিপদ বাড়িয়েছিলেন মা। ওই সময় শ্রীদেবী কপর্দকশূন্য। শ্রীদেবীর মা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মস্তিষ্কে ভুল অস্ত্রোপচারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রতিবেশীর ছেলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেন বোন শ্রীলতা। মৃত্যুর আগে মা শ্রীদেবীর নামে সব সম্পত্তি লিখে দেন। তাই মামলা করেন বোন। দাবি করেন, উইল সইয়ের সময় মা প্রকৃতিস্থ ছিলেন না।