গত এক দশকে ভারতে খেলা নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে, খেলোয়াড়দের বায়োপিকের সংখ্যাও কম নয়। তবে সব সিনেমার মধ্যেও যেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম অমিত রবীন্দ্রনাথ শর্মার ‘ময়দান’। মুক্তির পর বেশির ভাগ সমালোচকের মত, খেলা নিয়ে ভারতের অন্যতম সেরা সিনেমা এটি।
‘ময়দান’ আদতে তৈরি হয়েছে ভারতীয় ফুটবল কোচ সৈয়দ আবদুল রহিমের জীবন অবলম্বনে। ছবিতে অভিনয়শিল্পীদের পারফরম্যান্স, ১৯৫০-৬০-এর কলকাতাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পর্দায় তুলে ধরা, সিনেমাটোগ্রাফির প্রশংসা করেছেন সমালোচকেরা। অন্য অনেক হিন্দি বায়োপিকের মতো এটিতে অতি বাণিজ্যিকীকরণ করার চেষ্টা না করে, গল্পকে বাস্তবসম্মতভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ জন্য বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছেন নির্মাতা।
সৈয়দ আবদুল রহিম ছিলেন হায়দরাবাদের, কর্মস্থল ছিল কলকাতায়। খেলোয়াড় চেনায় ছিলেন ওস্তাদ, খেলা নিয়ে তাঁর মতো স্ট্র্যাটেজি করতে পারতেন সে সময়ের কম কোচই। তবে এলাম, দেখলাম আর জয় করলাম—‘ময়দান’ তেমন গল্প নয়। বরং ফেডারেশনের রাজনীতি, নানা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে পোড় খাওয়া, হার না–মানা এক কোচের গল্প। বারবার ব্যর্থ হয়েছে দল, তবে আবদুল রহিম নিজের স্বপ্নকে ভোলেননি। বারবার বিশ্বাস করতেন, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো রসদ তাঁর দলেই আছে। দরকার কেবল তাঁদের সাহস জোগানো। তাই হেরে গেলেও খেলোয়াড়দের বুকে আগলে রেখেছেন তিনি।
সৈয়দ আবদুল রহিমের একটা বদভ্যাস ছিল, ঘন ঘন সিগারেট খেতেন। তাঁর হাতে সিগারেট নেই, এমন কমই হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ফুসফুস ক্যানসার হয়, কোচিং ছেড়ে চলে যান বাড়িতে। সামনে ‘নিশ্চিত’ মৃত্যু। কিন্তু স্ত্রী সায়রাও ছিলেন তাঁর মতো সাহসী। তিনিই স্বামীকে প্রেরণা জোগান—এভাবে মরে যাওয়ার চেয়ে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছোটাই ভালো। ফল, আবার কলকাতায় ফিরে আসেন রহিম। দল তত দিনে নতুন কোচ নিয়োগ দিয়েছে, তাঁরা আর রহিমের কথা শুনবে কেন। সবার কাছে হাত জোড় করে তবু আবার একটা সুযোগ চান রহিম। সুযোগ মেলে বটে, তবে জাকার্তা এশিয়ান গেমসে যাত্রা করার আগে পান নতুন দুঃসংবাদ। ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে এশিয়ান গেমসে ভারতীয় দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তত দিনে রহিমের সেই তেজ নেই, ক্যানসারের সঙ্গে লড়তে লড়তে তাঁর শারীরিক অবস্থাও সঙিন। তবু হাল ছাড়েন না রহিম। নাছোড়বান্দা কোচ কীভাবে দলটিকে নিয়ে অসাধ্যসাধন করেন, ‘ময়দান’ সেটারই বয়ান।
মূলত টান টান চিত্রনাট্য, দুর্দান্ত অভিনয়ের কারণেই ছবিটি আর দশটা হিন্দি সিনেমার চেয়ে আলাদা। এ ছাড়া ‘ময়দান’-এ যেভাবে ফুটবল খেলার দৃশ্যের চিত্রায়ণ করা হয়েছে, তেমনটা ভারতীয় সিনেমায় সেভাবে দেখা যায়নি।
১৯৫০-৬০-এর কলকাতাকে পর্দায় তুলে ধরা সহজ নয়। এর আগে কাজটি ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’ সিনেমায় কাজটা দারুণভাবে করতে পেরেছিলেন দিবাকর ব্যানার্জি। এবার সেটা করেছেন অমিত। একই সঙ্গে ‘ময়দান’-এর চিত্রগ্রাহক, শিল্পনির্দেশকও বিশেষ প্রশংসা পাবেন।
ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অজয় দেবগন। কোচ সৈয়দ আবদুল রহিমের চরিত্রে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর স্ত্রীর চরিত্রে প্রিয়া মণি, কলকাতার সাংবাদিকের চরিত্রে গজরাজ রাও ও ফুটবল সংগঠকের চরিত্রে রুদ্রনীল ঘোষও দারুণ অভিনয় করেছেন। ‘ময়দান’-এর বেশির ভাগ শুটিং হয়েছে কলকাতায়। ছবিটি আরও দুই বছর আগে মুক্তির কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে বারবার পিছিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত মুক্তির পর দর্শকের অপেক্ষা সার্থক হয়েছে।
নির্মাতা অমিত রবীন্দ্রনাথ শর্মার আগের সিনেমা ছিল ‘বাধাই হো’। সেই সিনেমাটি দর্শক-সমালোচকের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কমেডি ঘরানার ছবি থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার ছবি বানিয়ে নিজের কাজের বৈচিত্র্যের প্রমাণ দিলেন নির্মাতা।