অভিনেতা, পরিচালক ও প্রযোজক। এই তিনের সমাহার বলিউডে এখন নেই বললেই চলে! রাজ কাপুর তাই বলিউডে হয়ে আছেন স্মরণীয়, বরণীয়। তিন ক্ষেত্রে শুধু কাজই করেননি। প্রশংসা কুড়িয়েছেন, বলিউডের কিংবদন্তিতুল্যদের সঙ্গে আসন করে নিয়েছেন। তাঁর ছবি বক্স অফিসে যেমন ছিল ধুন্ধুমার ‘হিট’, ধ্রুপদি হিসেবেও নাম লিখিয়েছে কালের যাত্রায়।
কেউ তাঁকে বলেন, ভারতীয় সিনেমার তারকাদের তারকা। আবার কেউ তাঁকে বলেন, ভারতীয় সিনেমার চার্লি চ্যাপলিন। বলা ভালো, বাবা পৃথ্বিরাজ কাপুরের পর হিন্দি সিনেমায় ইতিহাস তৈরি করেছেন তিনি। আজ রাজ কাপুরের জন্মদিন, জন্মশতবর্ষ। ১৯২৪ সালের আজকের দিনেই পৃথ্বিরাজ ও কাপুর ও রামসরণী দেবী কাপুরের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে শেষ হয় জীবনযাত্রা। তবু এত বছর বাদেও একই রকম প্রাসঙ্গিক রাজ কাপুর।
চলচ্চিত্র পরিবারে বেড়ে ওঠা রাজ কাপুর মাত্র ১০ বছর বয়সে সিনে দুনিয়ায় পা রাখেন। ১৯৩৫ সালের ‘ইনকিলাব’ ছবির হাত ধরে। ১৯৪৭ সালে মধুবালার বিপরীতে মুখ্য চরিত্রে নজর কাড়েন ‘নীল কমল’ ছবিতে। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তিনি তৈরি করেন নিজের ফিল্ম স্টুডিও, আরকে ফিল্মস।
ভারতীয় সিনেমায় সবচেয়ে কম বয়সী পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘আগ’ ছবির মধ্য দিয়ে। জন্মদিনে আরেকবার দেখে আস যাক রাজ কাপুরকে, তাঁর কাজে, তাঁর শিল্পে।
বারসাত (১৯৪৯)
রাজ কাপুর পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি ‘বারসাত’। দুই জুটিকে নিয়ে ছবির গল্প। প্রাণ ও রেশমা—মানে রাজ কাপুর ও নার্গিস। এবং গোপাল ও নিলাম—অর্থাৎ প্রেম নাথ ও নিম্মি। ছবির পুরুষ চরিত্র প্রাণ ও গোপাল জিগড়ি দোস্ত। তবে দুজনই ভিন্ন স্বভাবের। প্রাণ সবকিছুতে সংবেদনশীল। অন্যদিকে গোপাল দুষ্ট চরিত্রের। দুজনেই প্রেমে পড়ে। প্রাণ ও রেশমা সফল হয় অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে। গোপাল আর সফল হতে পারে না। সে ছবির গল্পে হয়ে ওঠে খলনায়ক হিসেবে। রামানন্দ সাগরের লেখা কাহিনি। পরিচালনায় রাজ কাপুর। মুক্তি পেতেই হলে দর্শকের ঢল নেমেছিল।
আওয়ারা (১৯৫১)
তর্ক থাকতে পারে। তবে ‘আওয়ারা’ যে রাজ কাপুরের ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজ এই ছবিতে নানা কিছু নিরীক্ষা করেছিলেন। এক ছবিতেই মিশিয়েছেন নানা ঘরানা। ক্রাইম ড্রামা, রোমান্স কিংবা মেলোড্রামা—সবকিছুই আছে ছবিটিতে। ছবির গল্প একজন চোর (রাজ কাপুর), তাঁর প্রেমিকা রিতা (নার্গিস) ও বিচারক রগুনাথকে (পৃথ্বিরাজ কাপুর) নিয়ে। যেখানে বিচারক রগুনাথ জানেন না চোরই তাঁর ছেলে। আন্তর্জাতিক বাজারে ধুন্ধুমার আয় করে ‘আওয়ারা’। দেশেও বেশ সফল হয় এই ছবি।
শ্রী ৪২০ (১৯৫৫)
জনপ্রিয় ছবির মধ্যে ‘শ্রী ৪২০’-কে রাখা যায় অনায়াসে। নানা কারণে তখন জমে উঠেছিল ছবিটি। প্রথমত, সে সময় এটি ছিল চমৎকার কমেডি-ড্রামা। দ্বিতীয়ত, এই ছবির গান তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। বিশেষ করে মুকেশের গাওয়া ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ মানুষের মুখে মুখে ফিরত। তৃতীয়, এই ছবিতে রাজ কাপুরের চরিত্রে ছিল চ্যার্লি চ্যাপলিনের ছায়া। সবকিছু মিলে ছবিটি বক্স অফিসে ধুন্ধুমার আয় করে। ছবিটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নাদিরা ও নার্গিস অভিনয় করেন।
চোরি চোরি (১৯৫৬)
হলিউড ধ্রুপদি ছবি ‘ইট হ্যাপেনড ওয়ান নাইট’-এর অনুপ্রেরণায় বানানো হয় ‘চোরি চোরি’। এই ছবির জুটি নার্গিস ও রাজ কাপুর। তাঁদের অসাধারণ রসায়ন বক্স অফিসকে আবারও একটি চমৎকার ছবি উপহার দিল। বলা হয়ে থাকে নার্গিস ও রাজ কাপুরের জুটি হয়ে শেষ ছবিগুলোর একটি ‘চোরি চোরি’। ছবিটি পরিচালনা করেছেন অবশ্য অনন্ত ঠাকুর।
সঙ্গম (১৯৬৪)
‘সঙ্গম’ ভালোবাসার গল্প। ছবিতে অসাধারণ একটি চূড়ান্ত মুহূর্ত (ক্লাইমেক্স) না থাকলে ক্লিশে বলা যেত। ছবিটিতে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর বিশ্বাসঘাতকতা দেখানো হয়েছে। গল্পটি রাজ কাপুর, বৈজয়ন্তীমালা ও রাজেন্দ্র কুমারকে নিয়ে। তাঁরা একসঙ্গে বেড়ে ওঠেন। কিন্তু দুই বন্ধু যখন তাঁদের একজন নারী বন্ধু রাধার প্রেমে পড়েন, তখনই সমস্যা শুরু হয়। অসধারণ সব জায়গায় দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল ছবিটির। সে কারণে দর্শকের কাছে বেশ আকর্ষণীয় হয়। পাশাপাশি ছিল সবার অসাধারণ অভিনয়। বক্স অফিসে প্রশংসা কুড়ায় ছবিটি।
তেসরি কসম (১৯৬৬)
হিন্দি ভাষার লেখক ফনিশ্বরনাথ রেনুর ছোট গল্প মারে গায়ে গুলফাম। এই গল্প নিয়ে বানানো হলো ছবি ‘তেসরি কসম’। রাজ কাপুর ও ওয়াহিদা রেহমান মূল চরিত্রে। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে ছবির প্লট। গরুর গাড়ির একজন চালকের সঙ্গে নাটকের এক নৃত্যশিল্পীর প্রেম নিয়ে ছবির গল্প। ছবির গল্প ও অভিনয় এতটাই সুন্দর ছিল যে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় সিনেমাটি।
মেরা নাম জোকার (১৯৭০)
অভিনয়, পরিচালনা ও প্রযোজনা—এই ছবিতে তিন জায়গায়ই কাজ করেছেন রাজ কাপুর। ছবিটিকে ‘কাল্ট ক্ল্যাসিক’ হিসেবে ধরা হয়। অভিনয় কিংবা নির্মাণই নয়, ছবির কাহিনির দর্শনের জায়গা থেকেও ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমা বললে, রাজ কাপুরের চোখ যেত ‘মেরা নাম জোকার’-এর দিকে। শুধু তা–ই নয়, এই ছবি দিয়ে অভিষেক হয় রাজের ছেলে ঋষি কাপুরের।
ববি (১৯৭৩)
এই ছবির মাধ্যমেই ঋষি কাপুর এবং ডিম্পল কাপাডিয়া জুটির আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। সহজ, সোজা ভাষায় রাজু এবং ববির অল্প বয়সের প্রেম থেকে শুরু করে, কী করে তাঁরা নিজেদের প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করলেন, সেই গল্পই জানা গিয়েছিল। আজও দেখতে বসলে, কেউ একটুও একঘেয়েমি ফিল করবেন না। আবারও, যেমন জনপ্রিয় ছিল ছবির গান, তেমনই এই ছবির স্টোরিলাইন মন জয় করেছিল। কানাঘুষা শোনা গিয়েছিল ঋষির সঙ্গে এই ছবির পরেই প্রেমের সম্পর্ক দানা বাঁধছিল ডিম্পলের। যদিও সেটি পরে আর এগোয়নি।
সত্যম শিবম সুন্দরম (১৯৭৮)
শশী কাপুর এবং জিনাত আমান অভিনীত এই ছবিতে রাজ কাপুর দেখিয়েছিলেন রূপের থেকেও অন্তরের সৌন্দর্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাজীব যে গ্রামে আসে বাঁধ নির্মাণ করতে, সে একঝলকে রূপার প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু ছোটবেলায় মুখের এক অংশ পুড়ে যাওয়া রূপার আসল সৌন্দর্য দেখতে সে নারাজ। রোজ সকালে গান গেয়ে যে রূপা সবার ঘুম ভাঙায়, রূপের জন্য পিছিয়ে থেকে যায়। এই ছবি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
রাম তেরি গঙ্গা মইলি (১৯৮৫)
রাজীব কাপুর এবং মন্দাকিনী অভিনীত এই ছবি রাজ কাপুরের অনন্য কাজ। গঙ্গত্রীর গঙ্গা এবং কলকাতার নরেনের প্রেম এবং বিয়ে, তারপর এই সমাজে বাঁচতে গেলে এক নারী যাঁর স্বামীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই, তাঁকে কী কী করতে হয়, সেটাই দেখা গিয়েছিল এই ছবিতে।