গত এক দশকে বেশ কয়েকটি বিশ্বমানের সিনেমা নির্মাণ হয়েছে দক্ষিণ ভারতের মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রিতে। প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি সেগুলো বক্স অফিসেও দারুণ সাফল্য পেয়েছে। অল্প বাজেট, স্থানীয় গল্প আর ভালো নির্মাণ—এ পথেই বাজিমাত করছে মালয়ালম সিনেমা। মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রিতে কীভাবে নারীদের যৌন হেনস্তা করা হয়, তা বেরিয়ে এসেছে কেরালা রাজ্য সরকারের এক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদন ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছে কেরালা, যার ঢেউ ভারতের অন্যত্রও দেখা যাচ্ছে।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রযোজক তথা অভিনেতা দিলীপের বিরুদ্ধে গাড়ির মধ্যে যৌন হেনস্তার অভিযোগ আনেন এক মালয়ালম অভিনেত্রী। সে বছরের জুলাইয়ে অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু এর কিছুদিন পরই জামিনে বের হন অভিনেতা। পুনরায় বিচার শুরু হলেও বিচারকার্য প্রভাবিত করার অভিযোগ আনা হয় দিলীপের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা আমলে নেয়নি কেরালা হাইকোর্ট। এরপরও দমে যাননি অভিনেত্রী। অভিনেত্রীর পাশে তখন দাঁড়াতে থাকেন ইন্ডাস্ট্রির একাধিক সহকর্মী। বিষয়টি নিয়ে বেশ চাপে পড়ে কেরালা সরকার। এরপরই গঠন হয় হেমা কমিটি।
কেরালার হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে হেমার নেতৃত্বাধীন এ কমিটি রিপোর্ট জমা দেয় সাড়ে চার বছর আগে। তবে একাধিক আইনি চ্যালেঞ্জের পর ১৯ আগস্ট হেমা কমিটির ওই রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে কেরালা সরকার।
যৌন হয়রানির অভিযোগে নাম এসেছে একাধিক নামী পরিচালক থেকে অভিনেতার। প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে বেশ কয়েকজন নারী অভিনেত্রী প্রকাশ্যে ইন্ডাস্ট্রিতে যৌন নিপীড়ন এবং হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন কয়েকজন পুরুষ তারকার বিরুদ্ধে। এক ডজনের বেশি অভিযোগ পুলিশের কাছে দায়ের করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে দুজন পাল্টা অভিযোগও এনেছেন।
তিন সদস্যের একটি প্যানেলের ২৯০ পাতার এ রিপোর্টে মালয়ালম অভিনেত্রীদের যৌন হয়রানি, বেআইনি নিষেধাজ্ঞা, মাদক ও অ্যালকোহলের অপব্যবহার, পারিশ্রমিক বৈষম্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অমানবিক কাজের বিবরণ উঠে এসেছে।
যৌন হয়রানির অভিযোগে নাম এসেছে একাধিক নামী পরিচালক থেকে অভিনেতার। প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে বেশ কয়েকজন নারী অভিনেত্রী প্রকাশ্যে ইন্ডাস্ট্রিতে যৌন নিপীড়ন এবং হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন কয়েকজন পুরুষ তারকার বিরুদ্ধে। এক ডজনের বেশি অভিযোগ পুলিশের কাছে দায়ের করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে দুজন পাল্টা অভিযোগও এনেছেন।
প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসার পর গত সোমবার কোচি সিটি পুলিশ কমিশনারের কাছে মালয়ালম পরিচালক রঞ্জিত বালকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার লিখিত অভিযোগ করেছেন টালিউড অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র। অভিনেত্রীর অভিযোগ, ২০০৯ সালের ‘পালেরি মনিক্যম: ওরু পাথিরাকোলাপাথাকাথিনতে কথা’-এর অডিশনের সময়ে তাঁকে যৌন হেনস্তা করেছেন পরিচালক রঞ্জিত। প্রাথমিকভাবে অভিযোগ অস্বীকার করলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেরালার সরকারি সংস্থা ‘কেরালা চলচ্চিত্র একাডেমি’ থেকে পদত্যাগ করেন এ নির্মাতা।
হেমা কমিটি প্রতিবেদনের হাওয়া লেগেছে অন্য সংগঠনেও। রঞ্জিত বালকৃষ্ণনের পদত্যাগের পর অ্যাসোসিয়েশন অব মালয়ালম মুভি আর্টিস্ট সংগঠনের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন সুপারস্টার মোহনলাল। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ নেই। শুধু মোহনলাল নন, তিনিসহ কমিটির ১৭ সদস্য সবাই একযোগে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
জানা যায়, অ্যাসোসিয়েশন অব মালয়ালম মুভি আর্টিস্ট সংগঠনের দুই সদস্য তথা অভিনেতা সিদ্দিকী ও বাবুরাজের নাম এসেছে এ প্রতিবেদনে। তাঁরা একজন এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক, অন্যজন যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠার পরই মোহনলাল সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। তারপর বাতিল হয়ে যায় অ্যাসোসিয়েশন অব মালয়ালম মুভি আর্টিস্ট সংগঠনের এক্সিকিউটিভ কমিটি।
সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘কমিটির কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে কিছু অভিনেত্রী যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনেছেন। সেই দায় মাথায় নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সভাপতি এবং সংগঠনের প্রত্যেক সদস্য। আশা, দুই মাসের মধ্যে ফের নির্বাচন হবে। নতুন কমিটি গঠন করা হবে।’
জনপ্রিয় অভিনেতা ও সিপিআইএম বিধায়ক মুকেশ এবং অভিনেতা জয়সূর্যের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনেছেন অভিনেত্রী মিনু মুনির। তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন, একটি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় একজন অভিনেতা তাঁর অনুমতি ছাড়াই তাঁকে জড়িয়ে ধরেন এবং চুম্বন করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি আরও বেশ কিছু অভিযোগ সামনে আনেন, মুকেশ ও জয়সূর্যের নাম ছাড়াও সেখানে আরও দুজন অভিনেতার নাম রয়েছে। এরপরই গত সোমবার যুব মোর্চা ও মহিলা কংগ্রেস মুকেশের বিরুদ্ধে মামলার দাবিতে মিছিল ও অভিনেতার বাসভবনের সামনে স্লোগান দিতে থাকেন।
মুকেশ তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং মুনিরের বিরুদ্ধে তাঁকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করার অভিযোগ আনেন।
অভিনেতা সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন এক অভিনেত্রী। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে এবং অভিযোগকারীকে ‘তাঁর সুনাম নষ্ট করার’ চেষ্টা করার অভিযোগ আনেন সিদ্দিকী। এরপরই তিনি অ্যাসোসিয়েশন অব মালয়ালম মুভি আর্টিস্ট সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
হেমা কমিটির প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, মালয়ালম সিনেমা জগতে কয়েকটা ‘কোডওয়ার্ড’ প্রচলিত রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন স্তরে প্রবেশের জন্য যে শব্দগুলো কোডওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেগুলো হলো ‘সমঝোতা’ ও ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’। এর উদ্দেশ্য, এটাই বোঝানো যে এই জগতে যে নারীরা আসতে ইচ্ছুক, তাঁরা যেন ‘প্রয়োজনমতো’ পুরুষদের ‘যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখেন’। চলচ্চিত্র প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নবাগতদের সামনে একটা বিষয় বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কিন্তু ‘কাস্টিং কাউচ’ প্রচলিত পদ্ধতি। যাঁরা এই ব্যক্তিদের ‘জালে’ আটকা পড়েন, তাঁদের আবার ‘কোড নম্বরও’ দেওয়া হয়।
হেমা কমিটির পেশ করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ ঘটনায় তদন্তের জন্য এক সিনিয়র পুলিশ অফিসারের নেতৃত্বে বিশেষ তদন্ত দল গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারায় বিজয়ন।
মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রির একাধিক অভিনেত্রী তাঁদের সাক্ষাৎকারে এবং বিবৃতিতে যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কথা সবিস্তারে জানিয়েছেন, তাঁর পরিপ্রেক্ষিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী পিনারায় বিজয়ন।
ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আইজিপি জি স্পারজনের নেতৃত্বে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যারা প্রকাশ্যে আসা সব তথ্য এবং অভিযোগগুলোকে খতিয়ে দেখবে।
এরই মধ্যে কেরালা হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন, হেমা কমিটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট যেন আদালতে পেশ করা হয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি