বাণিজ্যিক সাফল্য আর শৈল্পিক মান—দুই সূচকেই কয়েক বছর ধরে আলোচনায় হরর সিনেমা। ভারতে আবার হরর-কমেডির রমরমা। কোন ধরনের হরর সিনেমা দেখছেন দর্শক? ভারতে জনপ্রিয়তা পাওয়া ভৌতিক সিনেমাগুলো কতটা দর্শক–চাহিদা পূরণ করতে পারছে? লিখেছেন লতিফুল হক
দিন কয়েক আগে সর্বকালের সেরা ১০০ হরর সিনেমার তালিকা প্রকাশ করেছে চলচ্চিত্রবিষয়ক মার্কিন সাময়িকী ভ্যারাইটি। এ তালিকার শীর্ষে আছে ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া টোবি হুপারের ‘দ্য টেক্সাস চেইন স ম্যাসাকার’। সেরা দশে আরও আছে ‘দ্য এক্সোরসিস্ট’, ‘সাইকো’, ‘জস’, ‘রোজমেরিজ বেবি’, ‘নাইট অব দ্য লিভিং ডেড’, ‘অডিশন, ‘ফ্রাঙ্কেনস্টেইন’, ‘সালে’, ‘অর দ্য ১২০ ডেজ অব সদম’ ও ‘ক্যারি’। শীর্ষ দশে এই শতাব্দীতে মুক্তি পাওয়া কোনো হরর সিনেমা নেই!
সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের মধ্যে সেরা দশে আছে কেবল ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া তাকাশি মিকের ‘অডিশন’। তবে কি আজকাল আর ভালো হরর সিনেমা হচ্ছে না? সমালোচকেরা মনে করছেন, হরর সিনেমার ধাঁচটাই এখন বদলে গেছে। হররের সঙ্গে কমেডির মিশেল, নানা সামাজিক বক্তব্য মেশানোর আরোপিত চেষ্টায় ভৌতিক সিনেমার আসল আমেজটাই হারিয়ে গেছে। এসব সিনেমায় সবই আছে, কেবল ভয়টাই আর নেই।
ভারতেও ইদানীং হরর-কমেডির বেশ রমরমা। এই ঘরানা প্রথম জনপ্রিয়তা পেয়েছে দক্ষিণে। পরে প্রযোজক দিনেশ বিজন তৈরি করেছেন ‘হরর ইউনিভার্স’। তাঁর প্রযোজিত স্ত্রী ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। চলতি বছর ছবিটির সিকুয়েল ‘স্ত্রী ২’ তো রেকর্ড ব্যবসা করেছে। একই প্রযোজকের আরেকটি হরর–কমেডি ‘মুনজ্যা’ও সুপারহিট।
কিছুটা হাস্যরস, কিছুটা ভয় ছিল এসব সিনেমায়; আর ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে কটাক্ষ। দর্শকপ্রিয়তা পেলেও অনেক সমালোচক এসব ছবিকে আসল হরর ছবি বলতে নারাজ। অনেকে আবার মনে করেন, ভারতের দর্শকের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছাতে গেলে এ ধরনের সিনেমাই জুতসই।
হিন্দি সিনেমার দর্শকের কাছে এখনো হরর সিনেমা বললে ভেসে ওঠে মধুবালার মুখ। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পাওয়া মহল সিনেমায় ‘ভূত’ হয়ে হাজির হয়ে দর্শককে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পরে নির্মিত হয় ‘ওহ কৌন থি’, ‘গুমনাম’, ‘কোহরা’র মতো আলোচিত হরর সিনেমা। তবে এ সময় হিন্দি সিনেমার নির্মাতারা ভয় পাওয়াতে প্রস্থেটিকস নয়; বরং আবহ তৈরিতেই জোর দিয়েছেন বেশি।
এরপর আসে রামজে ভ্রাতৃদ্বয় আর রামগোপাল ভার্মার যুগ। এ সময় পাওয়া যায় ‘রাত’, ‘ভূত’-এর মতো সিনেমা। আরও পরে দৃশ্যপটে হাজির হন বিক্রম ভাট। তিনি মূলত হলিউডের বিভিন্ন সিনেমার প্লটে কিছু বলিউডি মসলা মিশিয়ে সিনেমা বানাতেন। এ সময়ে নির্মিত ‘রাজ’, ‘১৯২০’-এর মতো সিনেমা দেখলেই তা বোঝা যায়। এসব চর্বিতচর্বণ শুরুতে দর্শক টানলেও পরে ফ্লপ হতে থাকে। নির্মাতারাও এ ধরনের সিনেমায় সেভাবে বিনিয়োগের সাহস করেননি।
তবে ভূত ঠিকই ফিরেছে, এবার হাস্যরসের মোড়কে। হরর-কমেডি আসলে কতটা ভৌতিক—এ আলোচনা অযৌক্তিক মনে করেন নির্মাতা অমর কৌশিক। ‘স্ত্রী’, ‘স্ত্রী ২’ নির্মাতা মনে করেন, ভারতীয় উপমহাদেশে ভয়ের সঙ্গে হাসি থাকবে, এটা একরকম অবধারিত। তাঁর ভাষ্য, ‘দরজার আড়াল থেকে কেউ ভয় দেখালে আপনি প্রচণ্ড ভয় পাবেন কিন্তু একটু পর সত্যিটা জানার পর নিজেই হেসে উঠবেন। আগে সিনেমায় ভূত এসেছে এক অচেনা, অজানা শক্তি হিসেবে। যখনই চেহারা দেখানো (ভূতের) শুরু হলো, ছবিগুলো প্রাপ্তবয়স্ক সনদ পেল। সিনেমায় যুক্ত হলো সহিংসতা, অন্তরঙ্গ দৃশ্য; নির্মাতাদের ভাবনা বদলে গেল। যুগে যুগে ভৌতিক সিনেমা নিয়ে নিরীক্ষা হয়েছে, হবে।’
আগামী ১ নভেম্বর মুক্তির অপেক্ষায় আছে আনিস বাজমির ‘ভুল ভুলাইয়া ৩’। বক্স অফিস বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এটিও আগের কিস্তির মতো সুপারহিট হবে; এসব ছবির পথ ধরে আসবে আরও হরর–কমেডির ঘোষণা। তবে কি সত্যিকারের হরর সিনেমার যুগ শেষ?
মনে হয় না। কারণ, তাহলে অন্তর্জালে সহজলভ্য থাকার পরও তুম্বাড় এত দর্শক হলে গিয়ে দেখতেন না। ২০১৮ সালে মুক্তির পর রাহি অনিল বার্বের তুম্বাড় সেভাবে ব্যবসা করতে পারেনি। অনেকে এতে গিয়ের্মো দেল তোরোর অতি প্রভাব খুঁজে পেয়েছিলেন, তবে মোটাদাগে সমালোচকদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয় ছবিটি। চলতি বছর আবারও মুক্তি পায় ছবিটি, সবাইকে আশ্চর্য করে প্রথমবারের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ব্যবসা করে। ছবিটির অন্যতম প্রযোজক আনন্দ এল রাই অবশ্য হরর আর হরর-কমেডি নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না।
তিনি মনে করেন, বলিউডে নির্মিত বাণিজ্যিক হরর-কমেডি সিনেমাগুলো এই ধাঁচের সিনেমার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নিরীক্ষাধর্মী ভৌতিক ছবিও দর্শক গ্রহণ করতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, দক্ষিণ ভারতের পর বলিউডেও হরর-কমেডি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় প্রযোজকেরা সামনে সে পথেই হাঁটবেন।
নিরীক্ষাধর্মী ভৌতিক ছবি হলে সেটা হয়তো ভারতের কোনো আঞ্চলিক ভাষায় হবে, বলিউডের মতো অতি বাণিজ্যনির্ভর ইন্ডাস্ট্রিতে সেটা কঠিন।
অনীক দত্তর ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর পর পশ্চিম বাংলায়ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে কমেডিনির্ভর হরর সিনেমা। তবে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ বাদে কোনোটিই সেভাবে সাফল্য পায়নি। কলকাতার এই অভিনেতা ও নির্মাতা বরাবরই হরর–কমেডির ভক্ত। তিনি মনে করেন, বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের প্রচুর গল্প, উপন্যাস আছে। ঠিকঠাকভাবে এগুলো পর্দায় তুলে আনলে দর্শকের আগ্রহ তৈরি হতে পারে।
সূত্র: ভ্যারাইটি, টাইমস নাউ, ইন্ডিয়া টুডে