বিশ্বজুড়ে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করেছে শাহরুখের ‘পাঠান’। ভারতের বক্স অফিসের আয়ে একের পর এক রেকর্ড গড়ছে। প্রতিদিন গড়ে সিনেমাটি শতকোটি রুপির বেশি আয় করে চমক দেখাচ্ছে। শাহরুখ–ভক্তদের উপচে পড়া উচ্ছ্বাসে আয়ে নতুন রেকর্ডের বার্তা দিচ্ছে ‘পাঠান’। জয় করে চলেছে নানা দেশের বক্স অফিস। অথচ সেই সিনেমার দক্ষিণের বাজার থেকে আয় হাতে গোনা কয়েক কোটি টাকা। এমনকি রাম চরণ, এনটিআর, নয়নতারাদের বাজার থেকে ‘পাঠান’–এর আয় অনেক গড়পড়তা সিনেমার চেয়ে অনেক কম। সেখানে হেরে গেছে ‘পাঠান’। শাহরুখের ব্লকবাস্টার সিনেমা হিসেবে দক্ষিণি বাজারে সিনেমাটির আয় এত কম কেন?
কোণঠাসা বলিউডের অস্তিত্ব গত বছরজুড়ে হুমকির মুখে ছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল বলিউডের কোনো ছবিই দক্ষিণের সিনেমাগুলোর সঙ্গে পেরে উঠছিল না। একের পর এক রেকর্ড গড়ছিল তামিল–তেলেগুর ‘আরআরআর’, ‘বিক্রম’, ‘পেন্নিয়িন সেলভান-১’, ‘বিস্ট’ সিনেমাগুলো। গত বছর আয়ে ভারতের মধ্যে শীর্ষ আয়ে ২ নম্বরে ছিল তেলেগু ‘আরআরআর’, সিনেমাটির আয় ১ হাজার ১৬৯ কোটি রুপি। ৫০০ কোটি রুপি আয় নিয়ে ৩ নম্বরে ছিল তামিল ভাষার ‘পেন্নিয়িন সেলভান-১’। তামিলের ‘বিক্রম’ ৪৪৬ কোটি রুপি আয় করে বছরের সর্বাধিক আয় করা সিনেমার তালিকায় ৪ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছি। ১০ নম্বরে ছিল তামিল ভাষার সিনেমা ‘বিস্ট’। সিনেমাটি আয় করেছিল প্রায় ৩০০ কোটি রুপি। এই সিনেমাগুলোর আয়ের বড় একটা অংশ যোগ হয়েছিল বলিউডের বাজার থেকে। অথচ শাহরুখের ‘পাঠান’ তামিল–তেলেগু ইন্ডাস্ট্রি থেকে আয় করেছে মাত্র ১০ কোটি রুপি। এই আয় ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে তুলনামূলক অনেক কম।
গত বুধবার মুক্তি পায় ‘পাঠান’। মুক্তির প্রথম থেকেই ‘পাঠান’–ঝড় বইতে থাকে ভারতজুড়ে। সেদিন ভারত থেকে সিনেমাটি আয় করে ১০২ কোটি রুপি। সেখানে তেলেগু (১ দশমিক ৫ কোটি), তামিল (৫০ লাখ) থেকে সিনেমাটি আয় করে ২ কোটি রুপি। অথচ এই বাজার থেকে ‘আরআরআর’ প্রথম দিনেই ১০ কোটির বেশি রুপি আয় করে। অন্যদিকে প্রথম দিনেই ‘আরআরআর’ বলিউড থেকে থলেতে ভরে ছিল ১৯ কোটি রুপি।
পরদিন বিশ্বব্যাপী সিনেমাটি আয় করে ১১৩ কোটি রুপি। সেদিন তেলেগু থেকে ‘পাঠান’ আয় করে ১ দশমিক ৭৫ কোটি রুপি। তামিল থেকে সিনেমাটি আয় করে ৭৫ লাখ রুপি। সব মিলিয়ে আড়াই কোটি রুপি। ‘পাঠান’ তৃতীয় দিনেও তার রেকর্ড অব্যাহত রেখে বক্স অফিস রেকর্ডে এগিয়ে যায়। কিন্তু সবচেয়ে কম আয় হতে থাকে তামিল–তেলেগু ইন্ডাস্ট্রি থেকে।
প্রথম ভারতীয় হিন্দি ভাষার সিনেমা হিসেবে দ্রুততম সময়ে ‘পাঠান’ দেশ ও বিদেশের আয় মিলিয়ে ৩০০ কোটির ক্লাবে প্রবেশ করে। সেদিন সিনেমাটি শতকোটি টাকা আয় করে। সব মিলিয়ে আয় ছিল ৩১৩ কোটি রুপি। তৃতীয় দিনে তেলেগু (৮৫ লাখ) তামিল (৪০ লাখ) থেকে পাঠানের আয় কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৫ লাখ রুপি। ‘পাঠান’ মুক্তির আগে থেকেই তুমুল আলোচনায় ছিল। সিনেমার ‘বেশরম’ গানটি মুক্তির পর ভারতজুড়ে সিনেমাটি নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়। তত দিনে সিনেমাটি আরও বেশি দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
‘পাঠান’ ভারতেই ভাঙতে থাকে ‘কেজিএফ’ ও ‘বাহুবলী’র রেকর্ড। চার বছর পরে মুক্তি পাওয়া শাহরুখের সিনেমাটি ৪ দিনেই ২০০ কোটি আয়ের ক্লাবে প্রবেশ করে। ২০০ কোটি আয় করতে ‘কেজিএফ-২’–এর লেগেছিল ৫ দিন, ৬ দিনে লেগেছিল ‘বাহুবলী’র। চতুর্থ দিনেও ‘পাঠান’ ১০০ কোটির বেশি আয় করে। চতুর্থ দিনে তেলেগু (১ কোটি ২৫ লাখ), তামিল (৫০ লাখ) থেকে আয় করে ১ কোটি ৭৫ লাখ রুপি। সব মিলিয়ে ৪ দিনে শাহরুখের ২০০ কোটির মধ্যে তামিল–তেলেগু থেকে পাঠান এর আয় সাড়ে ৭ কোটি রুপি। অথচ এই দুই ইন্ডাস্ট্রি থেকে তামিল, তেলেগু ভাষার সিনেমা শতকোটির বেশি আয় করেছিল। সেখানে শাহরুখের সিনেমার আয় এত কম কেন?
জানা যায়, দক্ষিণি বাজারে শাহরুখ, আমির, সালমানের সিনেমার দাপট কম। সেখানে সিনেমার দর্শক থাকলেও তাঁরা নিজেদের সিনেমা নিয়ে বেশি মাতামাতি করেন। তামিল, তেলেগু দর্শকদের মধ্যে নিজস্ব ভাষার সিনেমার প্রতি ভালোবাসা বেশি। পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখার চল থাকলেও তাঁরা শাহরুখ, আমির, সালমানদের চেয়ে নিজেদের ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের মাথায় তুলে রাখতে চান। যে কারণে বলিউডের সিনেমা নিয়ে তাঁদের আগ্রহ কম থাকে। তাঁদের রাজ্যে বলিউড সিনেমার প্রচার–প্রচারণাও থাকলেও তাতে তেমন আগ্রহ দেখান না। যে কারণে তামিল থেকে সব সময়ই বলিউড কম অর্থ আয় করে। তাঁদের রাজ্যে বলিউড সিনেমার প্রচার–প্রচারণা থাকলেও তাতে তেমন আগ্রহ দেখান না তাঁরা।
যে কারণে ভারত থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘পাঠান’–এর আয় সমান্তরালে থাকলেও তামিল–তেলেগু থেকে আয় কমেছে। গত রবি ও সোমবার সিনেমাটির আয় ছিল ভারত থেকেই ৫০ কোটি রুপির বেশি। সেখানে তেলেগু থেকে দুই দিনে আয় করছে দুই কোটি রুপি। তামিল থেকে আয় করেছে ৭৫ লাখ রুপি। ‘পাঠান’ গতকাল পর্যন্ত আয় করেছে ৫০৭ কোটি রুপির বেশি। এই আয়ে ভারত থেকে যোগ হয়েছে ৩০০ কোটি রুপি। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আয় এসেছে ২০৭ কোটি রুপি। গত বছর বাংলাদেশের দুই ব্যবসাসফল সিনেমা ছিল ‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’। সিনেমা দুটির বাংলাদেশ থেকে আয় ছিল ১০ কোটি টাকার বেশি। ‘পাঠান’ সেই অর্থও তামিল–তেলেগু থেকে আয় করতে পারেনি।
একটা সময় ছিল ভারতের দর্শক চেয়ে থাকত বলিউডের সিনেমার দিকে। বলিউডের রোমান্টিক, অ্যাকশন ও সামাজিক সিনেমাগুলো বছরজুড়ে দর্শকদের পছন্দের তালিকায় থাকত। একের পর এক বলিউডের সেসব সিনেমার ব্যবসায়িক রেকর্ড দেখতে হতো ভারতের অন্য ইন্ডাস্ট্রিকে। বছর শেষে বক্স অফিস আলোচনায় এগিয়ে থাকতেন অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, আমির, সালমান, অক্ষয়রা। সেখানে কন্নড়, তেলেগু, তামিল, মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রির সিনেমাগুলো একের পর এক দাপট দেখিয়েছে। তারা বলিউড থেকে শতকোটির বেশি রুপি নিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার আভাস দিলেন শাহরুখ। বছরের শুরুতেই বলিউডের জন্য ভালো সময় গেল। এই ধারাবাহিকতা কতটা বজায় থাকে, সেটাই এখন দেখার পালা।
তবে বলিউডকে যে টিকে থাকতে হবে, সেই আভাস ‘পাঠান’–এর সব শেষে দেওয়া হয়েছে। সিনেমায় শেষের অংশে পাশাপাশি বসে আছেন সালমান ও শাহরুখ খান। শাহরুখ সালমানকে বলছেন, ‘আর পারছি না রে, ভাবছি, ৩০ বছর তো হয়ে গেল, এখন আমাদের থামা উচিত।’ সালমান বলছেন, ‘কিন্তু আমাদের জায়গা কে নেবে?’ শাহরুখ বলছেন, ‘ওই ছেলেটা পারবে না?’ সালমান কিছুটা দোটানা নিয়ে বলেন, ‘না, পারবে না, আমাদেরই কিছু একটা করতে হবে।’ শাহরুখ বলছেন, ‘দেশের জন্য এটা লজ্জাজনক ব্যাপার, তরুণদের ওপর ভরসা করে লাভ নেই।’ দুজন বসে কথা বলছিলেন, শাহরুখ খান হাত বাড়িয়ে দিয়ে সালমানকে বলেন, ‘ধর, আমাকে ওঠা।’ বলিউড সিনেমা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, অংশটায় বলিউডের রাজত্বে ফেরার কথা বলা হয়েছে।