সর্বকালের সেরা ১০ ভারতীয় সিনেমা

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচকদের সংগঠন (ফিপরেস্কি) নির্বাচন করেছে সর্বকালের সেরা ১০ ভারতীয় সিনেমা। ফিপরেস্কি ইন্ডিয়ার ৩০ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে ছবিগুলো। সেরা ১০ সিনেমার মধ্যে ৪টিই বাঙালি পরিচালকদের নির্মিত ছবি।

পথের পাঁচালী, ১৯৫৫
পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি। চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রর প্রথম, দুই শিল্পীদেরও প্রথম—অনেক ‘প্রথম’ নিয়ে নির্মিত ছবিটি মুক্তির পরেই ইতিহাস গড়ে। এটিই ভারতের প্রথম সিনেমা, যা বিশ্ব চলচ্চিত্রে সাড়া ফেলে, মুক্তির এত বছর পরেও অনেক নির্মাতা প্রেরণা খুঁজে নেন ছবিটি থেকে। ফিপরেস্কি ইন্ডিয়ার সদস্যদের ভোটে সর্বকালের সেরা ছবি হয়েছে পথের পাঁচালী। এর আগে এটি জায়গা পেয়েছিল প্রখ্যাত সমালোচক রজার এবার্টের ‘সেরা ছবি’র তালিকাতেও। ছিল ২০০৫ সালে টাইম সাময়িকীর করা সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায়।

‘পথের পাঁচালী’ ছবির দৃশ্য

এ ছাড়া ২০১৮ সালে বিবিসির করা সমালোচকদের চোখে সেরা অ-ইংরেজিভাষী সিনেমার তালিকায় ‘পথের পাঁচালী’ ছিল ১৫ নম্বরে। আকিরা কুরোসাওয়ার প্রিয় এক শ ছবির তালিকারও শীর্ষে ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি। এই সময়ের প্রখ্যাত নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলানেরও প্রিয় সিনেমা এটি।

মেঘে ঢাকা তারা, ১৯৬০
তালিকার দুইয়ে রয়েছে আরেক প্রখ্যাত বাঙালি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ ছিল ‘অপু ট্রিলজি’র প্রথম কিস্তি। ঋত্বিকের ছবিটিও তাঁর ‘দেশভাগ ট্রিলজি’র প্রথম কিস্তি।

মেঘে ঢাকা তারা ছবির দৃশ্য

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থী নীতার (সুপ্রিয়া চৌধুরী) চোখ দিয়ে দেশভাগের পরের অবস্থা তুলে ধরেছেন পরিচালক। মনে করা হয়, ঋত্বিকের এ ছবিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরিচালকের মৃত্যুর পর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আরও বেশি কদর পায়। ভারত তো বটেই, ঋত্বিক হয়ে ওঠেন বিশ্ব চলচ্চিত্রে সমীহ জাগানো এক নাম।

‘ভুবন সোম’ ছবিতে ধারা বর্ণনাকারী ছিলেন অমিতাভ বচ্চন

ভুবন সোম, ১৯৬৯
মৃণাল সেন পরিচালিত ছবিটিকে ভারতের নিউ ওয়েভ সিনেমার অন্যতম পথপ্রদর্শক বলে মনে করা হয়। দেশটির জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের অর্থায়নে নির্মিত প্রথম দিককার সিনেমা ‘ভুবন সোম’। হিন্দি ছবিটির জন্য পরিচালক মৃণাল সেন, অভিনেতা উৎপল দত্ত জাতীয় পুরস্কার পান। ছবিটিতে শহুরে ও গ্রামীণ ভারতের বিভাজনের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থা, মমত্ববোধও তুলে ধরেন পরিচালক। ছবিতে ধারা বর্ণনাকারী ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, ‘ভুবন সোম’ দিয়েই শুরু হয় তাঁর চলচ্চিত্র-যাত্রা।

‘এলিপ্পাথায়াম’ সিনেমার পোস্টার

এলিপ্পাথায়াম, ১৯৮১
প্রখ্যাত মালয়ালম পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণনের ছবিটি জায়গা পেয়েছে সর্বকালের সেরা ভারতীয় সিনেমার তালিকার চারে। কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ারের পর লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের বার্ষিক পুরস্কার জেতে। এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক জানিয়েছিলেন, নিজের পরিবারের সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে ছবির প্রেরণা নিয়েছেন তিনি।

‘ঘাটশ্রাদ্ধ’ সিনেমার পোস্টার

ঘাটশ্রাদ্ধ, ১৯৭৭
কন্নড় সিনেমার অন্যতম পরিচালক গিরিশ কাসারাভাল্লির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা এটি। ২০০২ সালে ন্যাশনাল আর্কাইভ অব প্যারিসে এক শ সিনেমার মধ্যে একমাত্র ভারতীয় ছবি হিসেবে জায়গা পায় ঘাটশ্রাদ্ধ। ২০০৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়ায় ১৬ লাখ ভোট পেয়ে সেরা ২০ ভারতীয় সিনেমার একটি হয় ‘ঘাটশ্রাদ্ধ’।

ভারত ভাগ নিয়ে নির্মিত অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র মনে হয় ‘গরম হাওয়া’কে

গরম হাওয়া, ১৯৭৩
ভারত ভাগের পর এক মুসলিম ব্যবসায়ী ও তাঁর পরিবারের সংগ্রাম নিয়ে এম এস সথ্যুর সিনেমা। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আশঙ্কায় ছবিটি বছরখানেক আটকে রাখার পর ছাড়পত্র দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সেন্সর বোর্ড। তবে মুক্তির পর দর্শক, সমালোচক উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায়। উর্দু লেখিকা ইসমত চুগতাইয়ের অপ্রকাশিত গল্প অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন কাইফি আজমি ও শামা জাইদি। ভারত ভাগ নিয়ে নির্মিত অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র মনে হয় এটিকে।

‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রে চারুলতার চরিত্রে মাধবী মুখোপাধ্যায়

চারুলতা, ১৯৬৪
সর্বকালের সেরা ভারতীয় সিনেমার তালিকায় সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি ‘চারুলতা’। তালিকার তিনিই একমাত্র পরিচালক, যার দুটি সিনেমা স্থান পেয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিকে নিজের অন্যতম প্রিয় বলে অভিহিত করেছিলেন সত্যজিৎ। ২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সমালোচকেদের সেরা ছবির তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে ছিল ‘চারুলতা’। এটি প্রয়াত নির্মাতা জঁ-লুক গদারের সব সময়ের প্রিয় ছবির একটি। ১৯৯৬ সাল থেকে দ্য একাডেমির আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে ‘চারুলতা’।

‘অঙ্কুর’ নির্মিত হয় স্থানীয় কৃষকদের অর্থায়নে

অঙ্কুর, ১৯৭৪
হায়দরাবাদে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি দিয়ে নির্মাতা হিসেবে যাত্রা শুরু করেন শ্যাম বেনেগাল। ছবিটি নির্মিত হয় স্থানীয় কৃষকদের অর্থায়নে। ২৪তম বার্লিন উৎসবে সোনার ভালুকের জন্য লড়েছিল ছবিটি। লক্ষ্মী ও সূর্য চরিত্রটির জটিল বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে জাত বৈষম্য, ধনী-গরিব বৈষম্যসহ নানা সামাজিক বিষয়কে তুলে ধরেছেন পরিচালক।

‘পিয়াসা’য় ওয়াহিদা রেহমানের গুলাবো চরিত্রটি তৈরি হয়েছে বাস্তব চরিত্রের প্রেরণায়

পিয়াসা, ১৯৫৭
বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক ঘরানার সিনেমার মিশ্রণের অন্যতম সেরা উদাহরণ মনে করা হয় গুরু দত্তের সিনেমাটিকে। এতে ওয়াহিদা রেহমানের গুলাবো চরিত্রটি তৈরি হয়েছে বাস্তব চরিত্রের প্রেরণায়। ছবির অন্যতম চিত্রনাট্যকার আকবর আলভির একবার গুলাবো নামে এক যৌনকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার কাছ থেকেই চরিত্রটির প্রেরণা নেন তিনি। ছবিটিতে প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দেওয়ায় পরে আফসোস করেছেন দিলীপ কুমার। ২০০৫ সালে টাইম সাময়িকীর করা সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায় ছিল ‘পিয়াসা’।

মুক্তির পর ২০ বছর ধরে ভারতের সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমা ছিল ‘শোলে’

শোলে, ১৯৭৫
রমেশ সিপ্পি পরিচালিত সফল বাণিজ্যিক সিনেমা। মুক্তির পর ২০ বছর ধরে ভারতের সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমা ছিল এটি। বীরু, বাসন্তী, জয়, গব্বর সিং, জয় ছবির প্রতিটি চরিত্রই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, হয়ে ওঠে পপ কালচারের অংশ। গত কয়েক বছরে ‘বাহুবলী’, ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এর জনপ্রিয় সিনেমার চিত্রনাট্যকার ভি বিজয়েন্দ্র প্রাসাদ শোলেকে তাঁর অন্যতম প্রেরণা বলে অভিহিত করেছেন।