সর্বকালের সেরা দশ ভারতীয় সিনেমার তালিকা প্রকাশ করেছে চলচ্চিত্রবিষয়ক ভারতীয় গণমাধ্যম ফিল্ম কম্পানিয়ন
সর্বকালের সেরা দশ ভারতীয় সিনেমার তালিকা প্রকাশ করেছে চলচ্চিত্রবিষয়ক ভারতীয় গণমাধ্যম ফিল্ম কম্পানিয়ন

সর্বসেরা ১০ ভারতীয় সিনেমার তালিকা, আছে তিন বাংলা সিনেমাও

সর্বকালের সেরা দশ ভারতীয় সিনেমার তালিকা প্রকাশ করেছে চলচ্চিত্রবিষয়ক ভারতীয় গণমাধ্যম ফিল্ম কম্পানিয়ন। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এই তালিকার প্রথমে রয়েছে রমেশ সিপ্পির শোলে, দুইয়ে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী। এই তালিকায় জায়গা পেয়েছে তিনটি বাংলা সিনেমা। ১৫০ জনের বেশি পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, সমালোচকদের ভোটে তৈরি হয়েছে এই তালিকা। ভারতে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে মুক্তি পাওয়া আট ভাষার ৭৫০টির বেশি সিনেমা থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে এই দশ সিনেমা।  
মুক্তির পর ২০ বছর ধরে ভারতের সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমা ছিল ‘শোলে’

শোলে
বলিউডের ইতিহাসে ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের নাম ‘শোলে’। ১৯৭৫ সালে মুক্তির পরপরই সাড়া জাগিয়েছিল ছবিটি। এই ছবি তৈরির টাকাই ছিল না শুরুতে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সেই দিনের সংকটের কথা জানালেন ছবির পরিচালক। ‘শোলে’ ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন একঝাঁক বলিউড তারকা। তাঁরা হলেন সঞ্জীব কুমার, অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনি, জয়া বচ্চন প্রমুখ। বক্স অফিস সফলতার পাশাপাশি ভারতের একটি ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের মর্যাদাও পেয়েছে ‘শোলে’। রমেশ সিপ্পির ছবিটি জায়গা পেয়েছে ফিল্ম কম্পানিয়নের তালিকার শীর্ষে।

পথের পাঁচালী
সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবিটি মুক্তির পরেই ইতিহাস গড়ে। এটিই ভারতের প্রথম সিনেমা, যা বিশ্ব চলচ্চিত্রে সাড়া ফেলে, মুক্তির এত বছর পরও অনেক নির্মাতা প্রেরণা খুঁজে নেন ছবিটি থেকে। গত বছর ফিপরেস্কি ইন্ডিয়ার সদস্যদের ভোটে সর্বকালের সেরা ছবি হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’।

‘পথের পাঁচালী’র দৃশ্য।আইএমডিবি

এর আগে এটি জায়গা পেয়েছিল প্রখ্যাত সমালোচক রজার এবার্টের ‘সেরা ছবি’র তালিকাতেও। ছিল ২০০৫ সালে টাইম সাময়িকীর করা সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায়।

পিয়াসা
গুরু দত্তর সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালে। কলকাতার প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমাটিতে গুরু দত্ত ছাড়াও অভিনয় করেন মালা সিনহা, ওয়াহিদা রেহমান, জনি ওয়াকার। ২০০৫ সালে টাইম সাময়িকীর করা সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায় জায়গা পেয়েছিল সিনেমাটি। ছবিটির প্রধান চরিত্রে প্রথম পছন্দ ছিলেন দীলিপ কুমার। তবে অজানা কারণে শুটিংয়ের প্রথম দিন সেটে আসেননি অভিনেতা, পরিচালক গুরু দত্ত নিজেই তাই প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নেন। আমির খানের সবচেয়ে পছন্দের হিন্দি সিনেমা এটি।

জানে ভি দো ইয়ারোঁ
কুন্দন শাহ পরিচালিত বিদ্রূপাত্মক এই ব্ল্যাক কমেডি সিনেমায় অভিনয় করেন নাসিরউদ্দিন শাহ, রবি বাসওয়ানি, ওম পুরি, পঙ্কজ কাপুর, সতীশ কৌশিক ও নীনা গুপ্তা। পরিচালক নিজের প্রথম ছবিটি তৈরি করেন খুবই অল্প বাজেটে। ছবিটির জন্য মাত্র ১৫ হাজার রুপি পারিশ্রমিক নেন নাসিরউদ্দিন। কেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি-র ‘ব্লো আপ’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবিটি তৈরি করেন কুন্দন।  

মেঘে ঢাকা তারা ও মুঘল-ই-আজম
তালিকার পাঁচে যৌথভাবে রয়েছে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও কে আসিফের ‘মুঘল-ই-আজম’।

মেঘে ঢাকা তারা ছবির দৃশ্য

ঋত্বিকের ছবিটিও তাঁর ‘দেশভাগ ট্রিলজি’র প্রথম কিস্তি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থী নীতার (সুপ্রিয়া চৌধুরী) চোখ দিয়ে দেশভাগের পরের অবস্থা তুলে ধরেছেন পরিচালক। মনে করা হয়, ঋত্বিকের এ ছবিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরিচালকের মৃত্যুর পর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আরও বেশি কদর পায়।  

অন্যদিকে ‘মুঘল-ই-আজম’ ১৯৬০ সালে মুক্তি পায়। দুর্দান্ত রোমান্টিক গল্প আর গানের জন্য ভক্তদের কাছে এখনো সমান জনপ্রিয় সিনেমাটি। নওশাদের সুরে সিনেমার গানগুলো এখনো মুখে মুখে ফেরে। পনেরো বছর ধরে এটি বলিউডের সবচেয়ে আয় করা সিনেমা ছিল।

‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রে চারুলতার চরিত্রে মাধবী মুখোপাধ্যায়

চারুলতা
ফিল্ম কম্পানিয়নের তালিকায় জায়গা পাওয়া সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি ‘চারুলতা’। মণিরত্মম ছাড়াও কেবল সত্যজিতেরই দুটি সিনেমা তালিকায় স্থান পেয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিকে নিজের অন্যতম প্রিয় সিনেমা বলে অভিহিত করেছিলেন সত্যজিৎ। ২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সমালোচকদের সেরা ছবির তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে ছিল ‘চারুলতা’। এটি প্রয়াত নির্মাতা জঁ-লুক গদারের সব সময়ের প্রিয় ছবির একটি। ১৯৯৬ সাল থেকে দ্য একাডেমির আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে ‘চারুলতা’।

নায়কান
১৯৮৭ সালে ছবিটি ভারত থেকে অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিল। টাইম সাময়িকী মণিরত্মমের ছবিটিকে সর্বকালের সেরা এক শ সিনেমার তালিকায় রেখেছিল। গত শতকের আশির দশকে মুম্বাইয়ের এক গ্যাংস্টারের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল ছবিটি। ‘নায়কান’-এ অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে ভারতের জাতীয় পুরস্কার জেতেন কমল হাসান। ছবিটিতে আরও অভিনয় করেন সারাণ্য পোণভান্নান, টিনু আনন্দ, কার্তিকা, জনকরাজ, দিল্লি গণেশ।

‘সত্য’ সিনেমার দৃশ্য

সত্য
১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সত্য’ বদলে দেয় হিন্দি সিনেমার চেনা চিত্র। ক্রাইম ঘরানার এই সিনেমায় মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের যে বাস্তব চিত্র উঠে এসেছিল, তা ‘সত্য’-এর আগে খুব কম ছবিতেই দেখা গেছে। বিনোদনের অনেক উপাদান মজুত, সঙ্গে শৈল্পিক নির্মাণ—পরে তাই সর্বকালের সেরা হিন্দি সিনেমাগুলোর একটির স্বীকৃতি পেয়েছে ছবিটি। গত জুলাই মাসে ‘সত্য’ মুক্তির ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। গ্রাম থেকে আসা এক তরুণের মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ার গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘সত্য’।

ছবিটির পরিচালক যে ভারতের অন্যতম সেরা নির্মাতাদের একজন—রামগোপাল ভার্মা, সে কথা এত দিনে অনেকেই জেনে গেছেন। ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোয় অভিনয় করেন মনোজ বাজপেয়ী, ঊর্মিলা মাতন্ডকর, সৌরভ শুক্লা প্রমুখ। তবে ‘ভিকু মহাত্রে’ চরিত্রে অভিনয় করে মনোজ বাজপেয়ীর অভিনয় ক্যারিয়ার পুরোপুরি বদলে যায়। আগে যেখানে তিনি ছোটখাটো পার্শ্বচরিত্রের প্রস্তাব পেতেন, ‘সত্য’ মুক্তির পর বদলে যায় সে দৃশ্যপট।

ইরুভার
অনেক সাক্ষাৎকারেই ‘ইরুভার’কে নিজের সেরা কাজ বলে অভিহিত করেছেন মণিরত্মম। মোহনলাল, তাবু, প্রকাশ রাজ, ঐশ্বরিয়া রাইদের মতো তারকারা অভিনয় করেছেন এই সিনেমায়। করুণানিধি মুথুবেল, এম জি রামচন্দ্রন ও জয়ললিতা—এই তিন দক্ষিণি রাজনীতিবিদের জীবনের প্রেরণা নিয়ে ছবিটি বানিয়েছিলেন মণিরত্মম। ফলে মুক্তির পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘ইরুভার’-এর প্রদর্শনী নিয়ে বিক্ষোভ দেখায়। ছবিটির সংগীত পরিচালনা করেন এ আর রহমান।  

ভারত ভাগ নিয়ে নির্মিত অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র মনে হয় ‘গরম হাওয়া’কে

গরম হাওয়া ও গাইড
ভারত ভাগের পর এক মুসলিম ব্যবসায়ী ও তাঁর পরিবারের সংগ্রাম নিয়ে এম এস সথ্যুর সিনেমা ‘গরম হাওয়া’ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আশঙ্কায় ছবিটি বছরখানেক আটকে রাখার পর ছাড়পত্র দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সেন্সর বোর্ড। তবে মুক্তির পর দর্শক, সমালোচক উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায়। উর্দু লেখিকা ইসমত চুগতাইয়ের অপ্রকাশিত গল্প অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন কাইফি আজমি ও শামা জাইদি। ভারত ভাগ নিয়ে নির্মিত অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র মনে হয় এটিকে।

ফিল্ম কম্পানিয়নের করা সেরা সর্বকালের সেরা দশ ভারতীয় সিনেমার তালিকার ১০ নম্বরে ‘গরম হাওয়া’র সঙ্গে যৌথভাবে জায়গা পেয়েছে ‘গাইড’। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া বিজয় আনন্দ পরিচালিত সিনেমাটির প্রধান দুই চরিত্রে দেখা যায় দেব আনন্দ এবং ওয়াহিদা রেহমানকে। এটি তৈরি হয় আর কে নারায়ণের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে। সি ডি বর্মণের করা সিনেমার গানগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বলিউডের অন্যতম ক্ল্যাসিক সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ‘গাইড’কে।