সাধারণত খাঁটি বলিউডি ছবি যে রকম হয়, ‘রকি অউর রানি কি প্রেমকাহানি’ সে রকমটাই। টিজার, ট্রেলার, গান—সবকিছু দেখে কিছুটা অনুমান করা গেলেও গল্পে যে এতটা যে বাঁক রয়েছে, বুঝতেই দেননি পরিচালক করণ জোহর। হাসি–আনন্দ, বিনোদনের ভেতর দিয়ে একটা শিক্ষাও যেন দিয়ে গেল ছবিটি। শুরুর দিকে গল্পের গতি যেভাবে চলেছে, সময় বাড়তে বাড়তে যেন দর্শক নড়েচড়ে বসেছেন। শুরুটা কমেডি ধাঁচের কিছু মনে হলেও আস্তে আস্তে ডালপালা মেলতে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের গতানুগতিক প্রথা ভাঙার বার্তা খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক। অনেকটা ওষুধ খেতে অনীহা শিশুকে মিষ্টির ভেতর ট্যাবলেট ঢুকিয়ে খাইয়ে দেওয়ার মতো!
‘রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি’—এ বলিউডি ছবির সব ধরনের উপাদান ছিল। দর্শকের মন খারাপ হওয়ার মতো খুব একটা সুযোগ নেই। গল্প জমজমাট হয় রণবীর সিং–আলিয়া ভাটের সাক্ষাতের পর থেকেই। শেষ দৃশ্য পর্যন্ত দুর্দান্ত অভিনয়ে মাতিয়ে রাখেন তাঁরা।
পুরোপুরি বিনোদনধর্মী ছবির গল্পটা একটি উচ্চবিত্ত পরিবার আর একটি শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবার ঘিরে আবর্তিত। আলিয়ার পরিবার একটা সম্ভ্রান্ত বাঙালি, আর রণবীর ধনাঢ্য পাঞ্জাবি পরিবারের ছেলে। দুই পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রেমে পড়েন। পরিবার জানতে পেরে শুরু হয় পারিবারিক মতবিরোধ, নানান ঝামেলা—অবশেষে সুন্দর পরিণতি হয়।
বিপরীত মতাদর্শে বিশ্বাসী দুই পরিবারের ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেম হলে, তা কতটা কঠোর আকার ধারণ করে, ছবিটি যেন আবার মনে করিয়ে দেবে। প্রেমের একপর্যায়ে রকি ও রানি বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। বিত্তশালী পরিবারে রকির দাদি জয়া বচ্চন হঠাৎ নিয়ম করলেন, দুজনকে সংসার করতে হলে তিন মাসের জন্য বাড়ি অদলবদল করতে হবে। ছেলের বাড়িতে মেয়ে আর মেয়ের বাড়িতে ছেলে থাকবে। দুজনে দুই পরিবারে গিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে হোঁচট খেতে থাকে। কম পড়াশোনা ও সাধারণ জ্ঞান কম থাকায় সমাজ, রাজনীতি সম্পর্কে অল্প ধ্যানধারণা নিয়ে বাঙালি শিক্ষিত পরিবারে থাকতে গিয়ে জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হয় রকিকে। অকারণে হাসিঠাট্টার পাত্র হন। কোনোভাবে চ্যাটার্জি বাড়ির আপন হতে পারছিলেন না রকি। কীভাবে তাঁদের উচ্চশিক্ষিত মেয়েকে তাঁর বিয়ের সম্পর্কে জড়াবেন—এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে চ্যাটার্জি পরিবার!
অপর দিকে বাঙালি শিক্ষিতা, প্রগতিশীল রানিকে গোঁড়া রকির পরিবারে গিয়ে থাকতে হয়। তাঁকেও নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তবে রকির মতো রানি হোঁচট খাননি। বুদ্ধিমতী রানি কীভাবে সবকিছু হাতের মুঠোয় আনতে হয় তা ভালো করেই জানেন। কট্টরপন্থী, গোঁড়া, আত্মকেন্দ্রিক রকির দাদিকে বশে আনতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘খেলা হবে।’ ছবিতে প্রগতিশীল বুদ্ধিমান বাঙালি রানির কাছে হেরে যায় রকির দাদি জয়া বচ্চনের কট্টর ও নারীকে দাবিয়ে রাখার সাংসারিক রাজনীতি আর স্বার্থপর সব ভাবনাচিন্তা। এত কিছুর পরও বাঙালি রানির সঙ্গে পাঞ্জাবি রকি কিন্তু দর্শকমন জয় করেছে।
রকি তাঁর সহজ-সরল জীবনযাপন, হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে দর্শকমন জিতেছেন। গল্পে চমক ছিল আলিয়ার নৃত্যশিল্পী বাবার চরিত্র, যেখানে নৃত্যশিল্পীর চরিত্রে টোটা রায় চৌধুরী দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তাঁকে এভাবে দেখা যাবে, দর্শক হয়তো সিনেমা দেখার আগে অনেকে ভাবতেও পারেননি। প্রশংসিত হয়েছেন তথাকথিত জেদি দাদির চরিত্রে জয়া বচ্চন। তাঁর মুখে শোনা গেছে অমিতাভ বচ্চনের সেই ‘কাভি খুশি কাভি গম’ ছবির সংলাপ, যেখানে বলা হয়, ‘তাঁর কথাই পরিবারে শেষ কথা’। দর্শক মজা পেয়েছে আলিয়ার মুখে সাম্প্রতিককালে আলোচিত সংলাপ ‘খেলা হবে’ শুনেও। ছবিতে আছে মজার সব মুহূর্ত, রণবীরের বিভিন্ন কাণ্ডে দর্শককে হাসির খোরাক জুগিয়েছে। চূর্ণী গাঙ্গুলির মুখে পুরুষ-নারী সমতার কথা শুনে নারীরা মনে মনে বেশ খুশিই হবেন। আলিয়া-রণবীরের রোমান্স, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে দীর্ঘ চুমুয় প্রেমের মাঝে সুড়সুড়ি দিলেও অশ্লীল কিছু মনে হয়নি। শাবানা আজমিও দারুণ অভিনয় করেছেন। তাঁর বাংলা উচ্চারণও অনেকের চেয়ে ভালো ছিল। ধর্মেন্দ্রর চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও ছবিতে তাঁর আলাদাভাবে তেমন কিছু করার ছিল না।
‘রকি অউর রানি কি প্রেমকাহানি’ ছবির গল্প সাদামাটা হলেও নস্টালজিয়ায় পরিপূর্ণ। করণ জোহরের বাকি ছবির মতোই এই ছবিতেও গানগুলো চমৎকার ভূমিকা রেখেছে। নতুন গানের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি পুরোনো দিনের মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো গান ব্যবহৃত হয়েছে। কাশ্মীরের বরফঢাকা পাহাড়ে শিফন শাড়ি পরা আলিয়াকে চমৎকার লেগেছে। করণ জোহরের নায়িকারা এখন নারীবাদী, তারা লড়াই করে, প্রতিবাদ জানায়। এদিকে রকি হিসেবে রণবীরও অনবদ্য। নাচ-গান-কমেডিতে যতটা দক্ষতা দেখেছিয়েন, আবেগঘন দৃশ্যেও ততটাই সাবলীল। ঝকমকে পোশাকে বলিউড নাচ, আবার কত্থকে বেশ এনার্জেটিক লেগেছে। কারও মতে, রকি চরিত্রটি রণবীর ছাড়া আর কেই–বা করতে পারত।