বিধু বিনোদ চোপড়া
বিধু বিনোদ চোপড়া

‘টুয়েলভথ ফেল’ দিয়ে ফিরে এলেন ‘ভুলে যাওয়া’ ‘মিশন কাশ্মীর’ নির্মাতা

ভারতের আইপিএস কর্মকর্তা মনোজ কুমার শর্মার জীবনসংগ্রামের গল্পে নির্মিত সিনেমা ‘টুয়েলভথ ফেল’ নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। পর্দায় মনোজের সংগ্রাম দেখে বহু দর্শক কেঁদেছেন। সম্পাদনার টেবিলে ছবিটি দেখে পরিচালক বিধু বিনোদ চোপড়াও কেঁদেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ের হিন্দি সিনেমার খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো নির্মাতা হিসেবে বিধু বিনোদ চোপড়ার নাম সেভাবে জানতেন না। কেউ কেউ হয়তো ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’, ‘পরিণীতা’, ‘লাগে রাহো মুন্না ভাই’, ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘পিকে’র মতো সিনেমার প্রযোজক হিসেবে তাঁর নাম জানেন। অনেকেই জানেন না, হলে ‘টুয়েলভথ ফেল’ দিয়ে আলোচনায় এলেও নির্মাতা হিসেবে শুরুটা প্রায় পাঁচ দশক আগে।

রাজকুমার হিরানি, সঞ্জয় দত্ত ও বিধু বিনোদ চোপড়া; যাঁরা কাজ করেছেন ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ সিনেমায়

বিষয়বৈচিত্র্য, নির্মাণশৈলী বিবেচনায় বরাবরই নির্মাতা হিসেবে খ্যাতি ছিল তাঁর। বিধু বিনোদ চোপড়া সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক নির্মাতা। তাঁর বেশির ভাগ সিনেমা মুক্তির পর বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘কাল্ট’ মর্যাদা পেয়েছে।
বলা যায় ‘পারিন্দা’র কথা। মুক্তির পর তেমন ব্যবসা করতে না পারলেও এক অন্যতম ক্ল্যাসিক হিন্দি সিনেমা মনে করা হয় ‘পারিন্দা’কে। বিধু বিনোদন খুব অল্প বাজেটে গল্প বলার জন্যও খ্যাত। ‘পারিন্দা’ তিনি বানিয়েছিলেন মাত্র ১২ লাখ রুপিতে।
‘পারিন্দা’ তো বটেই, তাঁর সিনেমায় বারবার উঠে এসেছে বাস্তববাদ। মূল ধারার হিন্দি সিনেমায় যে রিয়েলিজম তুলে ধারা যায়, সেটা পর্দায় করে দেখিয়েছিলেন বিধু বিনোদ চোপড়া।
নির্মাতা নিজে কাশ্মীরের। তাই ভারতের এই রাজ্যের নানা বিষয় বারবার এসেছে তাঁর সিনেমায়। সেটা জঙ্গিবাদই হোক বা কাশ্মীর ছেড়ে পণ্ডিতদের চলে যাওয়া হোক। ‘মিশন কাশ্মীর’ থেকে ‘শিকারা’য় নিজের চেনা গল্প বলেছেন বিধু বিনোদ চোপড়া।
অনিল কাপুর, মাধুরী দীক্ষিত, ববি দেওল, হৃতিক রোশন থেকে প্রীতি জিনতা—সময়ের বড় তারকাদের সঙ্গে কাজ করেছেন বিধু বিনোদ। তবে তাঁর সিনেমা তারকার গল্প বলে না, বলে নিজের গল্পই। তারকারাও তাঁর সিনেমায় অন্যভাবে ধরা দেন, তাঁর অভিনয়ে আর অভিনয় মনে হয় না। ‘মির্জাপুর’-এর বিক্রান্ত ম্যাসি আর ‘টুয়েলভথ ফেল’-এর ম্যাসির মধ্যে কী প্রার্থক্য, তা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই জানেন।

‘খামোশ’ সিনেমার পোস্টার

ক্রাইম থ্রিলার ঘরানার প্রতি আলাদা আগ্রহ ছিল নির্মাতার। তবে ‘মার্ডার অ্যাট মানকি হিল’, ‘পারিন্দা’, ‘খামোশ’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘরানাকে ভিন্নভাবে হাজির করেছেন তিনি।
বিধু বিনোদ চোপড়ার আরেকটি উল্লেখযোগ্য সিনেমা ‘১৯৪২: আ লাভ স্টোরি’। ইতিহাসনির্ভর এই রোমান্টিক ড্রামার সিনেমা অসাধারণ সব গানের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটি ছিল আর ডি বর্মণের শেষ সিনেমার কাজ, এটি মুক্তির আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।
‘টুয়েলভথ ফেল’ নিয়ে চলচ্চিত্র সমালোচক ভরদ্বাজ রঞ্জনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৭১ বছর বয়সী এই পরিচালক বলেন, ‘সিনেমার গল্পটা মনোজের জীবনের গল্প, লাখো মানুষের জীবনের গল্প; আমারও জীবনের গল্প। আমার জীবনে এটিই একমাত্র সিনেমা, যেটি সম্পাদনার সময় আমি অঝোরে কেঁদেছি।’
চার বছরের চেষ্টায় ‘টুয়েলভথ ফেল’ নির্মাণ করেছেন ‘মিশন কাশ্মীর’, ‘১৯৪২: আ লাভ স্টোরি’, ‘পারিন্দা’, ‘শিকারা’ নির্মাতা বিধু বিনোদ চোপড়া। ৬৬ বছর বয়সে সিনেমাটির কাজে হাত দেন তিনি, ৭১ বছর বয়সে এসে সেটি আলোর মুখ দেখে। ঔপন্যাসিক অনুরাগ পাঠকের উপন্যাস ‘টুয়েলভথ ফেল’ অবলম্বনে সিনেমার চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি।

মনোজ শর্মা ও মনোজ চরিত্রের অভিনেতা বিক্রান্ত ম্যাসির সঙ্গে বিধু বিনোদ চোপড়া

সিনেমাটি কেন বিধু বিনোদ চোপড়াকে ছুঁয়ে গেছে, তার উত্তরও মিলেছে তাঁর কথায়। মনোজ শর্মার জীবনের সঙ্গে বিধু বিনোদের জীবনের খুব একটা তফাত নেই। কাশ্মীরে জন্ম নেওয়া বিধু বিনোদ নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই মুম্বাইয়ে এসেছিলেন।
সাক্ষাৎকারে সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে বিধু বিনোদ চোপড়া বলেন, ‘বাবাকে যখন বললাম, আমি সিনেমা বানাতে চাই, তখন বাবা বললেন, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? মুম্বাইয়ে যাবে? ওখানে তো না খেয়ে মরবে। আমি যখন অস্কারে মনোনয়ন পেলাম, তখন খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে বাবাকে ঘটনাটা বললাম। তিনি খুব খুশি হয়ে বললেন, কত পয়সাকড়ি দেবে? আমি বললাম, কোনো পয়সাকড়ি নেই। শুনে তিনি আমাকে একটা চড় বসিয়ে বললেন, তাহলে তুমি এখন খুশি কেন?’
গত ২৭ অক্টোবর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘টুয়েলভথ ফেল’। ২৯ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছে ডিজনি প্লাস হটস্টারে। মূলত ডিজনি প্লাস হটস্টারে মুক্তির পর ভারতের বাইরের দর্শকের নজরে এসেছে ছবিটি। এই সিনেমায় কিংবদন্তি নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমায় রবিশঙ্করের আবহসংগীতকে ‘ট্রিবিউট’ দেওয়া হয়েছে। প্রায় আড়াই মাসের চেষ্টায় ‘টুয়েলভথ ফেল’–এর আবহসংগীত করেছেন শান্তনু মৈত্র।
বাস্তব ও পর্দার মনোজ শর্মার মতো স্বপ্নকে পুঁজি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিধু বিনোদ চোপড়া। পরিচালনার পাশাপাশি প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও চিত্রসম্পাদক হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’, ‘পরিণীতা’, ‘লাগে রাহো মুন্না ভাই’, ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘পিকে’–এর মতো সিনেমা প্রযোজনা করেছেন বিধু বিনোদ চোপড়া।

‘শিকারা’ সিনেমার পোস্টার

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে জন্ম ও বেড়ে উঠেছেন বিধু বিনোদ চোপড়া। তিনি পুনের ‘ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া’-তে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৭৬ সালে স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘মার্ডার অ্যাট মনকি হিল’ দিয়ে নির্মাণে অভিষেক ঘটে তাঁর। ১৯৭৬ সালে নির্মিত তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ‘আন এনকাউন্টার উইথ ফেসেস’ অস্কারে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিল।
১৯৮১ সালে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘সাজায়ে মউত’ নির্মাণ করেন তিনি। এরপর ‘খামোশ’, ‘পারিন্দা’ নির্মাণ করে হিন্দি সিনেমায় নিজের ছাপ রেখেছেন বিধু বিনোদ চোপড়া। ১৯৮৫ সালে তিনি বিধু বিনোদ চোপড়া ফিল্মস নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান করেন তিনি।

‘১৯৪২: আ লাভ স্টোরি’ সিনেমার পোস্টার

১৯৭৬ সালে ভারতের চিত্রসম্পাদক রেনু সালুজাকে বিয়ে করেন বিধু বিনোদ চোপড়া। ১৯৮৩ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। সেই বছর নির্মাতা শবনম সুখদেবকে বিয়ে করেন বিধু বিনোদ চোপড়া এবং ১৯৮৯ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। বিধু বিনোদ ও শবনম ইশা চোপড়াও একজন নির্মাতা। ১৯৯০ সাল থেকে চিত্রসমালোচক অনুপমা চোপড়ার সঙ্গে সংসার করছেন তিনি। তাঁদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।