‘তখন পরিচালকেরা মনে করতেন, পুলিশ হওয়ার জন্যই জন্ম হয়েছে আমার। আমি সত্যি সত্যি গাড়িতে পুলিশের ইউনিফর্ম নিয়ে ঘুরতাম। কারণ, পরিচালকেরা দেখা হলেই ডাকতেন, ‘বেটা, চলে এসো, একটা পুলিশ চরিত্র আছে, করে যাও।’ আপনি যদি নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার নিয়মিত দর্শক হয়ে থাকেন, তবে উক্তিটি কার, সেটা আন্দাজ করার কথা। হ্যাঁ, কথাগুলো অক্ষয় কুমারের। ২০১৭ সালের সেরা অভিনেতাদের নিয়ে একটি গোলটেবিল করেন চলচ্চিত্র সমালোচক রাজীব মাসান্দ।
সেখানেই কথাগুলো বলেন অক্ষয়। এ কথা কারোরই অজানা নয় নব্বইয়ের শুরুর দিকে প্রায় সব ছবিতেই তৃতীয় বা চতুর্থ প্রধান একটি চরিত্র থাকে, যেটি অবধারিতভাবেই হয় পুলিশ। আর সেই চরিত্রে ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ অক্ষয় কুমার। অভিনেতা নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি তখন অভিনয় করতেন টাকার জন্য। অনেক পরে যখন মনে হয়েছে, যথেষ্ট পয়সা হয়েছে; তখনই অন্য ধরনের সিনেমা করা শুরু করেন। এরপর টানা সাফল্যও দেখেছেন তিনি। তবে কয়েক বছর ধরে মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখছেন তিনি—তাঁর অভিনীত সিনেমাগুলো একের পর এক ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু কেন এই ব্যর্থতা? জেনে নেওয়া যাক সম্ভাব্য পাঁচ কারণ।
সিনেমা বেশি, ব্যর্থতাও বেশি
২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭—টানা তিন বছর অভিনেতার প্রতিটি সিনেমাই ভারতে কমপক্ষে দেড় শ কোটি রুপি ব্যবসা করেছে! অথচ সেই অক্ষয়ের ‘বচ্চন পান্ডে’, ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’, ‘কাঠপুতলি’, ‘রাম সেতু’, ‘সেলফি’, ‘মিশন রানীগঞ্জ’, ‘রক্ষা বন্ধন’, ‘বড়ে মিয়া ছোটে মিয়া’, ‘সারফিনা’ ডাহা ফ্লপ করেছে।
এটা কেবল ২০২২ থেকে সিনেমার হিসাব। এর মধ্যে কেবল গত বছর মুক্তি পাওয়া ‘ওএমজি ২’ মোটামুটি আয় করেছে। ছবির তালিকা দেখে নিশ্চয়ই অনেকে চোখ কপালে উঠে গেছে, মাত্র দুই বছরেই এতগুলো সিনেমা! এক দশক ধরে প্রতিবছর চারটি করে সিনেমা মুক্তি দেওয়ার নীতি মেনে চলছেন। প্রথম দিকে এ কৌশল সাফল্য পেলেও গত বছর ধরে সেটা কাজে আসেনি।
অনেক সমালোচক তো এক বছরে এতগুলো সিনেমা মুক্তি দেওয়াকে বিরক্তিকর বলেও অভিহিত করেছেন। চলতি বছরই তাঁর তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। যার মধ্যে সর্বশেষটি ‘খেল খেল ম্যায়’ মুক্তি পেয়েছে গতকাল, ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে। প্রথম দিনে মাত্র পাঁচ কোটি রুপির মতো আয় করেছে সিনেমাটি। আশ্চর্য কিছু না ঘটলে এটিও ফ্লপ হতে যাচ্ছে।
রিমেক নির্ভরতা
‘বচ্চন পান্ডে’, ‘কাঠপুতলি’, ‘সেলফি’, ‘সারফিনা’সহ আরও কয়েকটি সিনেমা ছিল দক্ষিণি ছবির রিমেক। গত কয়েক বছর ধরেই ভারতে রিমেক সিনেমার বাজার মন্দা। ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফর্মসহ নানা মাধ্যমে দক্ষিণি সিনেমাগুলো মুক্তির পরেই দেখে নিচ্ছেন দর্শকেরা। তাই পরে এসব সিনেমার হিন্দি রিমেকে আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না তাঁরা। কিন্তু এ বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন অক্ষয়। তাই একের পর এক রিমেকে অভিনয় করে গেছেন তিনি। ফল, অবধারিত ব্যর্থতা।
হিন্দি সিনেমার বাজার মন্দা
গত বছর ‘পাঠান’ দিয়ে ভারতের বক্স অফিস চাঙা হয়। জানুয়ারিতে শাহরুখ খান অভিনীত সিনেমা মুক্তির পর বছরের বাকি সময়ে আরও কিছু সিনেমা হিট হয়েছে। কিন্তু তাঁর আগের কয়েক বছর ছিল হিন্দি সিনেমার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। তখন কোনো সিনেমাই চলেনি। ফলে অক্ষয়ের মতো বড় তারকার সিনেমায় বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ভালো নির্মাতার সঙ্গে কাজ না করা
অক্ষয়ের ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অক্ষয়ের বদল শুরু ২০১২ সালে, ‘ওএমজি: ও মাই গড’ দিয়ে। তবে সেটাও কমেডি ঘরানার। অক্ষয় মানেই ‘সস্তা কমেডি’-এ ধারণায় জোরে ধাক্কা আসে ২০১৩ সালে। নীরজ পান্ডের সঙ্গে ‘স্পেশাল ২৬’ নিয়ে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হয় অক্ষয়ের। যাঁরা নীরজ পান্ডের ‘আ ওয়েনেসডে’ দেখেছিলেন তাঁরা শুরুতে অক্ষয়কে নেওয়ায় বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এক জাল সিবিআই অফিসারের চরিত্রে টানটান অভিনয় অক্ষয়ের সামনে নতুন দরজা খুলে দেয়। এর ধারাবাহিকতায় পরিচালকের পরের ছবি ‘বেবি’তে সিক্রেট এজেন্ট হন অক্ষয়। এরপর আরও কয়েকজন দক্ষ নির্মাতার সঙ্গে কাজ করেছেন অভিনেতা। কিন্তু ধারাবাহিকতা ছিল না। এ সময়ের আলোচিত নির্মাতাদের সঙ্গে তাঁর সিনেমা সেভাবে নেই। এটাকেও তাঁর ব্যর্থতার বড় কারণ মনে করা হয়।
চিত্রনাট্য বাছাইয়ে দুর্বলতা
২০০২ থেকে পরের এক দশক সস্তা কমেডির জন্য সমালোচিত হয়েছেন অক্ষয়। যদিও এ সময়ে ‘হেরা ফিরি’র মতো ছবিও করেছেন। পরেশ রাওয়াল, সুনীল শেঠির সঙ্গে দর্শকপ্রিয় বেশ কয়েকটি ছবি আছে। তবে গত কয়েক বছরে অক্ষয়ের মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে আবারও চিত্রনাট্য বাছাইয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
এখনকার দর্শক যে ধরনের সিনেমা পছন্দ করেন, অক্ষয়ের কথা সিনেমাগুলো যেন সেখান থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। সমালোচনা মাথা পেতে নিয়েছেন অভিনেতা। অক্ষয় নিজে মনে করেন, জন্মগতভাবে ততটা প্রতিভাবান অভিনেতা তিনি নন। কঠোর পরিশ্রমের পর, নানা হোঁচট খাওয়ার পর তিলে তিলে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। এমন এক অবস্থান, যেখানে তাঁর অর্থ, খ্যাতি আর যশ নিয়ে চিন্তা নেই। অন্য ‘বড়’ তারকাদের মতো ভক্তদের বিরাট চাপ নেই। তাই একের ছবি করতে পারছেন।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, পিংকভিলা, কইমইডটকম