গত বছরের এই আগস্ট মাসেই মুক্তি পেয়েছিল আমির খান অভিনীত সিনেমা লাল সিং চাড্ডা। দেশটির স্বাধীনতা দিবসের আগে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি নিয়ে প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। তবে সবাইকে অবাক করে বক্স অফিসে চরমভাবে ব্যর্থ হয় সিনেমাটি। ২০২২ সাল ছিল হিন্দি সিনেমার জন্য মন্দার বছর, কেবল লাল সিং চাড্ডা নয়; বছরজুড়েই একের পর এক বড় বাজেটের সিনেমা মুখ থুবড়ে পড়েছে। অভিনেতা, সমালোচক থেকে প্রযোজক—হিন্দি সিনেমার ব্যর্থতা নিয়ে অনেকেই অনেক তত্ত্ব দিয়েছেন। তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি। কিন্তু এক বছর পর সেই আগস্টেই বদলে গেছে হিন্দি সিনেমার বক্স অফিসের চেহারা। ১১ আগস্ট মুক্তি পেয়েছে দুই হিন্দি সিনেমা ওএমজি টু ও গদার টু। দুটি সিনেমাই বক্স অফিসে দুর্দান্ত ব্যবসা করছে। ২৫ আগস্ট মুক্তি পাওয়া ড্রিম গার্ল ২ সিনেমাটিও হাঁটছে হিটের পথে। কিন্তু কোন মন্ত্রবলে হারানো জমিন ফিরে পেল হিন্দি সিনেমা? সেটাই জানার চেষ্টা করা যাক।
‘পাঠান’-ঝড়
চলতি বছর শুরুর আগে অনেক বিশ্লেষকই বলেছিলেন, শুরুতে যদি কোনো বড় সিনেমা পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলিউড। তাঁদের পূর্বাভাস যে মিথ্যা ছিল না, তা এত দিনে অনেকেরই জানা হয়ে গেছে। গত ২৫ জানুয়ারি মুক্তির পর পাঠান ব্যবসা করেছে ১ হাজার ৫০ কোটি রুপি! গত কয়েক বছরের হিসাব করলে যা অবিশ্বাস্য অঙ্ক।
মূলত পাঠান সিনেমার এই রেকর্ড ব্যবসা হিন্দি ছবির প্রতি দর্শক-প্রযোজক সবারই আস্থা ফিরিয়েছে। দক্ষিণি সিনেমার দাপটে হিন্দি সিনেমা আড়ালে চলে গিয়েছিল, পাঠান দিয়ে বলিউড ভালোভাবেই নিজের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। ভারতের জরিপ প্রতিষ্ঠান অরম্যাক্স মিডিয়ার হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ভারতের সিনেমার যে ব্যবসা হয়েছে, তার ১৩ শতাংশই পাঠান-এর।
২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করা ১০টি সিনেমার ৫টিই হিন্দি। ভারতের সিনেমার ব্যবসার সামগ্রিক হিসাব করলে আয়ের ৩৭ শতাংশই দখল করে আছে বলিউড, যার ভিত্তিটা বছরের শুরুতে গড়ে দিয়েছিল পাঠানই।
রিমেকে না
চলতি মাসেই নিজের জন্মদিন উপলক্ষে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সারা আলী খান জানিয়েছেন, তিনি আর রিমেক সিনেমায় অভিনয় করবেন না। সারার এমন সিদ্ধান্তের কারণ সহজেই অনুমেয়। গত বছর একের পর এক হিন্দি রিমেক মুক্তি পেয়েছে, এক দৃশ্যম ২ ছাড়া সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে। চলতি বছরও ফর্মের তুঙ্গে থাকা অভিনেতা কার্তিক আরিয়ানের সিনেমা শেহজাদা ডাহা ফ্লপ হয়। এটিও ছিল দক্ষিণি সিনেমার রিমেক। রিমেকের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে বক্স অফিস বিশ্লেষক তরণ আদর্শ হিন্দুস্তান টাইমস–এ বলেন, ‘নানা কারণে এসব সিনেমা চলেনি। এর মধ্যে বড় কারণ হলো, সিনেমাগুলো ছিল দক্ষিণি ছবির হিন্দি রিমেক। শেহজাদা, সেলফির মতো বড় আয়োজনের সিনেমা দর্শকের প্রত্যাশা মেটাতে পারিনি। ওটিটির কারণে এখন আগেই দক্ষিণি সিনেমাগুলো মানুষ দেখে ফেলেন, কোভিডের সময় অনেকেই এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।’ দর্শকের অনাস্থা বুঝে রিমেকের বদলে হিন্দি সিনেমার প্রযোজক ও নির্মাতারা জোর দিয়েছেন মৌলিক সিনেমায়, যার ফলও মিলছে।
বাণিজ্যে মন
সাধারণ দর্শকের বিনোদনের খোরাক নেই—গত বছর হিন্দি সিনেমার ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে বেশির ভাগ বিশ্লেষক এই রায় দিয়েছিলেন। চলতি বছরের হিন্দি সিনেমার রমরমা দেখে মনে হচ্ছে, পরিচালকেরা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। পাঠান, রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি থেকে গদার ২; ২০২৩ সালে সাফল্য পাওয়া সব সিনেমাই মোটা দাগে বাণিজ্যিক ঘরানার। এসব সিনেমায় সাধারণ দর্শকের জন্য যথেষ্ট বাণিজ্যিক মসলা ছিল। এই যেমন বক্স অফিসে মাত্র ১৭ দিনে ৪৫০ কোটি রুপির বেশি ব্যবসা করা গদার ২-এর কথাই ধরা যাক। সমালোচকেরা ছবিটিকে পাত্তা না দিলেও দর্শক ঠিকই আপন করে নিয়েছেন। নিজে এ ধরনের সিনেমা খুব একটা পছন্দ না করলেও হিন্দি সিনেমা ব্যবসা করছে, এতেই খুশি হয়ে নির্মাতাদের তারিফ করেছেন অনুরাগ কাশ্যপ।
আবেগের জয়
‘অনেক দর্শকই ছবিটি দুই বা তিনবার দেখেছেন। আরিয়ান-কাণ্ডসহ নানা ঘটনায় তাঁদের মনে হয়েছে, ছবিটি দিয়ে শাহরুখ খান একধরনের প্রতিশোধ নিয়েছেন। প্রিয় তারকার সাফল্যে দর্শকও শরিক হতে চেয়েছেন। ছবিটি মুক্তির যাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদেরও বার্তা দিতে চেয়েছেন দর্শক,’ পাঠান-এর সাফল্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলেন হিন্দি সিনেমার বাণিজ্য বিশ্লেষক অতুল মোহন।
এই বিশ্লেষক মনে করেন, সিনেমার সাফল্যের জন্য কনটেন্টের সঙ্গে দর্শকের আবেগের যোগ তৈরি হওয়া জরুরি। পাঠান ও গদার ২ সিনেমায় দেশাত্মবোধ নিয়ে বার্তার কারণে দর্শক সিনেমাটির সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেছেন।
গত বছর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন অভিনেতা সালমান খান ও নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপ। দুজনই বলেছিলেন, হিন্দি সিনেমায় কেবল শহরের গল্প দেখতে দেখতে মানুষ বিরক্ত। এসব সিনেমা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা বড়সংখ্যক দর্শককে আকর্ষণ করে না।
দক্ষিণি হাওয়া কম
গত বছর দক্ষিণি সিনেমার দাপটে পেছনে পড়ে গিয়েছিল হিন্দি সিনেমা। বিশেষ করে কেজিএফ ২, আরআরআর, কানতারা, পোন্নিইন সেলভান ১, বিক্রম-এর সামনে দাঁড়ানোর মতো হিন্দি সিনেমা ছিল না। কিন্তু চলতি বছর সেভাবে তেমন কোনো বড় দক্ষিণি সিনেমা মুক্তি পায়নি। যা পেয়েছে, সেগুলোও বলার মতো সাফল্য পায়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আদিপুরুষ-এর কথা। ফলে, ‘ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে হিন্দি সিনেমার উত্থান আরও সহজ হয়েছে।
এরপর কী
বছরের অষ্টম মাসে এসেই হিন্দি সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানো স্পষ্ট, বাকি চার মাসে সেটা আরও বড় আকারে দেখা যাওয়ার কথা। কারণ, আগামী মাসগুলোয় মুক্তির অপেক্ষায় আছে জওয়ান, দ্য ভ্যাকসিন ওয়ার, টাইগার ৩, অ্যানিমেল, মেরি ক্রিসমাস, ডানকির মতো সিনেমা। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এসব সিনেমা মুক্তির পর চলতি বছর হতাশা কাটিয়ে নতুন গল্প লিখবে বলিউড।