বড় পর্দা হোক বা ওটিটি—সর্বত্র তাঁর অবাধ বিচরণ। ‘টিকু ওয়েডস শেরু’র পর নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর আরেকটি সিনেমা ‘হাড্ডি’ও মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। মুম্বাইয়ের ভার্সোবায় নওয়াজের নতুন ঠিকানা ‘নওয়াব’-এ অভিনেতার মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধি
নওয়াজকে শেষ বড় পর্দায় দেখা গেছে ‘জোগিরা সারা রা রা’ ছবিতে। এই ছবিতেও নায়কের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। এখন নওয়াজকে মূল নায়ক হিসেবেই পর্দায় বেশি দেখা যায়। অথচ একসময় সহ–অভিনেতা হিসেবে তাঁকে দেখা যেত বেশি।
আলাপের শুরুতে এ প্রসঙ্গ উঠতেই নওয়াজ বলেন, ‘দেখুন, মূল চরিত্র ছাড়া আমি আর অভিনয় করব না। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ১০-১২ বছর ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেই খুশি থাকতাম। কোনো কোনো ছবিতে মানুষের ভিড়ে একটা মুখ ছিলাম আমি। কিন্তু এসব ঢের হয়েছে। এখন চিত্রনাট্যে আমি শুধু আমার চরিত্র দেখি। আর দেখি মূল চরিত্রে আমি আছি কি না।’
কেমন ধরনের চরিত্রে নিজেকে দেখতে চান? জবাবে এই বলিউড তারকা বলেন, ‘আমি সব সময় সাধারণ মানুষের চরিত্রে নিজেকে দেখতে চেয়ে এসেছি। এসব চরিত্রে একজন মানুষের অন্তর দেখতে পাওয়া যায়। আমি চাই, আরও জটিল ও ব্যতিক্রমী চরিত্র অন্বেষণ করতে। অভিনয়কে ঘিরে আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে চাই। আমি চাই, অভিনেতা হিসেবে নিজেকে অস্বচ্ছন্দের জায়গায় রাখতে। নায়ক মানেই পর্দায় আমরা লার্জার দেন লাইফ দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি উল্টো।’
দীর্ঘ সংগ্রামের পর নওয়াজ আজ হিন্দি ছবির দুনিয়ায় নিজের জায়গা পাকা বানিয়ে ফেলেছেন। অবশ্য সংগ্রামের সেই দিনগুলোতেও কাজের জন্য কোনো প্রযোজকের দরজায় কড়া নাড়েননি তিনি।
এই বলিউড অভিনেতা বলেন, ‘আমি কখনো কারও কাছে কাজ চাইনি। এমনকি ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোতেও নয়। রোজ লাইনে দাঁড়িয়ে অডিশন দিতাম, আর বাদ পড়তাম। এই করতে করতে সাত বছর কেটে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কাজ পাচ্ছিলাম না। কাউকে কাজের জন্য বলতেও আমার সংকোচ হতো। একসময় হতাশ হয়ে পড়ি। পরিচালক কাইজাদ গুস্তাদ আমাকে যেমন আছি, তেমনই থাকতে বলেন। এরপর আমার বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। আর আমি স্থির করি যে কখনো কারও কাছে কাজ চাইব না।’ ভাগ্যে খুব একটা বিশ্বাসী নন নওয়াজ। তিনি মনে করেন, কঠোর পরিশ্রমই শেষ কথা। ভাগ্যের প্রসঙ্গ উঠতে নওয়াজুদ্দিন বলেন, ‘আমি মনে করি, ভাগ্য তাঁরই সঙ্গে থাকে, যিনি পরিশ্রম করেন। শুধু ভাগ্যের ভরসায় বসে থাকলে কখনো কিছু করা যাবে না। আমার জীবনে এখন পর্যন্ত খুব ভালো কিছু হয়নি। আমি ধীরে ধীরে সফলতার সিঁড়ি চড়ছি। এখন পর্যন্ত ভাগ্যের কারণে আমার জীবনে কিছু ঘটেনি। আগামী দিনে ম্যাজিক্যাল কিছু ঘটলে নিশ্চয়ই ভাগ্যে বিশ্বাস করতে শুরু করব।’
নওয়াজ জানান, তাঁর এই ফিল্মি ভ্রমণ এখনো অসম্পূর্ণ। আরও অনেক পথ তিনি চলতে চান। নিজেই বলেন, ‘জানেন, অভিনয়ের মাধ্যমে আমি শ্বাসপ্রশ্বাস নিই। এটা নিয়েই আমি বেঁচে আছি। আমি চাই অন্তহীন পথ চলতে।’ জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপের প্রসঙ্গে তিনি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি হয়ে জন্মানোটা সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।’ কিন্তু কেন? এর জবাবে নওয়াজ আনমনা হয়ে বলেন, ‘কারণ বলতে পারব না।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু নাটকের বই আমি পড়েছি। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে যেকোনো লেখা পেলে পড়ি, সংগ্রহ করি। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর “আনওয়ার কা আজব কিসসা” ছবিতে কাজ করেছি। বাংলার পরিচালকদের চিন্তাভাবনা একদম আলাদা। মন থেকেই বলছি, বাংলা সিনেমার কারণেই আজ ভারতীয় ছায়াছবি এত সমৃদ্ধ।
চিত্র সমালোচকদের সমালোচনা তিনি কীভাবে নেন? জবাবে এই দাপুটে অভিনেতা বলেন, ‘একজন সমালোচকের উচিত, একটা ছবিকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা। ছবিটা ভালো না মন্দ, তা দর্শকের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। আমি মনে করি, একজন সমালোচকের দায়িত্ব সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখা। এখন তো আবার নতুন উৎপাত বয়কট–ট্রেন্ড। এভাবে চলতে থাকলে সিনেমার একদিন অপমৃত্যু হবে।’
নওয়াজ তাঁর নতুন বাংলোটা ঘুরে দেখালেন। খেয়াল করলাম, বৈঠকখানার দেয়ালজুড়ে সারা বিশ্বের নামকরা নাট্যব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতি। তিনি বলেন, ‘আমি মঞ্চের মানুষ। চেয়েছিলাম এনএসডির সেই দিনগুলোকে অনুভব করতে। আর তাই ভেবে রেখেছিলাম যে নিজের বাড়ি নাট্যকারদের ছবি দিয়ে সাজাব। যেসব নাট্যকার আমাকে অনুপ্রাণিত করেন, এখানে তাঁদেরই ছবি আছে।’ বললেন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার প্রাক্তন ছাত্র নওয়াজুদ্দিন। বাংলোর একদিকে তাঁর সাজানো লাইব্রেরিতে বেশ কিছু বাংলা বই নজরে পড়ল। জানালেন, একটুআধটু বাংলা তিনি পড়তে পারেন। নওয়াজ বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু নাটকের বই আমি পড়েছি। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে যেকোনো লেখা পেলে পড়ি, সংগ্রহ করি। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর “আনওয়ার কা আজব কিসসা” ছবিতে কাজ করেছি। বাংলার পরিচালকদের চিন্তাভাবনা একদম আলাদা। মন থেকেই বলছি, বাংলা সিনেমার কারণেই আজ ভারতীয় ছায়াছবি এত সমৃদ্ধ।’
বাংলাদেশের জনপ্রিয় পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ ছবিতে নওয়াজুদ্দিন অভিনয় করেছেন। তিনি বলেন, ‘ফারুকী আমার খুব ভালো বন্ধু। ফারুকী ডাকলে আবার নিশ্চয়ই তাঁর ছবিতে অভিনয় করব। এ ছাড়া বাংলা ছবিতে ডাক পেলে নিশ্চয়ই যাব।’ বাংলোয় ঘুরতে ঘুরতে বললেন, ‘কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি, এ রকম একটি বাংলো বানাতে পারব। কারণ, একটা কাজ পাওয়াও আমার জন্য কঠিন ছিল। তবে মুম্বাই আমাকে আমার আশার থেকে অনেক বেশি দিয়েছে। এই শহরে ট্রাফিকসহ অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু মনে হয়, মুম্বাই সবার স্বপ্ন পূরণ করার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে। আর সারা দুনিয়ায় সম্ভবত এ রকম শহর একটাই আছে।’