বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গনে এখন আলোচিত ঘটনা ‘জওয়ান’ সিনেমার মুক্তি। আগামী শুক্রবার সিনেমাটি সারা বিশ্বে একযোগে মুক্তি পাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো ভারতের কোনো সিনেমা একই দিনে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে। এ ঘটনায় উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছে শাহরুখভক্তদের মধ্যে। তাঁরা সিনেমা মুক্তির খবরে নিজ উদ্যোগে শহরে প্রচারণায় মেতেছেন, সিনেমা হলে গিয়ে শাহরুখের পোস্টার সেঁটেছেন। কেউ আবার বিশেষ এই সুখবর উদযাপন করতে সিনেমা হলে কেক কেটেছেন। এর মধ্যেই ‘জওয়ান’ ঘিরে শুরু হয়েছে অন্য আলোচনা। দেশে একই দিনে ‘জওয়ান’ মুক্তি দিলে কার লাভ কার ক্ষতি?
গতকাল রোববার সন্ধ্যার কথা। বসুন্ধরার স্টার সিনেপ্লেক্স শাখার দৃশ্য অন্য রকম। অনেকেই এসেছেন ‘জওয়ান’ সিনেমার টিকিট কাটতে। তেমনই একজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোবায়ের রহমান জানান, তিনি শাহরুখের ভক্ত। মুক্তির দিনই তিনি সিনেমাটি দেখতে চান। কিন্তু টিকিট পাননি। তিনি বলেন, ‘এখনো টিকিট দেওয়া শুরু হয়নি। কবে দেবে বলতে পারে না।’ সিনেপ্লেক্সে দায়িত্বরত এক ব্যক্তি বলেন, প্রতিদিন টিকিট কাটতে অনেক দর্শক আসছেন। সিনেপ্লেক্সটির ফেসবুক পেজেও দেখা গেল অনেক ভক্ত কবে টিকিট পাওয়া যাবে, সে প্রশ্ন করছেন। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘কবে থেকে যে টিকিট শুরু করতে পারব, সেটা এখনো বুঝতে পারছি না। কারণ, সিনেমাটি যাঁরা আমদানি করছেন, এটা তাঁদের ওপর নির্ভর করছে। এতটুকু শুনেছি যে সিনেমাটি আজ (সোমবার) সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা দেখবেন। সেন্সর পেলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি হবে। তখন আমরা দুই–এক দিনের মধ্যে হয়তো টিকিট বিক্রি শুরু করে দেব। প্রচারণায় যাব।’
‘জওয়ান’ নিয়ে বেশ আশাবাদী মেজবাহ উদ্দিনসহ মাল্টিপ্লেক্সগুলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সিনেমা চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে মেজবাহ উদ্দিন মনে করেন, ভারতীয় সিনেমাই নয়, একই দিনে অন্য দেশের সিনেমা বাংলাদেশে মুক্তি পেলেও দর্শকের সাড়া বেশি পাওয়া যায়। যে কারণে ‘জওয়ান’ মুক্তিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘একই দিনে “জওয়ান” মুক্তি পেলে এটা ভালো দিক। কারণ, সিনেমাটি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ রয়েছে। ভালো সাড়া পাচ্ছি, যেটা “পাঠান” সিনেমার সময় দরকার ছিল। কিন্তু তিন মাস পর আসায় সাড়া মোটামুটি ভালো হলেও আশানুরূপ তেমন বেশি কিছু ছিল না। সালমানের সিনেমাটি নিয়েও আগ্রহ অনেক কম দেখেছি। এবার আশা করছি যে ‘জওয়ান’ ভালো দর্শক দেখবেন।’
একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সিনেমা হল যশোরের মনিহারে মুক্তি পাবে শাহরুখ খানের ‘জওয়ান’। তবে বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। খবর নিয়ে জানা যায়, মনিহার কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আগামী সপ্তাহে কোন সিনেমা মুক্তি পাবে, সেটার প্রচারণায় এখনো যায়নি কর্তৃপক্ষ। আজ রাতেই তারা সিদ্ধান্ত নেবে। সিনেমা হলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। তবে কথা হচ্ছে।’ শুনলাম ‘জওয়ান’ সিনেমা নিয়ে কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘“জওয়ান” এখনো সেন্সর সার্টিফিকেট পায়নি। যদি পায়, যদি দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়, তাহলে আমরা অবশ্যই সিনেমাটি চালাব। এর আগে “পাঠান” মুক্তি দিয়ে সুবিধা করতে পারিনি। কারণ, অনেক পরে দেশে মুক্তি পেয়েছে। আমরা আর কত লস দিয়ে হল চালাব? এখন “জওয়ান” কতটা সুবিধা করতে পারবে, সেটা মুক্তির পরই বলা যাবে।’
ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ গত চার মাসে আমদানি করা সিনেমা থেকে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ‘পাঠান’ দিয়ে গড়পড়তা ব্যবসা হয়েছে, এমনটাই বললেন কেউ কেউ। তাঁরা জানান, সে অর্থে দর্শক সিনেমাটি দেখেননি। তার চেয়ে সালমান খানের ‘কিসি কা ভাই কিসি কি জান’ সিনেমাটি কম দর্শক দেখেছেন। সে কারণে বিদেশি সিনেমার ওপর ভরসা করতে চান না সিঙ্গেল সিনেমা হলের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। জিয়া বলেন, ‘ঈদের পর আমাদের “প্রিয়তমা” ও “সুড়ঙ্গ” ছাড়া আর কোনো ভালো ছবি নেই। আমাদের অবস্থা আগের মতোই। এর মধ্যে যদি একটা ভালো সিনেমা দেশ থেকে পাওয়া যেত, তাহলে আমাদের সংকট তৈরি হতো না।’
দেশের সিনেমা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন গুণী এক সমালোচক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশেই অনেক নির্মাতা ভালো ছবি বানিয়েও পরে একের পর এক দর্শকদের হতাশ করেন। পরবর্তীকালে তাঁদের ছবি মোটামুটি ভালোও হয় না। এ যুগেও এসেও সেগুলো নিয়ে কথা বললে এফডিসির অনেক পরিচালক খেপে যান। আবার অনেকে দেশের সিনেমাকে বাঁচানোর কথা বলে ইতিবাচক কথা লিখতে বলেন। এটা কোনো শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে চলে? এটা তো একধরনের প্রতারণা। মাঝারি মানের কোনো সিনেমাকে ভালো বলে দর্শকদের হলে আনা হলে সেই দর্শক হতাশ হবেন। তাঁর মাধ্যমে আর দর্শক আসবে না। অথচ একসময় দর্শকদের মুখে মুখে সিনেমার প্রচারণা হতো। আমি মনে করি, আমাদের দুই মাস পরপর ভালো মানের ছবি দরকার। ছয়টি সিনেমা হলেই হল ঘুরে যাবে। তাহলে আর কোনো হলকে বিদেশের সিনেমার ওপর নির্ভর করতে হবে না।’
কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান বললেন ভিন্ন কথা। তিনি দেশে সিনেমার স্বার্থের কথা মনে করিয়ে দিলেন। তিনি বলেন, ‘উৎসবের বাইরে সিনেমা মুক্তি পেতেই পারে। এটা তো নিয়ম আছে। কিন্তু দেশের সিনেমার স্বার্থ কতটা থাকছে, সেটাই মুখ্য। সম্প্রতি আমাদের “অন্তর্জাল” সিনেমাকে সরে আসতে হলো। ঝন্টু ভাইয়ের একটি সিনেমা মুক্তি পাবে। তিনি হয়তো সরবেন না। কারণ, তাঁদের মধ্যে সিনেমা হল নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই। হয়তো ঝন্টু ভাইয়ের সিনেমা সিনেপ্লেক্সগুলো চালাবে না। আবার ঢাকার বাইরে অনেক হলে আমদানিকারকেরা ‘জওয়ান’ চালাবেন না। এসব নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হবে না। কিন্তু প্রশ্ন তৈরি করবে।’
এ সময় মতিন রহমান আরও বলেন, ‘ভারতের সিনেমা আনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, সিঙ্গেল বা একক হল বাঁচানো। সিনেপ্লেক্সগুলো সব সময় মোটামুটি ভালোই ব্যবসা করে টিকে থাকতে পারে। এখানেই আমার প্রশ্ন, সিঙ্গেল হল কি এভাবে বাঁচানো যাবে? উদ্দেশ্য কি বাঁচানো নাকি আমদানিকারকদের ব্যবসা? প্রথমত, যদি ব্যবসা করতে চান, তাহলে কি খুব বেশি সিঙ্গেল হলে মুক্তি দেবেন ‘জওয়ান’? দেবেন না। কারণ, ওই সব হলে ভালো পরিবেশ নেই, পর্দা ভালো নয়, ‘জওয়ান’–এর অরিজিনাল সাউন্ড কি দর্শক পর্বত, পূরবীতে পাবেন? হয়তো শ রিল হিসেবে কিছু হলে মুক্তি দিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষকে দেখানো হবে।
এটা এখনো বলা যাচ্ছে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, আমদানিকারকদের লক্ষ্য হলো সিনেপ্লেক্স। প্রযুক্তিনির্ভর এই সিনেমা সিনেপ্লেক্সের জন্যই। এতে তাদেরই লাভ বেশি হবে। সঙ্গে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের লাভ। দর্শক তৃপ্তিসহকারে ভারতের সিনেমা দেখবেন, সে হিসেবে তাঁদেরও লাভ। এখন একই দিনে মুক্তির তালিকায় ছিল ‘অন্তর্জাল’।
সেটা তালিকা থেকে তুলে নিয়েছেন পরিচালক। শাহরুখের সিনেমার সঙ্গে এটি মুক্তি পেলে কজন দেখবেন? দর্শক না দেখলে সিনেমা ফ্লপ। পরিচালকের ক্যারিয়ার পড়ে যাবে। এসবে আমাদের স্বার্থ কীভাবে রক্ষা হলো?
বাংলাদেশে ‘জওয়ান’ আমদানির অনুমতির বিষয়টি নিশ্চিত করে কমিটির অন্যতম সদস্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াৎ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি-রপ্তানি নীতিমালা কমিটির মিটিংয়ে ছবিটিকে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে দুই দেশে একই সঙ্গে মুক্তির বিষয়ে জোর দিয়েছে কমিটি। আমদানিকারকদের সেভাবেই দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
‘জওয়ান’ বাংলাদেশে আসছে মুম্বাইয়ে পরিবেশক প্রতিষ্ঠান সিনেকন এন্টারটেইনমেন্টের কাছ থেকে। ‘জওয়ান’ আমদানির বিপরীতে ভারতের এসএস আর এন্টারটেইনমেন্টের কাছে বাংলাদেশ থেকে ‘নবাব এলএলবি’ ছবিটি রপ্তানি করা হয়েছে। অ্যাটলি কুমার পরিচালিত ‘জওয়ান’ সিনেমাটিতে শাহরুখ খানের বিপরীতে অভিনয় করেছেন নয়নতারা। এ ছাড়া ছবিতে আছেন বিজয় সেতুপতি, সানিয়া মালহোত্রা, প্রিয়ামনি প্রমুখ।