>১৬ বছর পর বাঙালি অভিনেতার বাংলায় অভিনয় সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখে সেলুলয়েডের দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। এরপর রজনীকান্ত, অমিতাভ বচ্চনের প্রতি মুগ্ধতা তাঁকে টেনে আনে বলিউডে। বলছি ওয়েব সিরিজ 'পাতাল লোক'-এর 'হাথোড়া ত্যাগী'র কথা। বেশ আলোচিত হয়েছে সিরিজটি এবং এই চরিত্রের অভিনেতা অভিষেক ব্যানার্জি। সম্প্রতি তাঁকে দেখা গেছে আরেক আলোচিত ওয়েব সিরিজ 'কালী'র দ্বিতীয় সিজনে। বাঙালি ছেলে অভিষেক এই সিরিজে এবারই প্রথম বাংলা ভাষায় অভিনয় করলেন। তাঁর নতুন কাজ, বাংলা ভাষায় অভিনয় আর বলিউডে নিজের জায়গা করে নেওয়ার গল্প প্রথম আলোকে শোনান অভিষেক ব্যানার্জি।
ছোটবেলা থেকে সিনেমার পোকা অভিষেক ব্যানার্জি। স্কুলে থাকতেই সত্যজিৎ রায়ের সব ছবি রীতিমতো গিলে খেয়েছেন। এখনো নাকি ভাবেন, 'বড়দের ছবিগুলো কেমন করে ছোটবেলাতেই দেখে ফেললাম!' তখন অভিষেক থাকতেন কলকাতায়। এরপর বাবার চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে তাঁকে চলে যেতে হয় চেন্নাইয়ে। সেই যে গেলেন, এরপর আর বাঙালিদের মধ্যে ফেরা হয়নি তাঁর। চেন্নাইয়ে গিয়ে সত্যজিৎ থেকে একবারে বদলি হয়ে গেলেন রজনীকান্তে। দক্ষিণি চলচ্চিত্রের 'থালাইভা' রজনীর নায়কোচিত আমেজ জেঁকে ধরল অভিষেকে মন আর মগজকে। সিনেমা দেখতে দেখতে বাঙালি ছেলে শিখে ফেললেন তামিল ভাষা। বাবা-মায়ের চিন্তা হলো। বাংলা তো ঠিক আছে, তামিলও হয়ে গেল, ছেলেকে এবার হিন্দিটা শেখানো দরকার। ব্যাস, মা–বাবা বুদ্ধি করে অভিষেকের জীবনে অমিতাভ বচ্চনকে ঢুকিয়ে দিলেন। এবার একই কায়দায় অমিতাভে বুঁদ হয়ে অভিষেক শিখে ফেললেন হিন্দিটাও। তবে শুধু ভাষা নয়, অমিতাভ বচ্চনের অভিনয় অভিষেকের মাথায় অভিনয়ের ভূতও চাপিয়ে দিল। দিল্লির কিরোরি মাল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেই মুম্বাইয়ের পথে পা বাড়ালেন অভিষেক, বলিউডে নাম লেখাবেন বলে।
অভিনয় করেন, অভিনেতা খোঁজেন
'স্ত্রী' ছবির 'জানা' চরিত্রটি দিয়ে অভিষেক ব্যানার্জি দর্শকের নজরে পড়েন। সেই কমিক চরিত্রটির জের ধরে এরপর 'ড্রিমগার্ল', 'বালা'র মতো ব্যবসাসফল ছবির অংশ হন। কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়, তবে দর্শক মনে রাখতে পারেন, ভালোবাসতে পারেন, এমন চরিত্রগুলোতেও দেখা দিতে থাকেন অভিষেক। যেন আগে থেকেই সাফল্যের আঁচ পেয়ে যান, আর সেই চরিত্রগুলোই বেছে নেন। এটা অবশ্য কোনো দৈবশক্তি বা কাকতাল নয়। অভিষেকের অভিজ্ঞতা তাঁকে সেরা চরিত্রগুলোর কাছে নিয়ে যায়। মুম্বাইয়ে এসে অভিষেক অভিনেতা নন, ইন্ডাস্ট্রি বোঝার জন্য আগে কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন। বড় বড় কাস্টিং ডিরেক্টরের সঙ্গে মিলে অভিষেক সিনেমার জন্য শিল্পী নির্বাচন করতেন। কয়েকটা উদাহরণ দিই: মোহাম্মদ জিশান আইয়ুব, যাঁর অভিনয় 'রাঞ্জনা', 'তনু ওয়েডস মনু', 'রইস'-এর মতো ছবিতে প্রশংসিত হয়েছে, সেই শিল্পী প্রথমবার বলিউডের ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন অভিষেক। 'নো ওয়ান কিলড জেসিকা' ছবিতে জেসিকার খুনি মনু শর্মার চরিত্রে অভিষেকের অভিনয়ের কথা ছিল। কিন্তু কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে তিনি মোহাম্মদ জিশানকে এই চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। আর এই শুরু হয় জিশানের বলিউডজীবন। এ ছাড়া কাস্টিং ডিরেক্টর অভিষেকের হাত ধরে বলিউডে নাম লিখিয়েছেন 'গালি বয়'খ্যাত সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী ও 'এক্সট্রাকশন'-এ বাংলাদেশি মাফিয়া ডন চরিত্রের অভিনেতা প্রিয়াংশু পাইনিউলি। ২০১০ সালে 'নকআউট' ছবির মধ্য দিয়ে সহকারী কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন অভিষেক। ২০১১ সালে বিদ্যা বালান ও এমরান হাশমির 'ডার্টি পিকচার' ছবিতে চিফ কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ পান তিনি। এরপর একে একে 'রক অন টু', 'ওকে জানু', 'টয়লেট: এক প্রেমকথা', 'সিক্রেট সুপারস্টার' আর সবশেষ 'পাতাল লোক'–এর মতো প্রশংসিত প্রযোজনার অংশ হয়ে যান তিনি।
প্রত্যাখ্যান থেকে পাওয়া শিক্ষা
ঘটনাটি তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের, ২০১২ সালের। কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে ভালোই করছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি। তখন তাঁর কাছে আসে রাজকুমার গুপ্ত পরিচালিত ছবি 'ঘনচক্কর'-এর চিত্রনাট্য। সেটার 'ইদ্রিস' চরিত্রটি মনে ধরে অভিষেকের। অডিশন দেন। কিন্তু পরিচালক বলেন, 'তোমাকে আরও কাজ করতে হবে। আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি অভিনয় করছ।' সেদিনের সেই প্রত্যাখ্যান থেকে অভিষেক একটা শিক্ষা নেন। তিনি শেখেন অভিনয়শিল্পীকে কেমন অভিনয় করতে নেই। তারপর দুই বছর নিজের অভিনয় নিয়ে কাজ করেন অভিষেক। ২০১৫ সালে ওয়েব সিরিজ 'পিচার' দিয়ে আবার অভিনয় শুরু করেন।
'রাং দে বাসন্তী' থেকে 'পাতাল লোক'
গত মাসে 'পাতাল লোক' সিরিজ মুক্তি পাওয়ার পরপরই অভিষেক ব্যানার্জির 'হাথোড়া ত্যাগী' চরিত্রটি আলোচনায় উঠে আসে, প্রশংসিত হয় অভিষেকের অভিনয়। ভারতীয় নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিষেকের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেখান থেকে জানা যায় মজার এক তথ্য। ২০০৬ সালে অভিষেক অডিশন দিতে যান ভারতীয় নির্মাতা রাকেশ ওম প্রকাশ মেহরার একটি তথ্যচিত্রে অভিনয়ের জন্য। তখন চলছিল রাকেশের 'রাং দে বাসন্তী' ছবির শুটিং। সেই ছবিতে কয়েক সেকেন্ড ব্যাপ্তির একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান অভিষেক। সেই এক দৃশ্যের অভিনেতার বর্তমান উন্নতি দেখে রীতিমতো মুগ্ধ অনুরাগ। তাঁর প্রশংসাকে অভিষেক আশীর্বাদের মতো গ্রহণ করেছেন।
বাবা–মায়ের জন্য 'কালী ২'
পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুরে জন্ম নেওয়া অভিষেকের সিনেমাপ্রীতি বাংলা ছবি দিয়ে শুরু হলেও তিনি এত দিন শুধু হিন্দি ভাষাতেই অভিনয় করে গেছেন। বাঙালি এই শিল্পীর কাছে বাংলা সিনেমা-সিরিজের প্রস্তাব আগে কখনো আসেনি। অবশেষে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম জি ফাইভ 'কালী ২' সিরিজের প্রস্তাব দেয় অভিষেককে। যখনই এই অভিনেতা জানতে পারেন সিরিজটি হবে বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষাতে, রাজি হয়ে যান অভিষেক। তিনি বলেন, 'একে তো আমি পাওলি দামের ভক্ত (সিরিজের নাম ভূমিকার অভিনেত্রী), অন্যদিকে এটি বাংলা ভাষায় তৈরি হবে। তাই প্রস্তাব পেয়েই রাজি হয়ে যাই আমি। বাবা–মায়ের ইচ্ছা ছিল আমাকে বাংলায় সংলাপ বলতে দেখবেন। 'কালী ২'দিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করলেন অভিষেক।