শাহরুখ আছে, শাহরুখ নেই—এই দোলাচলের ভেতর উদযাপিত হচ্ছে বলিউডের এই বাদশার ৫৬তম জন্মদিন।
শাহরুখ আছে, শাহরুখ নেই—এই দোলাচলের ভেতর উদযাপিত হচ্ছে বলিউডের এই বাদশার ৫৬তম জন্মদিন।

যে কারণে অস্কার পাননি শাহরুখ

শাহরুখ আছে, শাহরুখ নেই—এই দোলাচলের ভেতর উদযাপিত হচ্ছে বলিউডের এই বাদশার ৫৫তম জন্মদিন। একপক্ষ বলছে, হারিয়ে গেছে শাহরুখ। তাঁকে এলাকায় মাইকিং করেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আরেক পক্ষ বলছে, শাহরুখ একটু ‘রেস্টে আছেন’। তিনি এমনভাবে ফিরবেন যে তাক লেগে যাবে চারপাশে। লোকে মাথা ঝাঁকিয়ে বলবে, ‘শাহরুখ ফিরেছেন শাহরুখের মতোই।’ জন্মদিনে পড়ে নেওয়া যাক, শাহরুখের কিছু অজানা অধ্যায়।

গ্লোবাল স্টার প্রোফাইলের রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বের প্রতি পাঁচজনের একজন শাহরুখভক্ত।

অস্কারের চেয়ে শাহরুখের কাছে ভালোবাসা বড়

গ্লোবাল স্টার প্রোফাইলের রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বের প্রতি পাঁচজনের একজন শাহরুখভক্ত। শাহরুখ এমন একটা সময় পার করেছেন, যখন সমস্ত হলিউড তারকাদের পেছনে ফেলে তিনি ছিলেন বিশ্বের ১ নম্বর তারকা। তাঁর আমন্ত্রণে ভারতে ছুটে এসেছিলেন ব্রাড পিটও। ‘আলকেমিস্ট’খ্যাত লেখক পাওলো কোয়েলহো শাহরুখের ‘মাই নেম ইজ খান’ সিনেমা দেখে টুইট করেছিলেন, ‘এই প্রথম আমি শাহরুখের সিনেমা দেখলাম। এই সিনেমাটাকে দুর্দান্ত বললে কম বলা হবে।

১৯৯৫ সালের আগ পর্যন্ত শাহরুখের জীবন ঠিকঠাকই ছিল।

এই ছবির জন্য সেরা অভিনেতার অস্কার শাহরুখের প্রাপ্য। শাহরুখ যদি হলিউড তারকা হতেন, আর অস্কার যদি যথাযথ ‘‘বন্ঠন’’ করা হত, তবে একটা অস্কার শাহরুখের হাতে উঠত।’ এর উত্তরে শাহরুখ লিখেছিলেন, ‘অস্কারের চেয়ে মানুষের ভালোবাসা বড়। আর আমি সেটা অঢেল পেয়েছি। আপনার এই মূল্যায়নই অস্কারের চেয়ে কম কী?’

শাহরুখের সম্পদের পরিমাণ ৫ হাজার ৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। শাহরুখ খান অভিনীত ‘করণ-অর্জুন’, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘কাভি খুশি কাভি গম’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘দিল সে’, ‘দেবদাস’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’, ‘স্বদেশ’, ‘বাজিগর’, ‘ম্যায় হু না’, ‘বীরজারা’, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’, ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিগুলো বলিউডের সর্বকালের সেরা ছবির তালিকায় স্থান পাবে।

শাহরুখ ৩০ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে মনোনয়ন পেয়েছেন, আর জিতেছেন ১৪টি।

তিনি ৩০ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে মনোনয়ন পেয়েছেন, আর জিতেছেন ১৪টি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পেলে কী হবে, ২০০৫ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। ভক্তরা অবশ্য বলেন, শাহরুখকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হলে জাতীয় পুরস্কার সম্মানিত হবে। জাতীয় পুরস্কারের মর্যাদা বাড়বে। আর ২০১৪ সালে ফ্রান্স সরকার তাঁকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘নাইট অব দ্য লিজিওন অব অনার’ দেন। প্রথম ও একমাত্র ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে পেয়েছেন ‘দুবাই স্টার’ সম্মাননা। এসব বাদ দিলাম, শাহরুখের মোট সম্পদের পরিমাণ ৫ হাজার ৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর এর একটা বড় অংশ এসেছে বিজ্ঞাপন, পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে আর নিজের ব্যবসা থেকে।

হিরো বনাম ভিলেন
শাহরুখের প্রথম ছবি ‘দিওয়ানা’ মুক্তি পায় ১৯৯২ সালে। বলা হয়, নব্বইয়ের দশক ধরে বলিউড শাহরুখ খানকে তৈরি করেছে। পরের দশক, শাহরুখ দুই হাত ভরে দিয়েছে বলিউডকে। ভারতের বাইরে বলিউডের যে বিশাল জনপ্রিয়তা, তার একটা বড় অংশ এসেছে শাহরুখের হাত ধরে।

নব্বইয়ের দশকে শাহরুখ চলচ্চিত্রে এমন সব চরিত্র দিয়ে নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা বানিয়েছেন, যা অন্য তারকারা ভাবতেই পারেন না। ‘ডর’, ‘বাজিগর’, ‘ডুপ্লিকেট’, ‘ডন’, ‘ফ্যান’, ‘রইস’ সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্র হয়ে দর্শকের মন কেড়েছেন শাহরুখ। বলিউডের বড় পর্দায় ভিলেনকে হিরোর কাতারে নিয়ে আসা বা হিরোর চেয়ে বড় উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ায় শাহরুখের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

শাহরুখের সম্পদের পরিমাণ ৫ হাজার ৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা

ডিডিএলজে শাহরুখকে দিল আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন
তখন বলিউডের অন্যান্য সুপারস্টারদের কাছে নিয়মিত মাফিয়াদের ফোন আসত। ডনদের ‘বন্ধু’ হিসেবে প্রায়ই তাঁদেরকে ওইসব ডনদের প্রযোজিত সিনেমায় অভিনয়ের চাপ আসত। নিজের ও পরিবারের প্রাণের ভয়ে তাঁরা ওইসব সিনেমায় অভিনয়ও করতেন।
১৯৯৫ সালের আগ পর্যন্ত শাহরুখের জীবন ঠিকঠাকই ছিল। এই বছর ‘ডিডিএলজে’ (‘দিলওয়ালে দুলহানিয়ে লে যায়েঙ্গে’) মুক্তির পর বদলে গেল শাহরুখের জীবন। তুমুল হিট করে সর্বকালের সেরা অর্থ উপার্জনকারী সিনেমার তালিকায় নাম লেখাল। রাতারাতি ‘স্ট্রাগলিং অ্যাকটর’ থেকে সুপারস্টার বনে গেলেন শাহরুখ।

‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবিতে কাজল ও শাহরুখ খান।

জীবন নিয়ে যত সুখকল্পনা করেছিলেন, এই সিনেমা তারচেয়েও ঢের বেশি দিল। কিন্তু সুপারস্টার হওয়ার ‘প্যাকেজে’ অর্থ, খ্যাতি, যশের সঙ্গে সঙ্গে এল আন্ডারওয়ার্ল্ডের ফোন।

শাহরুখ খান, মহেশ ভাট, চাহাত, ডুপ্লিকেট আর...
১৯৯৫ সালেই শাহরুখ খান মহেশ ভাটের পরিচালনায় ‘চাহাত’ ও ‘ডুপ্লিকেট’ সিনেমার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। ১৯৯৭ সালের ১২ আগস্ট গ্যাংস্টার আবু সালেমের (উপমহাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়াদের সংগঠন ডি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগী) কথামতো কাজ না করায় মন্দির থেকে ফেরার পথে জনসমক্ষে হত্যা করা হয় টি সিরিজের প্রতিষ্ঠাতা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক গুলশান কুমার‍। এই প্রযোজকের মাধ্যমে সিনেমায় বিনিয়োগ করে কালো টাকা সাদা করতে চেয়েছিলেন তিনি। ‘ডুপ্লিকেট’ সিনেমার শুটিংয়ের সময় মুম্বাইয়ের সিনিয়র পুলিশ অফিসার রাকেশ মারিয়া মহেশ ভাটকে ফোন করে জানান, ডনদের নতুন টার্গেট শাহরুখ খান। শাহরুখকে নিয়ে তাই সব ধরনের আউটডোর শুটিং বন্ধ রাখা হয়। মহেশ ভাট সঙ্গে সঙ্গে শাহরুখকে সবটা জানান।

শাহরুখের সফলতার গল্প তো সবারই জানা

পাঁচ মিনিট পরপর গাড়ি বদলাতেন শাহরুখ
সেই সময় শাহরুখের স্ত্রী গৌরির পেটে তাঁদের প্রথম সন্তান আরিয়ান। শাহরুখ খান এদিনই রাকেশ মারিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। এই পুলিশ অফিসার শাহরুখকে বলেছিলেন, ‘এগুলো সুপারস্টার হওয়ার সঙ্গে ফ্রি আসে। আপনি টেনশন করবেন না। আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের।’ কথা রেখেছিলেন সেই পুলিশ। শাহরুখ খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেন। ঘরের বাইরে তাঁকে ‘ওয়াই’ ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দেওয়া হয়। বাড়ি থেকে শুটিংয়ে যাওয়ার পথে পাঁচ মিনিট পরপর গাড়ি বদলাতেন শাহরুখ।

সন্তান ও স্ত্রীর জীবন শাহরুখের নিজের জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
যদিও শাহরুখ ঘর থেকে বেরোতেন না বললেই চলে, তবে এক তারকার বিয়ের দাওয়াতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন শাহরুখ। সেখানে শাহরুখের কাছে এক ভক্ত অটোগ্রাফ চান। সে কোটের পকেট থেকে কলম বের করতেই শাহরুখ ভেবে বসেন, সে বুঝি ভাড়াটে খুনি। ছদ্মবেশে এসে পিস্তল বের করছে তাঁকে খুন করার জন্য। ভয়ে শাহরুখ চিৎকার করে ‘গৌরি’ বলে স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই ঘটনা প্রসঙ্গে শাহরুখ বলেন, ‘আমার নিজের জীবন নিয়ে পরোয়া করি না। ওর পেটে তখন আমাদের প্রথম সন্তান। তার আর তার মায়ের জীবন আমার কাছে আমার জীবনের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গৌরি আমার মা, বাবা, বন্ধু, স্ত্রী সবই। ও আমার জন্য মারা যাবে, এটা কিছুতেই হতে পারে না। কিছুতেই না।’

স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে শাহরুখ খান।

অবশেষে এল সেই ফোন
১৯৯৭ সালেই খান্ডালা থেকে ‘দিল তো পাগাল হ্যায়’ সিনেমার শেষ লটের শুটিং করে ফিরছিলেন শাহরুখ। গাড়িতে বেজে উঠল অজানা নম্বর থেকে ফোন। মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন শাহরুখ। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন কুখ্যাত ডন আবু সালেম। তিনি শাহরুখকে ফোন করে পার্টিতে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে হাসাহাসি আর গালাগালি করছিলেন। শাহরুখ ঠান্ডা মাথায় ইংরেজিতে উত্তর দিয়েছিলেন। শাহরুখের সঙ্গে সালেমের আলাপ দীর্ঘদিন বলিউডের আলোচনার বিষয় ছিল। সেই সময় পরিস্থিতি সামলে সাহসের সঙ্গে জুতসই উত্তর দেওয়ার জন্যও প্রশংসিত হন শাহরুখ।

‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিতে শাহরুখ খান।

বিরতি ভেঙে ফিরছেন শাহরুখ
‘জিরো’ বক্স অফিসে রসগোল্লা পাওয়ার পর প্রায় দুই বছর ছবি নেই কিং খানের। শাহরুখের ভক্তদের অপেক্ষা আর কত! অবশেষে অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। চলতি বছরের নভেম্বরে আবার লাইট–ক্যামেরা–অ্যাকশনের আঙিনায় নামতে যাচ্ছেন এই অভিনেতা। তাঁর সঙ্গে দেখা যাবে দীপিকা পাড়ুকোন ও জন আব্রাহামকে। তবে এই মুহূর্তে শাহরুখ মেতে আছেন আইপিএল নিয়ে।

‘ওম শান্তি ওম’ ছবিতে দীপিকা পাড়ুকোন ও শাহরুখ খান।


শাহরুখের সফলতার গল্প তো সবারই জানা। খুব সংক্ষেপে বললে হয়, ‘এলেন, অভিনয় করলেন, জয় করলেন।’ কিন্তু শাহরুখের ভাষায়, এসব তারকাখ্যাতি, সম্পদের পাহাড়, সবই নাকি বাহ্যিক। ভেতর থেকে তিনি এখনো দিল্লীর ২২ বছরের সেই সাধারণ ছেলেটা। জীবনের এতটা সময় পার করে এসেও শাহরুখ বারবার ফিরে যান অতীতে। যে অতীত আজ তাঁকে বাদশাহ বানিয়েছে। ‘হিন্দুস্তান টাইমস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি মধ্যবিত্ত, খুব সাধারণ পরিবারের ছেলে। তাই আমার জন্য আজ এত দূর আসা কোনো রূপকথার গল্প থেকে কম নয়। আমার জীবনের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্প। আর এই গল্পের সবচেয়ে বড় অনুঘটক মানুষের ভালোবাসা। আমি এখনো এসব বিশ্বাস করতে পারি না। আমি এখনো দিল্লির সেই ছেলেটা। মাঝেমধ্যে মনে হয়, কত কাল ধরে আমি এই পথ ধরে হেঁটে চলছি...আবার হঠাৎ করে মনে হয়, এই তো গতকালেরই কথা। মাঝে চোখের পলকে পেরিয়ে গেছে এক নয়, দুই নয়, তিন যুগ।’
প্রসঙ্গত এই মুহূর্তে শাহরুখ আছেন দুবাইয়ে। ব্যস্ত আছেন আইপিএল নিয়ে।

শাহরুখ খান।