আজ থেকে ২০ বছর আগে ২০০১ সালের ১৫ জুন মুক্তি পায় ‘লগান’। নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় ক্রিকেট-অজ্ঞ দরিদ্র একদল গ্রামবাসীর সঙ্গে অভিজ্ঞ ব্রিটিশ অফিসারদের সেই ম্যাচ। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের দম্ভ খেলার মাঠে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার সেই দৃশ্য। মনে পড়ে ধুতি ও পাগড়ি পরা ক্যাপ্টেন ভুবনকে। বাঁশের কঞ্চির তৈরি ক্রিকেট প্যাড।
আশুতোষ গোয়ারিকর পরিচালিত ও আমির খান অভিনীত ‘লগান’ আমাদের দেশেও দারুণ আলোচিত ছিল সে সময়। প্রশংসিত এবং ব্যবসাসফল ছবিটি আজ ২০ পেরিয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েকজন বিনোদন সাংবাদিকের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল আড্ডায় বসেছিলেন নায়ক ও প্রযোজক আমির খান। যোগ দিয়েছিলেন প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধি দেবারতি ভট্টাচার্য।
পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণায় আমির খান বলেন, ‘“লগান” আমার কাছে এক সুন্দর সফর। এই সফর আজও চলছে। সময় যত এগিয়েছে, আরও মানুষ এই সফরের সঙ্গী হয়েছে। ছবিটির মাধ্যমে আমরা সবাই একটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ছয় মাস আমরা প্রতিবেশীর মতো একটা কমপ্লেক্সে ছিলাম।’
‘লগান ১১’ নামে এক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ
আমির জানান, ‘ শুধু অভিনয়শিল্পীরা নয়, গ্রামবাসী, ভুজের নাট্যকর্মীরা, ব্রিটিশ অভিনেতারা, কলাকুশলীরা—আমরা সবাই একটা পরিবারের মতো ছিলাম।’ ৩০০ সদস্যের পরিবার। পরস্পর সুখ-দুঃখ একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন। এখনো এই ছবির সব অভিনয়শিল্পী বছরে একবার মিলিত হন। আমির খান বলেন, ‘আমরা একে অপরকে চরিত্রের নামে আজও ডাকি। আমি ওদের কাছে “আমির” নই, শুধুই “ভুবন”। আমাদের “লগান ১১” নামে এক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। অবশ্য আমি এখন মোবাইল ব্যবহার করি না।’
আমির আশুতোষ, কাউকে রেহাই দিত না রীনা
স্মৃতি হাতড়িয়ে আমির খান বলেন, ‘লগান’-এর স্মৃতি মেলে ধরলে সবার আগে রীনার নাম মাথায় আসে। একদিন রাতে তাঁকে বলি যে আমি ছবি প্রযোজনা করব। আর তাঁকে আমার পাশে চাই। রীনা ঘাবড়ে যায়। কারণ তাঁর ছবি নির্মাণ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছিল না। এরপর রীনা সুভাষ ঘাই, অশোক ঠাকারিয়াসহ অনেকের সঙ্গে দেখা করে ছবি নির্মাণের নানা খুঁটিনাটি শেখে। অনেক কম সময়ের মধ্যে রীনা এত বড় গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল!
‘লগান’-এর মতো বড় মাপের ছবি প্রযোজনা করেছিল সে। রীনা আমার কাছে সেরা বিস্ময় ছিল। তবে প্রযোজক হিসেবে রীনা ছিল খুবই কঠোর। সবাইকে সে খুব বকাবকি করত। আমাকে, আশুতোষকেও রেহাই দিত না। ছবি নির্মাণ হওয়ার পর রীনা সবাইকে নিজের হাতে লিখে একটা চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠিটা এতটা আবেগে ভরা ছিল যে আমাদের সবার চোখে পানি চলে আসে।
অ্যাওয়ার্ড গুরুত্বহীন
‘লগান’ ছবিটি ‘অস্কার’ (বিদেশি ভাষার ছবি)-এর জন্য মনোনীত হয়েছিল। তবে আমির খান বরাবরই অ্যাওয়ার্ডকে কখনই গুরুত্ব দেন না। এমনকি অস্কারকেও না। এর কারণ হিসেবে আমির খান বলেন, ‘এক বছরে আমার অভিনীত “দঙ্গল”, “থ্রি ইডিয়টস”, আর “লগান” যদি মুক্তি পায়, তাহলে কোন ছবিটাকে সবার আগে রাখবেন। ব্যক্তিবিশেষে পছন্দ আলাদা হবে। এটা কোনো রেস নয় যে প্রথম, দ্বিতীয় নির্বাচন করা যাবে। তাই আমার মতে পুরস্কার নিয়ে সিরিয়াস হয়ে লাভ নেই। আসুন সবাই মিলে সিনেমাকে উপভোগ করি। আর একে অপরের কাজ উদ্যাপন করি।’
তিনি বলেন, ‘এটা পরিষ্কার যে আমি কেন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে যাই না। তবে আমি জীবনে দুটো ভারতীয় অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম, একটা “দীননাথ মঙ্গেশকর” আরেকটি “গোলাপুরি শ্রীনিবাস অ্যাওয়ার্ড”। এই দুটো পুরস্কার খুবই দুষ্প্রাপ্য আর সম্মানজনক।’
ভেবেছিলেন ২০ হাজার, পেয়েছিলেন ২ লাখ
মুখ্য চরিত্রে আমির খান ছাড়াও ছবির প্রতিটি পার্শ্ব চরিত্র দারুণ অভিনয় করে। এঁদের মধ্যে অন্যতম ‘লখা’-র ভূমিকায় যশপাল শর্মা। ২০ বছর পরও ছবির প্রতিটি খুঁটিনাটি তাঁর মনে আজও উজ্জ্বল। ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে সে রকমই একটা মজার ঘটনা জানালেন যশপাল।
অডিশন দিয়ে মনোনীত হওয়ার পর ছবির প্রযোজক তথা আমিরের তৎকালীন স্ত্রী রীনা দত্তের কাছে তাঁকে যেতে বলা হয়। উদ্দেশ্য, পারিশ্রমিক নিয়ে আলোচনা। যশপাল বলেন, ‘ভাবছিলাম কত চাইব। আমির খানের প্রযোজনার সংস্থার ছবি। প্রথমে ভেবেছিলাম পারিশ্রমিক বাবদ ১ লাখ টাকা চাইব। তারপর ভাবলাম না থাক, ৮০ হাজার চাইব। আবার ঠিক করলাম ৫০ হাজার টাকা নেব। তবে যেহেতু সেই মুহূর্তে হাতে কোনো কাজ ছিল না, বলতে গেলে বেকারই বসে ছিলাম, তাই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম ২০ হাজার পেলেও রাজি হয়ে যাব!’
শেষ পর্যন্ত যখন রীনা দত্তের সঙ্গে দেখা করলেন। রীনা জানালেন যে তাঁদের যেহেতু একটা ‘লিমিটেড’ বাজেট, তাই যশপালকে দেড় লাখ টাকার বেশি দিতে পারবেন না। শুনে চমকে উঠেছিলেন যশ, ‘কোনো রকমে মুখ ফুটে বললাম অঙ্কটা ২ লাখে পৌঁছাতে পারে কি না। তাঁরা তাতেই রাজি। আমি তো তখন আনন্দে আত্মহারা। যা ভেবেছিলাম তার থেকে বহুগুণ বেশি পেলাম।’
প্রসঙ্গত, ‘লগান’ মুক্তির পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি যশপালকে। বলিউডের বহু প্রথম সারির অভিনেতার সঙ্গে একাধিক সুপারহিট ছবিতে কাজ করেছেন। এমন অনেক গল্পই আজ বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। স্মৃতিচারণা করছেন শিল্পীরা।