প্রথম আলোর মুখোমুখি রাজকুমার রাও

ইদানীং বড় বড় তারকার বড় বাজেটের ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ছে। এই খরার বাজারে রাজকুমার রাও হিটের জোয়ারে ভাসছেন। তাঁর অভিনীত ‘বরেলি কি বরফি’, ‘নিউটন’—পরপর দুটি ছবিই হিট। সব ধরনের চরিত্রেই সমান সাবলীল বলিউডের এই অভিনেতা। চরিত্রের প্রয়োজনে নিজের শরীরকে ভেঙে চুরমার করতে পিছপা হন না রাজকুমার। ১০ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত ছবি ‘শাদি মেঁ জরুর আনা’। রত্না সিনহা পরিচালিত এ ছবিতে রাজকুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন বলিউড তারকা কৃতি খরবান্দা। ছবির মুক্তির আগে প্রযোজকের অফিসে রাজকুমার রাওয়ের মুখোমুখি প্রথম আলো। এই আলাপচারিতায় উঠে আসে তাঁর ছবি থেকে প্রেমিকার কথা পর্যন্ত। তবে শর্ত ছিল ‘নিউটন’ ছবির বিতর্ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।

রাজকুমার রাও
রাজকুমার রাও


‘নিউটন’ ছবির সাফল্যের জন্য আপনাকে অভিনন্দন। কখনো আশা করেছিলেন, ‘নিউটন’ অস্কারের জন্য নির্বাচিত হবে?
ধন্যবাদ। না, সে রকম কোনো আশা করিনি। আমার মায়ের আশীর্বাদের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয়। তবে এখন সবে শুরু। অস্কারের জন্য এখনো অনেকটা পথ চলতে হবে। প্রথম পাঁচটি ছবির মধ্যে আসার জন্য ৯২টি ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। তাই সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা অত্যন্ত সততার সঙ্গে ‘নিউটন’ ছবিটি বানিয়েছি। ‘নিউটন’ মুক্তির পর বক্স অফিসে সাফল্য পেয়েছে। চিত্র সমালোচকেরা প্রশংসা করেছেন। ছবিটি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। অস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। সব মিলিয়ে ভালো লাগছে।

আমির খানের মতে, ‘নিউটন’ অস্কারের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর সবার নজরে এসেছে।
আমিও আমির খানের সঙ্গে একমত। সত্যি, ‘নিউটন’ ছবির নাম অস্কারের জন্য ঘোষিত হওয়ার পর ছবিটি আরও বেশি করে সাফল্য পেয়েছে। অস্কার ‘নিউটন’ ছবিকে সফল করতে অনেকটা সাহায্য করেছে।

একই ঘটনা আপনার ক্ষেত্রেও ঘটেছে? মানে, জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর সবাই আপনাকে বেশি করে চিনেছে?
একদম তাই। আগে আমাকে ‘রাগিণী এমএমএস’ হিসেবে সবাই চিনত। জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর আমার একটি অন্য পরিচিতি হয়েছে। আমার নামেই এখন সবাই চিনতে পারে।

তার মানে, আপনার কাছে পুরস্কারের গুরুত্ব আছে।
অবশ্যই। পুরস্কারকে সব সময় খোলা মনে স্বাগত জানাই।

‘বরেলি কি বরফি’ ছবির পরিচালক অশ্বিনী আইয়ার। এরপর ‘শাদি মেঁ জরুর আনা’ ছবিতে রত্না সিনহার পরিচালনায় কাজ করলেন। পরপর দুজন নারী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
আমার কাছে নারী বা পুরুষ কোনো ভেদাভেদ করে না। আমি হলিউডের ‘ফাইভ ওয়েডিংস’ ছবিতে নারী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। এটা সম্পূর্ণ আমাদের মনের ব্যাপার। একজন পুরুষ পরিচালনা করেন। একজন নারীও পরিচালনা করেন। আর জয়া আখতার ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’র মতো পুরুষকেন্দ্রিক ছবি পরিচালনা করেছেন। তাই সিনেমার ক্ষেত্রে লিঙ্গ ভেদাভেদের কোনো মানে হয় না।

‘শাদি মেঁ জরুর আনা’ ছবিতে রাজকুমার রাও আর কৃতি খরবান্দা


বলিউড এখন মার্কিন রোমান্স ছেড়ে দেশি রোমান্সের দিকে ঝুঁকেছে। আপনি নিজে ‘বরেলি কি বরফি’র পর ‘শাদি মেঁ জরুর আনা’ ছবিটি করেছেন। এটা কি বলিউডের নতুন ধারা?
তা বলতে পারেন। তবে এটা তো ভালো লক্ষণ। ছোট ছোট শহর নিয়ে আমাদের দেশ। দেশি রোমান্সের সঙ্গে মানুষ কোথাও নিজের ভালোবাসাকে খুঁজে পায়। ছোট শহরের চরিত্রগুলোর মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়। তাই এ ধরনের সিনেমাগুলো সাফল্যও পাচ্ছে।

পরিচালক হংশল মেহতা এক সাক্ষাৎকারে আপনার শিল্পীসত্তার প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, আপনি নাকি ছবি পরিচালনার ক্ষেত্রে ইনপুট দেন।
হ্যাঁ, আমি শিল্পমনস্ক মানুষ। তবে আমি কখনো পরিচালকের পরিচালনার কাজে নিজের কোনো মতামত দিই না। ছবিতে নিজের চরিত্রটি আরও ভালো করার জন্য কিছু ইনপুট দিয়ে থাকতে পারি। এর বেশি কিছু নয়।

‘শাদি মেঁ জরুর আনা’র ক্ষেত্রে নিজের ক্রিয়েটিভিটি কিছু দিয়েছেন?
এ ছবির ক্ষেত্রে কিছু সংযোজন করেছি। আমি আর ছবির নায়িকা কৃতি—দুজনই নিজেদের চরিত্রের ক্ষেত্রে নিজস্বতা কিছু যোগ করেছি। ফলে চরিত্রগুলো আরও বাস্তব হয়ে উঠেছে।

ছবির নায়িকা কৃতি খরবান্দার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
কৃতি খুব পরিশ্রমী এবং প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী। আর ও খুব নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে। আমাদের মধ্যে দুর্দান্ত বোঝাপড়া ছিল। আমরা দুজনই চরিত্রের সঙ্গে এক হয়ে যাই। আমি সত্যেন্দ্র অর্থাৎ সত্তু হয়ে উঠেছিলাম আর কৃতি বাস্তবে আরতি হয়ে উঠেছিল। আমরা সব সময় চেষ্টা করতাম আমাদের চরিত্রগুলো আরও ভালোভাবে তুলে ধরতে।

‘নিউটন’ ছবিতে রাজকুমার রাও


‘বরেলি কি বরফি’ ছবিতে আপনাকে উত্তর প্রদেশের এক ছোট শহরের প্রীতম বিদ্রোহীর চরিত্রে দেখা যায়। প্রীতম কি আপনাকে সত্তু হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে?
প্রীতম আর সত্তু দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র। দুজনই উত্তর প্রদেশের ছোট শহরের হলেও দুজনের কোনো মিল নেই। এমনকি আমাকে ‘শাদি মেঁ জরুর আনা’ ছবিতে দুটি ভিন্ন চরিত্রে দেখতে পাবেন। ছবির বিরতির আগে আমি এক রকম, আবার পরে আরেক রকম। তবে এ কথা বলতে পারি, ‘বরেলি কি বরফি’ ছবির মাধ্যমে আমাকে অনেকটা সময় উত্তর প্রদেশে কাটাতে হয়েছে। তাই সেখানকার কথা বলার স্টাইল তখন শিখেছি। আর এটা আমাকে এ ছবির ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমাদের এ ছবির গল্পকার উত্তর প্রদেশের মানুষ। তাঁর থেকেও শিখেছি উত্তর প্রদেশের কথা বলার ধরন।

শুনেছি, আপনি আজও অভিনয় শিখতে ক্লাসে যান?
ঠিকই শুনেছেন। অভিনয়ের পরিসরটা বিশাল। অভিনয়ের কত দিক আছে! তাই এখানে শেখার অন্ত নেই। আমরা কেউ নিজেদের সম্পূর্ণ অভিনেতা বলে দাবি করতে পারি না। আমি মুম্বাইতে অভিনয়সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মশালায় যাই। ‘লাইফ ইজ আ লার্নিং প্রসেস’। তাই জীবনে চলার পথে রোজ আমরা কিছু না কিছু শিখছি।

বাংলা ছবি ‘সায়রা বানু’তে আপনি কাজ করছিলেন।
ছবিটা পেয়ে আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম। মাঝপথে ছবির শুটিং বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর হবে ‘সায়রা বানু’র শুটিং বন্ধ আছে। প্রযোজকের অভ্যন্তরীণ কোনো সমস্যা আছে।

‘সুভাষ চন্দ্র বসু’র ওপর ওয়েব সিরিজে আপনি কাজ করেছেন। ওয়েব সিরিজে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
দারুণ! এখানে শুক্রবারের চাপ নেই। বক্স অফিসের টেনশন নেই। সেন্সরের কাঁচি নেই। ওয়েব সিরিজ দেখলেই বুঝতে পারবেন কতটা যত্ন করে বানানো হয়েছে। ‘বোস ডেড অর অ্যালাইভ’ ছবিতে সুভাষ চন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য আমি প্রায় ১২ কেজি ওজন বাড়িয়েছি। মাথা অর্ধেক কামিয়ে ফেলেছি।

প্রেমিকা পত্রলেখার সঙ্গে রাজকুমার রাও


ছোট শহরের সাধারণ তরুণ থেকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নিজেকে একই ঘরানায় বেঁধে রাখতে চান না বলে নানা চরিত্রে কাজ করছেন?
একদম তাই। আমি চাই নতুন নতুন চরিত্রে অভিনয় করতে। দর্শককে সব সময় চমক দিতে পছন্দ করি। একই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে নিজের গায়ে কোনো তকমা লাগাতে চাই না। আমাকে নানা চরিত্রে মানুষ যেন আবিষ্কার করতে পারে। অনেকেই বলেন, এখন শুধু রোমান্টিক ছবিতে কাজ করতে। এত কম বয়সে আমি কেন সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করি, এ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন। তাহলে আমি কি সুভাষের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য আমার ৪০ বছর বয়স হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব?

চলচ্চিত্র দুনিয়ায় মাত্র সাত বছর হলো আপনি এসেছেন। বড় বড় তারকার মাঝে আপনি এরই মধ্যে নিজের জায়গা বানিয়ে নিয়েছেন। কী করে সম্ভব হলো?
তা আমার জানা নেই। হতে পারে আমি নানা চরিত্রে অভিনয় করি বলে বোধ হয় এটা সম্ভব হয়েছে। আর আমি কখনো কাজের ক্ষেত্রে কোনো সমঝোতা করিনি।

কিছুদিন আগে বলেছিলেন, প্রতিভা থাকলে তাকে আটকে রাখা যায় না। কিন্তু অনেকের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও হারিয়ে যায়। বিশেষ করে নতুনদের অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়।
আমি এখনো বিশ্বাস রাখি যে প্রতিভা থাকলে একদিন তা বিকশিত হবে। হয়তো দেরি হবে, কিন্তু প্রতিভাকে কেউ আটকে রাখতে পারে না। আর তার জ্বলন্ত উদাহরণ মনোজ বাজপেয়ি, ইরফান খান, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির মতো অভিনেতারা। এ কথা ঠিক যে অনেক সময় নতুনদের প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। তবে নিজের মেধার প্রতি আস্থা রাখা উচিত। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ভুল পথে সাফল্য পাওয়া যায় না।

চলচ্চিত্র জগতের কে আপনার প্রেরণা?
অনেকেই আমায় প্রেরণা জোগান। ইরফান খান, মনোজ বাজপেয়ি, আমির খান, নাসিরউদ্দিন শাহ স্যার—এঁদের থেকে আমি প্রেরণা পাই।

প্রযোজনা করার কথা ভেবেছেন?
প্রযোজনার কথা মাথায় আছে। নিশ্চয় একদিন প্রযোজনা করব।

‘বোস ডেড অর অ্যালাইভ’ ছবিতে রাজকুমার রাও


‘ফ্যানি খান’ ছবির শুটিং কতটা এগিয়েছে?
অনিল কাপুরের সঙ্গে কিছু দৃশ্যের শুটিং হয়েছে। এখন শুটিং বন্ধ। দিওয়ালির পর শুটিং শুরু হবে। তবে ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনের সঙ্গে এখনো শুটিং হয়নি।

অনিল কাপুরের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
দারুণ। খুবই প্রাণবন্ত মানুষ। তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমাদের দুজনের বন্ডিং খুব ভালো। আর পর্দায়ও তার প্রতিফলন পাবেন।

বাংলাদেশে কখনো গেছেন?
না, যাওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশে আমার কিছু বন্ধু আছেন। পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আমার খুব ভালো বন্ধু।

ফারুকীর নতুন ছবি ‘ডুব’ দেখেছেন?
না, দেখা হয়নি। তবে ট্রেলার দেখেছি। ‘ডুব’ ছবির ট্রেলার দারুণ লেগেছে। এ ছবিতে ইরফান খান অভিনয় করেছেন। ‘ডুব’ দেখার ইচ্ছে আছে।

নিজের বিয়েতে কবে আমন্ত্রণ জানাবেন?
রিল লাইফের বিয়ে থেকে সময় বের করতে পারছি না যে রিয়েল লাইফে বিয়ে করব।

কনে তো প্রস্তুত, মানে আপনার প্রেমিকা পত্রলেখার কথা বলছি।
হা হা হা, (হেসে) আমি আর পত্রলেখা একসঙ্গে সুখে আছি। এখন বিয়ের কথা ভাবছি না। দুজনই এখন কাজে ব্যস্ত। আর দুজন ক্যারিয়ারটা মন দিয়ে করতে চাই।